কৃত্তিবাসী: মন্দির টেরাকোটায় রাম-রাবণের যুদ্ধ ও বানরসেনার কীর্তিকলাপ। রাধাবিনোদ মন্দির, কেন্দুলি, বীরভূম
মহাকাব্যে জেগে আছে ভারত-সংস্কৃতির মহাপ্রাণ। সে কাব্যধারায় বিকশিত হয়েছে সমাজ, সংসার, প্রেম, ধর্ম, নীতি-নৈতিকতা, যুদ্ধ-শান্তি, সাফল্য-ব্যর্থতার কত হিসাবনিকাশ। তাই, রামায়ণ ও মহাভারতের মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনার অন্তর্ভেদী রূপ শুধু কাব্যবচনে সীমাবদ্ধ নয়— বা নিছক ধর্মীয় সীমাবদ্ধতায় তাকে নির্দিষ্ট করাও সম্ভব নয়। তা জীবনসত্তায় মিলেমিশে সর্বজনীন রূপ পেয়েছে, কালপ্রবাহে হয়ে উঠেছে জীবনেরই কাব্যগাথা। স্থানকালের বিস্তৃত আঙিনা জুড়ে ছড়িয়ে আছে বহু চরিত্রের এই মোহিনীজগৎ।
বাল্মীকি আদিতে যে রামায়ণ রচনা করেছিলেন, দেশকালের নিরিখে তার কতই রূপবৈচিত্র ঘটেছে। পরে কৃত্তিবাস লিখছেন, ‘এক রামায়ণ শত সহস্র প্রকার।/ কে জানে প্রভুর লীলা কত অবতার।।’ পনেরো শতকের কবি কৃত্তিবাস ওঝা বাংলায় যে রামায়ণ রচনা করেছিলেন, সেই কাব্যবর্ণনার সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে সময় সমাজ ও কবির প্রসঙ্গ। বাঙালি জীবনে কৃত্তিবাসী রামায়ণের যে ছোঁয়া তা দেশ-কাল-সমাজের কথা বলে। এই রামায়ণে আছে নানা লৌকিক উপাদান। মধ্যযুগের অন্তিম পর্যায়ে এবং পরবর্তীতে, বিশেষ করে সতেরো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলার মন্দির-ভাস্কর্যে যে বহুবিচিত্র রূপশৈলী সে কালের সূত্রধর শিল্পীরা সৃষ্টি করেছিলেন, তার কাহিনি-সংশ্লিষ্ট রূপ নিষ্ঠ গবেষক অমিয়শঙ্কর চৌধুরীর বর্ণনায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। রামায়ণের কাহিনি বর্ণনায় এই ভাস্কর্যশৈলীর রূপবিশ্লেষণ নিঃসন্দেহে অভিনব প্রয়াস।
কৃত্তিবাস ও বাংলা রামায়ণ
লেখক: অমিয়শঙ্কর চৌধুরী
মূল্য: ১৫০.০০। প্রকাশক: সিগনেট প্রেস
কৃত্তিবাস যেমন রামায়ণ বা শ্রীরাম পাঁচালিকে অনুবাদ না করে বলা যায় রামকথাকে বাংলার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টের অঙ্গীভূত করেছেন। পোড়ামাটিতে উৎকীর্ণ মন্দির ফলকে রামায়ণ কাহিনির যে রূপ তা বাংলার বিভিন্ন মন্দিরের উদাহরণ সহ উল্লেখ করেছেন লেখক। রাজা দশরথের পুত্রলাভের জন্য হোমযজ্ঞ, তাড়কারাক্ষসী বধ, হরধনু ভঙ্গ ও সীতাবিবাহ, রামের মারীচবধ, রাবণের সীতাহরণ, লঙ্কাযুদ্ধ, হনুমানের লঙ্কাদহন, সীতার অগ্নিপরীক্ষা, উপবিষ্ট রামরাজা ও সীতা, রামের অশ্বমেধ যজ্ঞে বাল্মীকি ও অন্য মুনিঋষি প্রভৃতির ভাস্কর্য দেখা যায় বিভিন্ন মন্দিরের ফলকে। সপ্তকাণ্ডে সম্পূর্ণ কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাঙালি জীবনের স্মৃতি-আবেগ-কল্পনার মোহময় টানাপড়েনের এক অনন্য নজির। বাঙালির শৈশব থেকে কত ভাবে জড়িয়ে রামায়ণের এই কাব্যজগৎ। সমাজ-সম্পর্ক ও রণনীতির দর্শনের যে দৃঢ়বদ্ধতা মহাভারতে দেখা যায়, তার থেকে রামায়ণ বাঙালি সমাজের অনেক কাছাকাছি মিলেমিশে আছে।
এই প্রয়াস বৃহত্তর জনজীবনেও নানা ভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বিদ্যাসাগর-রচিত পদ্য-সংগ্রহে কৃত্তিবাসী রামায়ণের সংকলিত আলোচনায় দশরথের জন্ম, রাজ্যপ্রাপ্তি, বিশ্বামিত্রের যজ্ঞ, রামচন্দ্রের মিথিলা গমন, রাজ্যাভিষেক, ভরতের রাম-অন্বেষণে গমনবৃত্তান্ত আছে। এ ছাড়া গদাধর চট্টোপাধ্যায়ও (শ্রীরামকৃষ্ণ) রামায়ণের হরিশ্চন্দ্র, সুবাহু, মহীরাবণ ও যোগাদ্যা পালা অনুলিখন করেছেন সেই কিশোর বয়সেই। রামায়ণ চর্চায় কৃত্তিবাসের অন্যতম শিক্ষাগুরু হিসাবে শ্রীনাথ আচার্য চূড়ামণির পরিচয় প্রতিষ্ঠা, মুদ্রিত পাঠে কৃত্তিবাসী রামায়ণের নানা সংশোধন, বাংলা রামায়ণের নিম্নবর্গীয় কবিরা, কৃত্তিবাসের অপরিগ্রহ, কৃত্তিবাস স্মরণোৎসব ইত্যাদি বিষয় তথ্যভিত্তিতে আলোচনায় এসেছে। রামায়ণ চর্চাকারী প্রখ্যাতরা ছাড়া বহু সাধারণ মানুষ এই মহাকাব্যকে বাংলায় রূপ দিয়েছেন। সব মিলিয়ে বাংলায় এমন দুই শতাধিক কবির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণের বিচিত্র ধারাবাহী জনমোহিনী পথ-অন্বেষণে অমিয়শঙ্কর ছিলেন একান্ত উৎসাহী।
প্রায় আড়াই হাজার বছরের উত্তরাধিকার নিয়ে রামায়ণ জনজীবনের মানসলোকের অনন্য দৃশ্যকাব্য। তবে, এই বইয়ে টেরাকোটা ফলকের রামায়ণ-সংশ্লিষ্ট আলোকচিত্র থাকলে কৃত্তিবাসী রামায়ণের সজীব ধারার স্পর্শ আরও স্পষ্ট হত।