পুস্তক পরিচয় ৩

সবার সামনে জীবনকে মেলে ধরা

উত্তর প্রদেশের ছোট্ট শহর রুদৌলি। তার প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট সাফিয়া আখতার, কবি-গীতিকার জাভেদ আখতারের মা। তল্লাটের লোকেরা দেখিয়ে দিতেন, ওই মেয়ে গ্র্যাজুয়েটের বাড়ি। তা বলে সেই পরিবারের অন্য মেয়েদের লেখাপড়া সহজ হয়নি।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৬ ০০:০০
Share:

উত্তর প্রদেশের ছোট্ট শহর রুদৌলি। তার প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট সাফিয়া আখতার, কবি-গীতিকার জাভেদ আখতারের মা। তল্লাটের লোকেরা দেখিয়ে দিতেন, ওই মেয়ে গ্র্যাজুয়েটের বাড়ি। তা বলে সেই পরিবারের অন্য মেয়েদের লেখাপড়া সহজ হয়নি। সাফিয়ার ভাইঝি জারিনা প্রতি স্কুলবর্ষের শেষে ভয়ে থাকতেন, পরের বছর ফিরতে পারবেন কিনা। বড়দের মুখে মুখে কথা বলার জন্য হরবখত বকুনি-খাওয়া মেয়েটির জীবনে তিনটে স্বপ্ন ছিল। এক, যিনি বই লিখেছেন, এমন কোনও শিক্ষকের কাছে পড়া। দুই, গাড়ি চালানো। তিন, সাঁতার কাটা। শেষেরটা সত্যি হয় ৫১ বছর বয়সে। দ্বিতীয়টা ৪২ বছরে। কুড়ি বছর বয়সে হাতের মুঠোয় আসে প্রথম স্বপ্ন, যখন লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকসে সমাজতত্ত্ব নিয়ে পড়তে শুরু করেন জারিনা।

Advertisement

পঞ্চাশের দশকের লন্ডনও খুব সুবিধের ছিল না। মাসিক কিস্তিতে একটা টাইপরাইটার কিনতে চাইলে জারিনাকে বলা হয়, ঋণ নিতে হবে স্বামীর নামে। তিনি রোজগেরে, স্বামী বেকার, তবুও। শেষে এক বন্ধুর থেকে ধার করে সেকেন্ড হ্যান্ড টাইপরাইটার কিনলেন জারিনা। টাইপিস্টের প্রথম চাকরি চিনে নিউজ এজেন্সিতে। কিছুদিনের মধ্যেই সেটি গেল। তাঁর গর্ভাবস্থা স্পষ্ট, অথচ আঙুলে বিয়ের আংটি নেই, নিকাহ্-এর সার্টিফিকেটও নেই। কমিউনিস্টরা এমন মেয়ে রাখে না। ‘‘যদি সত্যি অবিবাহিত মা হতাম, তা হলেও কমিউনিস্টদের থেকে আর একটু সহায়তা আশা করা যেত,’’ লিখছেন জারিনা।

জারিনার জন্ম ১৯৩৩ সালে। সে সময়ে মেয়েরা নিজেদেরও জানতে দিতে চাইত না, তারা পুরুষদের সমান হতে চায়। জারিনার স্কুল-শিক্ষিকা পিসিরা যেমন বোরখা না পরলে বকাবকি করতেন তাঁকে। যে মেয়েরা শিক্ষায়, রোজগারে টেক্কা দিয়েছেন পুরুষদের, তাঁরাও ধন্যি-ধন্যির চাইতে ছি-ছি শুনেছেন বেশি। অপরাধবোধে ভুগেছেন। তাই নারী আন্দোলনের সহজ পাঠ হয় না। কার সঙ্গে কার যুদ্ধ, কবে কে জিতল, জিতে কী পেল, এই ছকে এ লড়াইকে ফেলা মুশকিল। তাই ইতিহাসের কাজটা খানিক চালাতে হয় আত্মকথা দিয়ে।

Advertisement

জীবনীতে ‘বক্তব্য রাখা’-র ঝোঁকটা কম। জারিনা বাবা-ভাই-বোনদের সঙ্গে বসে আম খাওয়া, কার্ফু-কবলিত ঢাকায় জামদানি কেনার গল্প লিখেছেন। সেই সঙ্গে মেয়ের সামনে স্বামীর হাতে মার খাওয়ার লজ্জা, আবার ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক নারী সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার গর্ব। যেমন বাঁচি, তেমন লিখি। এ যেন রোদ্দুরে কাপড় মেলার মতো করে সবার সামনে নিজের জীবনটি মেলে দেওয়া। হোক একটু সুতো-ওঠা, একটু রঙ-জ্বলা, তবু এর প্রতিটি ফোঁড় আমার, নইলে আমার ভাগ্যের।

সুখ-দুঃখের গল্প করার ধাঁচে লেখা হলেও, এই স্মৃতিকথা জরুরিও বটে। ফুলরেণু গুহ, বীণা অগ্রবাল, জারিনা ভাট্টি, এলা ভট্ট, নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবকী জৈন, এঁরা সেই প্রজন্মের মেয়ে যাঁরা তাঁদের (বহু বাধা-ডিঙানো) উচ্চশিক্ষা কাজে লাগিয়েছিলেন দেশের মেয়েদের হকিকত বুঝতে। ফুলরেণু-বীণার নেতৃত্বে ‘স্টেটাস অব উইমেন রিপোর্ট’ (১৯৭৪) থেকে এলা ভট্টের নেতৃত্বে ‘শ্রমশক্তি রিপোর্ট’ (১৯৮৮) সকলের চোখ খুলে দেয় মেয়েদের সম্পদহীনতা, শক্তিহীনতার প্রতি। জারিনার কাজ ছিল বিড়িশিল্পের মেয়েদের নিয়ে (১৯৮৭)। এই সব গবেষণায় স্পষ্ট হল, রাষ্ট্র কতটা পুরুষতান্ত্রিক। সামাজিক বনসৃজনের সরকারি প্রকল্পে যুক্ত হয়ে জারিনা যেমন দেখেছিলেন, মেয়েদের জন্য বন দফতরের চাকরি থাকলেও তার বিজ্ঞাপন দেওয়া হত দফতরের নিজস্ব গেজেটে, যা কোনও মেয়ের চোখে পড়বে না। জারিনার ধমকে সাধারণ কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে ১২০০ আবেদন এল মেয়েদের থেকে।

জারিনা প্রান্তিকদের মধ্যেও প্রান্তবাসী। সংরক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে, মুসলিম স্বামীকে ডিভোর্স করে বিয়ে করেন খ্রিস্টানকে। বিত্তবান পরিবারে, দিল্লির ‘এলিট’ সমাজেও যে প্রেজুডিস কী ভাবে কাজ করে, তা বড় সুন্দর ধরা পড়েছে জারিনার জীবনে। অন্য ধর্মে বিয়ে করায় কলেজের চাকরি গিয়েছিল তাঁর। কে ভেবেছিল, এম এন শ্রীনিবাসনের মতো মানুষ, বর্ণব্যবস্থার গতি-প্রকৃতি খোলসা করার জন্য যিনি প্রাতঃস্মরণীয়, তাঁকে মুসলমান-বিদ্বেষ, নারী-বিদ্বেষের জন্য মনে রাখবেন জারিনার মতো ছাত্রী? এক দিকে প্রতিষ্ঠানকে আঘাত করেন যিনি, তিনিই আবার অন্য দিকে তাকে পোক্তও করেন। মেয়েদের লড়াই তাই সহজে শেষ হওয়ার নয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement