Ratnakar Matkari

অচেনা ভয়, অজানা অস্বস্তি, অদ্ভুত জগতে নিয়ে গেলেন পড়শি লেখক

স্বপ্ন নিয়ে এমন কাহিনি সত্যিই থমকে দেয় পাঠককে। লেখক রত্নাকর মটকারি। মরাঠি সাহিত্যের এক জনপ্রিয় নাম।

Advertisement

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২১ ১৩:০৭
Share:

ভয়, অস্বস্তি আর অচেনা অনুভূতির এক ছায়াজগৎ গোটা বই জুড়ে।

মহারাষ্ট্রের এক মফস্‌সল শহরে বেড়ে ওঠা এক সাধারণ মেয়ে। বাড়ি থেকে চাইল তার বিয়ে দিতে। শুরু হল সম্বন্ধ দেখা। মেয়েটির ইচ্ছে, বম্বে (তখনও ‘মুম্বই’ হয়নি)-র মতো কোনও বড় শহর নয়, অন্য কোনও ছোট শহরেই বিয়ে হোক তার। পাত্র পাওয়া গেল নাসিকে। স্থানীয় এক কলেজের অধ্যাপক। বিয়ের দিন স্থির হল। মেয়েটি শ্বশুরবাড়ির বর্ণনা শুনে কল্পনার জাল বুনতে শুরু করেছে। মনে মনে সে যেন সেই বাড়িরই বাসিন্দা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বিধি বাদ সাধলেন। বিয়ের ক’দিন আগে পাত্রের এক ঘনিষ্ঠা আত্মীয়ার মৃত্যু হল। বিয়ে পিছিয়ে গেল। পরে আবার স্থির হল দিন। কিন্তু এ বারেও বিধি বাম। বিয়ের ঠিক তিন দিন আগে এক দুর্ঘটনায় পাত্রের পা ভাঙল। আবার মুলতুবি বিয়ে। এ বার আর পাত্রপক্ষ গা করল না সম্বন্ধটা এগিয়ে নিয়ে যেতে। মেয়েটির সঙ্গে শেষ পর্যন্ত বিয়ে হল না নাসিকের সেই পাত্রের। পরে মেয়েটির বিয়ে হয় বম্বেতে। আর জানা যায় নাসিকের সেই পাত্রেরও বিয়ে হয়ে গিয়েছে অন্যত্র।

Advertisement

সময় গড়ায়। মেয়েটি বম্বেতেই সুখী বিবাহিত জীবন যাপন করে। একটি সন্তানও হয় তার। এমন সময়ে হঠাৎই এক রাত্রে ঘুমের মধ্যে মেয়েটি স্বপ্ন দেখে সেই নাসিকের না-হওয়া শ্বশুরবাড়ির। তার পর থেকে প্রতি রাতেই একই স্বপ্ন তাকে তাড়া করে বেড়ায়। সে ঢুকে পড়ে সেই বাড়ির ভিতর। এ ঘর সে ঘর ঘুরে বেড়ায়। বাড়ির সামনের জমিতে টাঙানো একটা দোলনায় বসে সে দোল খায়। এ ভাবেই প্রতিদিনের স্বপ্নে সেই না-হওয়া শ্বশুরবাড়ির প্রতিটা আনাচ-কানাচ তার চেনা হয়ে গেল। নাসিকের সেই অধ্যাপকও তখন বিবাহিত, তাঁর সন্তানাদিও হয়েছে। এ ভাবেই কেটে গেল অনেকগুলো বছর। মেয়েটির কন্যা এখন বিবাহযোগ্যা। তার সম্বন্ধ দেখার সুবাদেই নাসিকের সেই পরিবারের সঙ্গে আবার যোগাযোগ হল মেয়েটির। স্বামী-সহ সে গেল সেই না হওয়া শ্বশুরবাড়িতে। তাকে দেখে সেই বাড়ির মানুষরাও চমকিত। তার ছায়াশরীর তারা দীর্ঘকাল ধরেই দেখে চলেছে, তাকে তারা এক নিরীহ প্রেতাত্মা বলেই মনে করে। এই কাহিনির শেষে রয়েছে আরও এক মোচড়। সে কথা এখন থাক।

স্বপ্ন নিয়ে এমন কাহিনি সত্যিই থমকে দেয় পাঠককে। লেখক রত্নাকর মটকারি। মরাঠি সাহিত্যের এক জনপ্রিয় নাম। ২০২০ সালেই ৮১ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন রত্নাকর। তাঁর পরিচিতি মূলত নাট্যকার হিসেবে। ৩৩টি নাটকের রচয়িতা তিনি। এর বাইরে ৩টি উপন্যাস, ১৮টি গল্পগ্রন্থ এবং একটি কাব্যগ্রন্থ তিনি লিখে গিয়েছেন। শিশু সাহিত্যিক হিসেবেও রত্নাকর জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর বহু বিচিত্র সাহিত্য সম্ভারের মধ্যে থেকে ১৮টি গল্প বেছে নিয়ে একটি অনুবাদ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯-এ। বলতে গেলে এটাই রত্নাকরের একমাত্র অনূদিত সংকলন। ‘ডার্কনেস’ নামের এই সংকলনটি অনুবাদ করেছেন বিক্রান্ত পান্ডে। অত্যন্ত সাবলীল অনুবাদ। এই বইয়ের১৮টি গল্পেরই বিষয় অতিপ্রাকৃত। সোজা কথায় যাকে ‘ভূতের গল্প’ বা ‘ভয়ের গল্প’ বলে এই বই ঠিক তেমনটা নয়। উপরে বর্ণিত ‘সুইং’ নামের কাহিনিটিই তার প্রমাণ।

Advertisement

রত্নাকর মটকারি (১৯৩৮-২০২০)

স্বপ্ন নিয়ে আরও কিছু কাহিনি লিখেছিলেন রত্নাকর, যা একই রকমের চমক বহন করে। এক দিক থেকে দেখলে এ ধরনের কাহিনি ভয়ের চাইতে অস্বস্তিকেই বেশি করে সামনে নিয়ে আসে। স্বপ্নের জগৎটা কতটা প্রসারিত? স্বপ্নের মধ্যেই কি মানুষ পেতে পারে নিগূঢ় কোনও সংকেত, যা তার মৃত্যুকেও নির্ধারণ করে দেয়? এমনই অস্বস্তির কাহিনি ‘বাই দ্য ক্লক’। মৃত্যু নিয়েও অত্যন্ত অস্বস্তিকর কাহিনি লিখে গিয়েছেন রত্নাকর। ‘বার্থডে’ নামের গল্পটিতে ঊঠে আসে এক বালক, যে কিনা কারোর জন্মতারিখ জানতে পারলে তার মৃত্যুদিন বলে দিতে পারে। যে রাস্তায় হেঁটেছে রত্নাকরের অতিপ্রাকৃত কাহিনিমালা, সেই রাস্তার অনেকটাই ভারতীয় সাহিত্যে তেমন দৃশ্যমান নয়। যেমন , প্যারালাল ইউনিভার্স নিয়ে তাঁর ভাবনা একেবারেই অনন্য বলে মনে হয় ‘দ্য লস্ট চাইল্ড’ নামের গল্পটি পড়লে। পরিণতি না পাওয়া প্রেম অন্য এক ভুবনে কিন্তু পরিণতি পেয়েছে। সেখানে অন্য এক জীবন যাপন করেন কাহিনির প্রধান চরিত্র। একদিন হঠাৎই সেই জগৎ থেকে এসে হাজির হয় তাঁর সন্তান। অশুভ কামনা কি সত্যিই কাজ করে? কোনও ‘কালাজাদু’ নয়, নিছক অনিষ্টকামনাই কি কাউকে ঠেলে দিতে পারে মৃত্যুর দিকে? মানব মনস্তত্ত্বের এক ধূসর এলাকা নিয়ে লেখা ‘প্রেয়ার’ গল্পটি। এখানে অবশ্যই জন্ম নেয় ভয়, লহমায় অচেনা হয়ে যায় পাঠকের চেনা পরিমণ্ডল।

'ডার্কনেস': অন্য মার্গের অলৌকিক

এ ভাবেই রত্নাকরের এই গল্প সঙ্কলনটি পাঠককে পরিচিত করায় এমন এক ধারার সঙ্গে, যাকে এক কথায় ‘হরর’ বা ‘আনক্যানি’ বলে দাগিয়ে দেওয়া যায় না। প্রথাগত ভূতের গল্পও এই সংকলনে কিছু রয়েছে। কিন্তু সে সবকে ছাপিয়ে যায় ব্যাখ্যাতীত রহস্য নিয়ে লেখা গল্পগুলি। বাংলা অতিপ্রাকৃত সাহিত্যে এই ধরনের ব্যাখ্যাতীতের জায়গা খুব বেশি নয়। সত্যজিৎ রায়ের কলমে এ ধরনের কাহিনি কিছু রয়েছে। রত্নাকরের কলম কিন্তু সত্যজিৎ-ধারার বাইরে। বিক্রান্তের অনুবাদে পরিচয় পাওয়া গেল এক তুখোর গল্প-কথকের। বইটি প্রকাশ করেছে হার্পার কলিন্স পাবলিশার্স ইন্ডিয়া।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement