শ্রীক্ষেত্র পুরী, জগন্নাথদেবের মন্দির, তার রথযাত্রা— সব মিলিয়ে এক আশ্চর্য ঐতিহ্য। হয়ত বা হাজার বছর পেরিয়েও একান্ত সজীব। বিশ্বাসীর মন প্রশ্নহীন, কিন্তু গবেষকরা যথারীতি এর মধ্যে ধর্ম সমাজ নৃতত্ত্ব লোকাচারের নানা জটিল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত। বস্তুত, আদি-মধ্য যুগের সূচনাতেই ধ্রুপদী
দ্য কাল্ট অব জগন্নাথ অ্যান্ড
দ্য রিজিওনাল ট্র্যাডিশন অফ ওড়িশা,
সম্পা: অ্যানশার্লট এশমান,
হেরমান কুলকে ও গয়াচরণ ত্রিপাঠী। মনোহর, ৩৫০০.০০
হিন্দুধর্মের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের নানা প্রান্তের আঞ্চলিক ধর্মবিশ্বাস ও লোকাচারের সংযোগ ও সংঘাত ঘটছিল। তার ফলে সৃষ্ট নতুন নতুন আঞ্চলিক কাল্টের মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বোধহয় ওড়িশার জগন্নাথ কাল্ট— তাতে যেমন প্রাচীন ধর্মাচারের বহু বিচিত্র নিদর্শন থেকে গিয়েছে, তেমনই বর্তমান কাল পর্যন্ত ছেদহীন ধারাবাহিকতায় তার বিকাশ-বিস্তার ধরে রেখেছে পূর্ব ভারতের বিস্ময়কর লোক-ঐতিহ্য। জগন্নাথ কাল্ট ঘিরে তৈরি হয়েছে হাজারো কথা ও কাহিনি, ইতিহাসের কাঠামো জীর্ণ করে নিশ্ছিদ্র হয়ে উঠেছে উপকথার আচ্ছাদন। যুগ যুগ ধরে সারা দেশের তীর্থযাত্রীরা সেই সব উপকথা বহন করে নিয়ে গিয়ে ছড়িয়ে গিয়েছে দূর-দূরান্তে। এর সঙ্গে শ্রীচৈতন্যের যোগসূত্র নিয়ে এসেছে ভিন্নতর মাত্রা।
ওড়িশা তথা ভারতের সংস্কৃতিতে জগন্নাথ কাল্ট-এর এই আশ্চর্য ব্যাপ্তি ও গভীরতা আরও অনেকের মতোই জার্মান পণ্ডিতদের আকৃষ্ট করেছিল। তারই ফল দুই পর্যায়ে ‘ওড়িশা রিসার্চ প্রজেক্ট’। প্রথম দফার (১৯৭০-’৭৫) ফল প্রকাশিত হয় ’৭৮-এ, প্রকাশের পরেই সংকলনটি আকরগ্রন্থের মর্যাদা পায়। তা যে ৩৭ বছরেও অটুট, সে কথা বোঝা গেল দ্বিতীয় দফার (১৯৯৯-২০০৫) গবেষণার পরেও এটির সংশোধিত-পরিবর্ধিত সংস্করণের প্রকাশে। ২৭টি প্রবন্ধের এই সংকলনে এ বারের সংযোজন তিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ: রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ও পুরীতে জগন্নাথদেবের দারুমূর্তির প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত কাহিনির উৎস ও বিশ্লেষণ নিয়ে দুটি, এবং পুরীতে তীর্থযাত্রা নিয়ে একটি নতুন প্রবন্ধ। জীবিত লেখকরা অনেকেই পূর্ব প্রকাশিত প্রবন্ধের পরিমার্জন করেছেন। আলোচনায় এসেছে ওড়িশায় বৈষ্ণবধর্মের আদি পর্ব, প্রাচীন জগন্নাথ মন্দির, জনজাতীয় দেবদেবীদের হিন্দু ঐতিহ্যে অন্তর্ভুক্তি, রাজকীয় পৃষ্ঠপোষণা, নবকলেবর, প্রাত্যহিক পূজার্চনা, চৈতন্যদেব, ওড়িয়া জাতীয়তাবাদ, মহিমা ধর্ম, পুরীর ধর্মীয় অর্থনীতি ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ, যা জগন্নাথের ঐতিহ্য বুঝতে অপরিহার্য। আছে বহু দুর্লভ ছবিও।