জীবনের স্মৃতিদীপে
রমেশচন্দ্র মজুমদার
২৫০.০০, পারুল
‘‘বল্লাল সেন যে কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তিত করেছিলেন আমাদের বংশ সেই প্রথা অনুসারে কুলীন বলে পরিচিত।’’ স্মৃতিকথার প্রথম পাতাতেই লিখছেন রমেশচন্দ্র মজুমদার। কুলগ্রন্থকে ইতিহাস বলে স্বীকার না করলেও ‘‘মধ্যযুগের ইতিহাসের কিছু উপকরণ’’ তার মধ্যে থাকতে পারে বলে মনে করতেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিস্টরি অব বেঙ্গল থেকে শুরু করে চার খণ্ডে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা ও ভারতীয় বিদ্যাভবনের এগারো খণ্ড ভারতের ইতিহাস সম্পাদনা, সিপাহি বিদ্রোহ আর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনা তাঁর প্রধান কীর্তিগুলির অন্যতম। তাঁর স্মৃতিকথনে উঠে এসেছে বিশ শতকের একটা বড় পর্বের ইতিহাস, এবং প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসচর্চার সূচনাকালের নানা ঘটনা। তাঁর ঢাকার স্মৃতি বিশেষ করে উল্লেখের দাবি রাখে। বিতর্ক তিনি এড়িয়ে যাননি, তাই ‘বাংলার বাঘ’ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় থেকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মদনমোহন মালবীয়ের পুত্র গোবিন্দ মালবীয়, হুমায়ুন কবির, সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ, তারাচাঁদ— অনেককে নিয়েই আছে সোজাসাপ্টা মন্তব্য। চার দশক পর বইটি সুমুদ্রণে ফের সুলভ হল, ইতিহাস-অনুরাগীদের কাছে নিশ্চয়ই আনন্দ-সংবাদ।
উনিশ শতকের বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়/ ইতিহাস জাতীয়তাবাদ সমাজজীবন
নির্মল বন্দ্যোপাধ্যায়
৬০০.০০, সপ্তর্ষি প্রকাশন
অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে ঊনবিংশ শতকের শেষাবধি বঙ্গরঙ্গমঞ্চের সাফল্য-অসাফল্য ঘিরে যাবতীয় বাদানুবাদ বা তর্কবিতর্ক রীতিমতো আলোড়ন তুলত শিক্ষিত বাঙালির মনে। আর সে আলোড়ন বা আন্দোলন প্রচারিত হত ইংরেজি ও বাংলা সংবাদপত্র এবং সাময়িকপত্র মারফত। এবং তা ক্রমাগত ঋদ্ধও করত রঙ্গমঞ্চের ক্রমবিকাশকে। কিন্তু এই সব নাট্যবিষয়ক আলোচনা বা সংবাদকে ঠাঁই দেওয়ার মতো কোনও নাট্যপত্রিকা ছিল না— ‘‘বাংলা থিয়েটার এক তীব্র ঘাত-প্রতিঘাতময় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন সৃষ্টি করলেও তার তরফে থিয়েটার-সংক্রান্ত ইতিহাসের উপাদানস্বরূপ কেবল নাট্যবিষয়ক পত্রিকার কথা কারও মাথায় উদিত হয়নি।’’ জানিয়েছেন লেখক। সে সময়ের রুচি, সামাজিকতা, রাজনৈতিক মানসিকতা, সর্বোপরি জাতীয়তাবোধ সম্পর্কে যে মস্ত বড় এক পরিচয়ক্ষেত্র নিরন্তর তৈরি হয়ে চলেছিল বাংলা থিয়েটারে, তার ইতিহাস অরচিতই থেকে গিয়েছিল তৎকালীন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্বদের ইতিহাসবোধের অভাবে। অথচ লেবেদফের ‘বেঙ্গলি থিয়েটার’ (১৭৯৫) থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত গোটা উনিশ শতক জুড়ে, বিশেষত ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’-সহ (১৮৭২) যা যা নাট্যশালা স্থাপিত হয়েছে, সে সবের মূল অভিপ্রায়ই ছিল নাট্যাভিনয়ের ভিতর দিয়ে জনমানসে জাতীয় ভাবের বীজ বুনে দেওয়া। এই ধারাবাহিক দ্বান্দ্বিক ইতিহাসই জীবন্ত হয়ে ফুটেছে লেখকের কলমে। ‘‘বাংলা নাট্যবিষয়ে এমন একটি বিস্তৃত ইতিহাস ও তথ্যনির্ভর, যুক্তিশৃঙ্খলা এবং বিশ্লেষণমূলক আলোচনা বা গ্রন্থ আমার চোখে অন্তত পড়েনি।’’ বইটি সম্পর্কে মুখবন্ধ-এ মন্তব্য বিভাস চক্রবর্তীর।
‘প্রবাসী’র নাট্যচর্চা
সম্পাদক: শম্পা ভট্টাচার্য
৩০০.০০, পত্রলেখা
বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে গত শতকের ‘প্রবাসী’ পত্রিকার গুরুত্ব অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথ ও অন্য প্রথিতযশা লেখকরা ‘প্রবাসী’কে রসদ জুগিয়েছেন নিরন্তর। সূচনা (১৯০১) থেকেই বরাবর বাংলা তথা ভারতের রাজ্য-রাজনীতি, স্বাধীনতা আন্দোলনের রেখাচিত্র, গরিমাময় মুহূর্ত, রাজনৈতিক দলাদলির কলঙ্কিত নানা অধ্যায়— সবই প্রতিফলিত হয়েছে ‘প্রবাসী’র বিভিন্ন সংখ্যায়। আলোচ্য সংকলনটিতে বিধৃত হয়েছে দীর্ঘ সময়ে বাঙালির নাট্য ভাবনা ও নাট্যচর্চার বৃত্তান্ত। এমনকি চিন দেশের থিয়েটার, বিলাতি থিয়েটার, যবদ্বীপ, বলি দ্বীপের নাট্যচর্চা, ভিয়েনার ছায়ানাট্য, জাপানের থিয়েটার, জার্মান শ্রমজীবীর নাট্য আর বিদেশি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের থিয়েটার চর্চার নানান খবর। ‘প্রবাসী’র ৬৫ বছরের প্রকাশনায় বাংলার নাট্যচর্চায় পালাবদল ঘটেছে একাধিক বার। সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় গিরিশচন্দ্র, অমৃতলাল বসু, অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল এমনকি শিশির ভাদুড়ীর অভিনয় কাল প্রত্যক্ষ করেছেন। বাংলার পেশাদার নাট্যজগতের রমরমার সেই দিনগুলিতে স্টার, ক্লাসিক, এমারেল্ড আর মিনার্ভা থিয়েটারে উপচে পড়ত ভিড়। তবু সংস্কৃতি চর্চার এই একটি প্রবাহ সম্পর্কে ঔদাসীন্য লক্ষিত হয় ‘প্রবাসী’তে। গিরিশচন্দ্রের মৃত্যুর পর ১৩১৮-র চৈত্র সংখ্যায় ‘প্রবাসী’র অকপট কথন— ‘‘গিরিশচন্দ্র ঘোষ একজন সুপরিজ্ঞাত নাটককার ও অভিনেতা ছিলেন। আমরা তাহার কোনো নাটক পড়ি নাই, বাংলা নাটকাভিনয় দেখিবার জন্য কোনও থিয়েটারে কখনও যাই নাই। এই জন্য প্রত্যক্ষ জ্ঞান হইতে তাঁহার সম্বন্ধে কিছু বলিতে পারিলাম না।’’