ঐতিহাসিক। ১৯১১-র আইএফএ শিল্ডজয়ী মোহনবাগান ফুটবল দল।
সংসারের ভাঁড়ে মা ভবানী, নগদ টাকার অভাবে নাভিশ্বাস উঠছে, এই অবস্থাতেও শুধু বিরাট কোহলির কাছ থেকে বেঁচে থাকার রসদটুকু ধার করে কোনও মতে চালিয়ে দিচ্ছি আমরা, এ ভারতবর্ষ ছাড়া আর কোথায় সম্ভব? তবু এ দেশের ইতিহাসবিদরা— সাম্প্রতিক কালের দু-এক জনকে বাদ দিলে— খেলাধুলোর ইতিহাসকে বেশি আমল দেননি কোনও দিন, বরাবরই কৃষকচৈতন্য ধরনের গেরামভারি জিনিসপত্র নিয়ে তাঁরা বেশি ব্যস্ত। রণজয় সেনের এই বই বোঝাল, সেই জমানা শেষ হওয়ার সময় এসেছে। তাঁর বইয়ে অজানা তথ্যের, ঘটনার ঘনঘটা। কে জানত, ফ্লাডলাইটের কয়েকশো বছর আগেই মুঘলরা রাতে পোলো খেলার সময় মাঠ আলো করার ব্যবস্থা করত পলাশ কাঠের তৈরি খেলার বলে আগুন জ্বালিয়ে? কে জানত, এমসিসি-র মাত্র ছ’বছর পরেই বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম ক্রিকেট ক্লাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব, আর ১৭৯২ সালে তার খেলোয়াড়রা মাঠে নামবে ব্যারাকপুর আর দমদমের সঙ্গে, ঠিক যখন ফরাসিরা এক বিপ্লব-উত্তাল দেশে ঘোষণা করছে প্রজাতন্ত্র?
নেশন অ্যাট প্লে: আ হিস্ট্রি অব স্পোর্ট ইন ইন্ডিয়া। রণজয় সেন। পেঙ্গুইন/ ভাইকিং, ৫৯৯.০০
ফুটবলে লাথি মেরেছিলেন প্রথম যে ভারতীয়, তিনি উচ্চপদস্থ চিকিৎসক নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী, সে আমরা জানি। কিন্তু জানি না যে হেয়ার স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে চাঁদা তুলে খেলার সরঞ্জামের দোকান ম্যান্টন অ্যান্ড কোম্পানি থেকে তিনি ভুল করে ফুটবল ভেবে কিনে আনেন রাগবি বল। তাঁর নেতৃত্বেই সাহেবদের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলার অধিকার প্রথম অর্জন করে শোভাবাজার ক্লাব, ১৮৯২ সালে প্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসেবে কোনও ব্রিটিশ দলকে হারায়ও তারা (ইস্ট সারে রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে ২-১)। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের শৈশবকালে এই সব খুচরো জয় নিয়ে তত হইচই হয়নি, যেমন হয়েছিল ১৯১১ সালের আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে মোহনবাগানের ঐতিহাসিক জয় উপলক্ষে। অমৃতবাজার থেকে বেঙ্গলি, বসুমতী থেকে ইংলিশম্যান— সবাই সদর্পে ঘোষণা করল, কে বলে বাঙালি দুবলা-পাতলা, পিলের জ্বর আর পান্ডুরোগে ভোগে; এই তো সময় এসে গিয়েছে সাহেবদের ‘frown for frown and blow for blow’ ফিরিয়ে দেওয়ার! গল্প আছে, ম্যাচ শেষ হওয়ার পরেই জনৈক সমর্থক মোহনবাগান ক্যাপ্টেন শিবদাস ভাদুড়িকে জিজ্ঞেস করেন— মাঠে তো সাহেবদের হারানো গেল, কিন্তু ফোর্ট উইলিয়াম থেকে ইউনিয়ন জ্যাক নামানো যাবে কবে? শিবদাসের উত্তর: কেন, এর পরের বার মোহনবাগান যখন শিল্ড জিতবে? কিমাশ্চর্যম্! সেই দ্বিতীয় শিল্ড-বিজয় ঘটবে ১৯৪৭ সালেই, আর মোহনবাগানের সঙ্গে বাঙালি তথা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অনুষঙ্গও জড়িয়ে যাবে বরাবরের মতো।
এই জাতীয়তাবাদের জয়যাত্রা অবাধ ছিল না। তিরিশের দশকেও বোম্বাইয়ের জনপ্রিয় পেন্টাঙ্গুলার ক্রিকেট টুর্নামেন্টে যোগ দিত হিন্দু, মুসলিম, ইয়োরোপীয়, পার্সি, খ্রিস্টান ইত্যাকার সাম্প্রদায়িক দল। বিশ্বযুদ্ধ বাধার অব্যবহিত পরে খোদ গাঁধীকেই যখন জিজ্ঞেস করা হল, পেন্টাঙ্গুলার চালু রাখা উচিত কি না; মহাত্মা স্বভাবসিদ্ধ নির্বেদের সঙ্গে জানালেন, যুদ্ধে মানুষ মরছে শুধু সে কারণেই নয়, সাম্প্রদায়িকতার মতো ‘অখেলোয়াড়ি’ জিনিসের অনুপ্রবেশ খেলার ময়দানে ঘটবে কেন? বাপুর উপর আর কথা চলে না, তাই সে টুর্নামেন্ট সে বছরকার মতো বন্ধ হল বটে, কিন্তু ইতিমধ্যে কলকাতার ফুটবল ময়দানে জাঁকিয়ে বসেছে মহমেডান স্পোর্টিং। ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮-এর মধ্যে তার টানা পাঁচ বার লিগ জয়ের গৌরবে আচ্ছন্ন হল বাংলার মুসলিম সমাজ, প্রতিটি জয়ের পর ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনির পাশাপাশি ছড়া লেখা হল: ‘মহমেডান স্পোর্টিং তুমকো লাখোঁ লাখোঁ সালাম/ হাম আব দেস কা বাদশা বনে, ঔর সব হ্যায় গুলাম।’ চল্লিশের দশকে সাম্প্রদায়িকতার বীজ দ্রুত মহীরুহ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ময়দানের লড়াই চারিয়ে গেল দাঙ্গার হিংস্রতার মধ্যে। সাম্রাজ্যবাদ, জাতীয়তাবাদ তথা সাম্প্রদায়িকতা আর জাতপাতের রাজনীতির ইতিহাসের সঙ্গে এ ভাবেই ওতপ্রোত হয়ে থাকে খেলাধুলোর ইতিহাস; সেই সম্পর্কটিকে অতি যত্নে বিবৃত করেছেন রণজয়।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এশীয় উপনিবেশগুলির মধ্যে প্রথম ভারতই স্বাধীনতার প্রায় দু’দশক আগেই হকিতে জাতীয় দল গড়ে অলিম্পিকে পাঠায়, সে তো আমরা জানিই। যা ভুলে যাই, তা হল, কত অর্থকষ্ট সহ্য করে ক্রীড়ামোদী দেশীয় নৃপতিদের আনুকূল্যে সেই দলের অলিম্পিক যাওয়া চলত। ১৯৩২-এ অলিম্পিকের দ্বিতীয় স্বর্ণপদকটি জেতার খবর টাইমস অব ইন্ডিয়া-তে বেরিয়েছিল নেহাতই নমো নমো করে, পাশেই বড় করে বেরোয় ক্রিকেটদলের ইংল্যান্ড সফরে সমারসেটের বিরুদ্ধে জেতার খবর। রণজয় জানিয়েছেন, যেখানে রাজারাজড়াদের অনুগ্রহধন্য ক্রিকেট খেলায় নানান কূটকচালি আর ফন্দিফিকির সব সময়েই চলত, সেখানে সেনাবাহিনী আর অ্যাংলো ইন্ডিয়ান খেলোয়াড়দের মধ্যে অতি জনপ্রিয় হকি খেলায় সাম্য ও দলগত ঐক্য ছিল অনেক বেশি। কুস্তিগিরদের নিয়ে লেখা পরিচ্ছেদটি অতি সুপাঠ্য। সেখানে দেখানো হয়েছে, পালোয়ান গুলাম মহম্মদ ওরফে গামা কী ভাবে বিশ শতকের প্রথম দিকে হয়ে উঠেছিলেন একটি দেশের জনসাধারণের শারীরিক সক্ষমতার প্রতীক, তিনিই আবার দেশভাগের পর পাকিস্তানে গিয়ে বিস্মৃত, হতদরিদ্র অবস্থায় মারা যান ১৯৬০ সালে। এর পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবার থেকে উঠে-আসা বাঙালির গোবর গুহ, এক শাকরেদ আর পাঁচ ডলার সঙ্গে নিয়ে যিনি ১৯২১ সালে আমেরিকায় হাজির হন, আর পরের এক বছর ধরে নানান লড়াই জিতে মার্কিন মুলুকে তুমুল খ্যাতি অর্জন করেন। কিন্তু কে জানত, ১৯২৬ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভারতে ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে বক্তৃতা করছেন ডাকসাইটে প্রফেসর চার্লস সিসন, তখন শ্রোতাদের মধ্যে থেকে বাঘা-বাঘা প্রশ্ন ছোড়েন এই গোবরই। কই, মিউটিনির পর সাম্য ও সমানাচরণের এত ব্যান্ড বাজিয়ে মহারানি যে ঘোষণা করলেন তাঁর প্রোক্ল্যামেশন, তার প্রতিশ্রুতি পূরণের কী হল? সায়েব, বলা বাহুল্য, নিরুত্তর।
স্বাধীন ভারতের খেলাধুলোর ‘অগ্রগতি’র ইতিহাস নিয়ে রণজয়ের বইটির শেষ চারটি অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে হকি, ফুটবল ও ক্রিকেটে জাতীয়, আঞ্চলিক ও ক্লাব দলগুলির সাফল্য এবং ব্যর্থতার আখ্যান, তার পাশাপাশি বিভিন্ন বিরল ব্যক্তিপ্রতিভার টুকরো টুকরো ছবি— যেমন, কুস্তিগির কে ডি যাদব, হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে প্রথম ভারতীয় হিসেবে ব্যক্তিগত পদক পাওয়া সত্ত্বেও রাজ্য পুলিশের চাকরিতে একটি প্রোমোশনের জন্য যাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল বা-ই-শ বছর। অথবা, মহিলা কুস্তিগির হামিদা বানু, পঞ্চাশের দশকে যিনি চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন— যে পুরুষ তাঁকে কুস্তিতে হারাতে পারবেন, বিয়ে করবেন তাঁকেই। কিন্তু হায়, সেই প্রতিস্পর্ধী পাঙ্গা কোনও পুরুষপুঙ্গব নিতে পারেননি।
ভারতের সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি সব কিছু সম্পর্কেই যেমন পশ্চিমিদের এক ধরনের ছাঁচে-ঢালা ওরিয়েন্টালিস্ট বক্তব্য থাকে, খেলাধুলো সম্পর্কেও তার অভাব নেই। ফলত রণজির ব্যাটিং-এ বা ধ্যানচাঁদের কারিকুরিতে দেখা যায় ‘শিল্পের সুষমা’ বা ‘জাদুকরের ভেলকি’, বা প্রসন্ন-বেদির বলের ঘূর্ণিতে ‘সাপের বিষাক্ত ছোবল’-এর থেকেও বেশি করে, ‘প্রাচ্যের দুর্জ্ঞেয় রহস্যময়তা’। অভিনেতা পিটার উস্টিনভ রমেশ কৃষ্ণনের টেনিসের মধ্যে দেখতে পান ‘ভারতীয় জাতিচরিত্রের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ’ এক কোমল অথচ মোক্ষম সম্মোহনী ক্ষমতা, আর দুঁদে ক্রিকেট-লিখিয়ে জন আর্লট লক্ষ করেন কবাডির মধ্যে এক নিহিত জাতীয় দর্শন, যাকে মহিমা দিয়েছে সরল জীবনযাপন এবং উচ্চ চিন্তার এক ভারতীয় সমন্বয়। এ রকম বেশ কিছু নিদর্শন রণজয়ের লেখায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে থাকলেও এই বিষয়টি সম্পর্কে বিশদ বিশ্লেষণ নেই। বস্তুত সেই অর্থে বইটি ভারতে ক্রীড়াচর্চার মৌলিক আকর-নির্ভর, বিশ্লেষণাত্মক সামাজিক ইতিহাস নয়, বরং দুই মলাটের মধ্যে বিভিন্ন খেলার উদ্ভব ও বিবর্তনের এক ঘটনাবহুল তথ্যপঞ্জিকে লিপিবদ্ধ করার প্রয়াস। প্রায় সম্পূর্ণত পূর্বপ্রকাশিত তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে রচিত বইটিকে তাই মৌলিক গবেষণাগ্রন্থ না বলে একটি অতি-জরুরি কম্পেন্ডিয়াম বা অ্যান্থলজি বলা যেতে পারে। হাজার বই-প্রবন্ধ-সংবাদপত্র-জীবনী-আত্মজীবনী-সাহিত্য-পত্রপত্রিকা-বার্ষিকী-স্মরণিকা ঘেঁটে অসীম পরিশ্রমে রণজয় বইটি তৈরি করেছেন। জাতীয়তাবাদ, জাতপাত ও সম্প্রদায়ের রাজনীতি, রাষ্ট্রনির্মাণ, কূটনীতি, পণ্যসংস্কৃতি, বিশ্বায়ন, ইত্যাকার নানান ধারার সঙ্গে খেলার ইতিহাসকে সম্পৃক্ত করে দেখেছেন। ফলে ভারতীয় ইতিহাসচর্চায় এই ধরনের ইতিহাস এক নতুন প্রতিষ্ঠা পেল, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। মৌলিকতার দাবি না রাখলেও লেখক সেই কারণেই ধন্যবাদার্হ।