মৃত্তিকার গান
লেখক: লীনা চাকী
১৮০.০০
মনফকিরা
বাংলার লোকসংগীতের রূপ রস ভঙ্গিমা প্রকৃতি পরিবেশ পরিবেশনার প্রয়াস এই বই। যদিও গ্রামীণ সুর-ছন্দের অজস্র আঙ্গিক থেকে কয়েকটি এই আলোচনায় নির্বাচিত হয়েছে। গবেষণার কাঠামোভিত্তিক আলোচনা না হলেও, নানা বিষয় ও শিল্পীর কথালাপ সরল রম্য বর্ণনায় প্রকাশ পেয়েছে ভিন্ন ভিন্ন লেখায়। আছে কবিগান, বাউল, ঝুমুর, ভাদু, টুসু, ভাওয়াইয়া, চটকা, বারোমাস্যা, ভাটিয়ালি, সারি, ঘেঁটু, ময়ূরপঙ্খি, মনসা ও ঝাপান গান আর প্রভাতী ও কীর্তন আঙ্গিকের অন্বেষণ। বোলান, অষ্টক, গম্ভীরার মতো নাট্যধর্মী আঙ্গিকের গানের কথাও আছে। সংবাদপত্রের ধারাবাহিক কলামের এ সব লেখা সংকলিত হয়ে প্রকাশিত মৃত্তিকার গান— তাই লেখা জুড়ে কথালাপের ধাঁচ। যদিও তা একঢালা কথালাপ নয়— লেখক ভেঙে ভেঙে বিষয়কে বুঝিয়েছেন। তাতে সাহায্য নিয়েছেন বিভিন্ন তথ্যসূত্রের। প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতির সঙ্গে লেখক নিজস্ব অভিমত শুনিয়েছেন। আর আছে আলোচনার ধরতাই হিসাবে লোকসুরের নমুনা। বইটি তাই পরিব্রাজনের উত্তাপে ভরপুর না হয়েও বিষয় আর ব্যাখ্যায় বাংলার লোকায়ত কথাসুরের অভিজ্ঞতালব্ধ পরিক্রমা।
ধর্মঠাকুর, শূন্যপুরাণ প্রসঙ্গে
লেখক: বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়
১৭০.০০
লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র
বাংলার রাঢ় অঞ্চলে ধর্মঠাকুর বা ধর্মরাজের পুজোর যে ব্যাপক প্রচলন দেখা যায় তা লৌকিক ধর্মানুষ্ঠান। ধর্মঠাকুরকে বৌদ্ধ মতের ধর্ম এবং এই পুজোর মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের অবশেষ অন্বেষণ করা হত। নানা মত এবং বিতর্কের মধ্যেও গবেষণায় জানা যায় যে, ধর্মঠাকুর মূলত প্রাক্-আর্য জনজাতীয় সংস্কৃতির দেবতা। পরবর্তীতে বৈদিক, পৌরাণিক নানা দেবতার রীতি-বৈশিষ্ট্য মিলেমিশে ধর্মঠাকুরের উদ্ভব। শূন্যপুরাণে বলা হয়েছে, ধর্মঠাকুর হলেন শূন্যমূর্তি, তিনি ‘নিরঞ্জন’, ‘শূন্যদেহ’। তবে যে প্রতীকের পুজো করা হত তা কূর্মাকৃতি পাষাণখণ্ড বা পাথরের তৈরি কচ্ছপ বিগ্রহ। গ্রামদেবতা ধর্মঠাকুরকে ক্রমে ক্রমে হিন্দুসমাজের শিবঠাকুরের পুজোপদ্ধতি আচার-অনুষ্ঠান আত্মকৃত করেছে। এ যাবৎ কমপক্ষে কুড়িজন কবির ধর্মমঙ্গল বা শূন্যপুরাণ কাব্যের পুঁথি আবিষ্কৃত হয়েছে। কাব্যকাহিনির মধ্যে পার্থক্য ঘটেছে, পণ্ডিতদের মধ্যেও মতপার্থক্য প্রচুর। শূন্যপুরাণের দুর্বোধ্যতার মূলে আছে ধর্মঠাকুর পুজোর রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ও বিচিত্র কর্মকাণ্ড। এ সবের নানা মত উল্লেখে, রামাই পণ্ডিত কৃত শূন্যপুরাণের কাব্যরচনার পাঠ ও বিতর্কের নানা দিকে আলোকপাত করেছেন প্রবীণ গবেষক বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়।
শঙ্খচিল
লেখক: সায়ন্তনী পূততুন্ড
২০০.০০
আনন্দ পাবলিশার্স
তেত্রিশের কোঠায় পৌঁছে সায়ন্তনী পূততুন্ড এখন একটি পরিচিত নাম; তাঁর লেখা প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যাও এতদিনে দুই অঙ্ক ছুঁয়েছে— এ ছাড়া, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা তাঁর গল্প ও সেগুলির সংকলন উপরি। এটা অনস্বীকার্য, খ্যাতি অকারণে তাঁর দোরগোড়ায় এসে কড়া নাড়েনি; এক দশক ধরে নিজের পরিশ্রমের ফল সায়ন্তনী এতদিনে হাতেনাতে পাচ্ছেন। ভাল ঔপন্যাসিক হওয়ার, ভাল উপন্যাস লেখার সবকটি গুণ তাঁর কুক্ষিগত ছিলই; পাঠকের পছন্দের বিষয় চয়নের ক্ষমতা থেকে শুরু করে ভাষার সাবলীলতা তাঁকে এই প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। এই বইটিও তার ব্যতিক্রম নয়— এক কথায় বললে সুখপাঠ্য; গল্পটা মন-কেমন-করা হলেও, পড়া শেষ করে ভারি আনন্দ হয়, মনটা তৃপ্তিতে ভরে ওঠে ।
দেশবিভাগ হল এই উপন্যাসের বিষয়, জনর্। কাহিনির ঘটনাস্থল ভারত-বাংলাদেশ ইছামতী নদী-সীমান্তের পাশে এক গ্রাম, মুখ্য পাত্রপাত্রী গ্রামের এক পরিবারের এক ছোট্ট মেয়ে আর বর্ডারে কর্মরত এক জওয়ান। মেয়ের চিকিৎসা করাতে সাতক্ষীরায় না গিয়ে বেআইনি ভাবে টাকিতে আসেন মুনতাসীর চৌধুরী বাদল; সীমান্তের এপারে তিনি বাদল চৌধুরী, স্ত্রী লায়লা হলেন লীলা চৌধুরী। তাঁদের মেয়ে রূপসা চৌধুরীকে টাকির হাসপাতালে ভর্তি করার সময় পরিচয় হিসেবে লেখা হল— কান্ট্রি ইন্ডিয়া, কাস্ট হিন্দু ব্রাহ্মণ ।
দেশভাগের ফলে পারিবারিক যন্ত্রণা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে গল্প-উপন্যাস তো কম নেই; তবু, সায়ন্তনীর সাহসের প্রশংসা করতেই হয় বিএসএফ-এর আইজি-র মুখ দিয়ে যখন তিনি বলান ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তটা ‘শুধু অ্যাবসার্ড নয়, রিডিকুলাসও মনে হয়! জাস্ট একটা নোংরা রাজনৈতিক ঠাট্টা’। (পৃ ৩৫) উপন্যাসটা পুরো মাত্রায় ফিল্মি; গৌতম ঘোষকে উৎসর্গ করাটা যথাযথ। ভাষাও প্রয়োজনে আধুনিক — ‘ডাক্তারদের হেভি অ্যাকশন চলছে’। (পৃ ১২৮)সবশেষে বলি, আমাদের সৌভাগ্য, নতুন প্রজন্মের সায়ন্তনীরা খ্যাতি ও পসারের লোভে ইংরেজির দিকে না ঝুঁকে বাংলায় লিখছেন।