অবরুদ্ধ: মানুষকে ভালবাসার শিক্ষা দিয়েছেন তিনি আজীবন, তবু এখনও মহাত্মা গাঁধীর দেশ তা শিখে উঠতে পারেনি।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজম/ দি এসেনশিয়াল রাইটিংস
সম্পাদক: এস ইরফান হাবিব
৪৯৯.০০
আলেফ বুক কোম্পানি
ছোটবেলায় প্রতি বছর একটা দিন আসত— যে দিন সকলে মিলে দেশের জন্য খুব একটা টান অনুভব করতেন, একেবারে নিখাদ ‘জাতীয়তাবাদ’-এর টান। দিনটা ৩০ জানুয়ারি। বেলা এগারোটা বাজলেই সে দিন সাইরেন বেজে উঠত চার দিকে। শুনে সকলে কেমন যেন নীরব হয়ে যেতেন। কেউ উঠে দাঁড়াতেন। কেউ কাজ করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে যেতেন। — ভূমিকায় এই স্মৃতিচারণ করেছেন এস ইরফান হাবিব, আলোচ্য বইটির সম্পাদক। উপরের বর্ণনাটার পর অত্যন্ত দরকারি একটা বাক্য এল: আজকাল জাতীয়তাবাদের ভরা জোয়ার সব দিকে, কিন্তু ‘এই প্রথাটা আজকাল আর দেখি না কোথাও।’
জাতীয়তাবাদ বলতে কত কী বোঝাতে পারে, তার বেশ বাঙ্ময় ইঙ্গিত রয়েছে এই স্মৃতিচারণের মধ্যে। মহাত্মার মৃত্যু-মুহূর্ত স্মরণ করার মধ্যেই বা এমন কী মাহাত্ম্য, প্রশ্ন তুলতেই পারে কেউ। সে প্রশ্ন তুললে একটা সহজ উত্তর আছে। ‘জাতির জনক’ নামটি প্রতীকী হলেও, এটা তো ঠিক যে জাতি বলতে যদি সামান্য কিছু কখনও থেকে থাকে এই দেশে, এই মানুষটিই প্রথম বার তা কোটর থেকে টেনে বার করে আনতে পেরেছিলেন। অন্তত এইটুকু কারণেই ‘জাতি’রও কিছু দায়বদ্ধতা থাকা উচিত তাঁর ব্যাপারে।
জাতির ভাবনাটা বরাবরই কল্পিত, জাতির সব উল্লেখই প্রতীকী। গাঁধীজিও প্রতীকী, রামজন্মভূমিও প্রতীকী। এক-এক জাতীয়তাবাদ এক-এক প্রতীককে তুলে ধরতে চায়, এক-এক কল্পনাকে মানুষের মনে গেঁথে দিতে চায়। জাতীয়তাবাদ-তর্কবিতর্কের পরিসরে অন্যতম সেরা পণ্ডিত বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের একটা অতি-পরিচিত কথা আবার মনে করি: ‘ন্যাশনালিজম ইজ নট দি অ্যাওকেনিং অব নেশনস টু সেলফ-কনশাসনেস: ইট ইনভেন্টস নেশনস হোয়্যার দে ডু নট এক্সিস্ট।’ এখন, কথা হল, ‘ইনভেন্ট’ বা কল্পনাই যদি করতে হয়, সকলে কি আর তা এক ভাবে করতে পারে? না কি তা করতে চায়? তাই নানা খাতে বইতে থাকে কল্পনার ধারা।— এই রকম একটা ভাবনা থেকেই সম্পাদক স্থির করেন, ভারতের জাতীয়তাবাদ ভাবনার সেই নানা খাতকে ধরে দেওয়া যাক দুই মলাটের মধ্যে। স্বীকার করতেই হয় যে তাঁর ভাবনাটা বেশ জরুরি ও প্রাসঙ্গিক, বিশেষত এই মুহূর্তে।
উনিশ শতক থেকে শুরু করে বিশ শতকের প্রায় শেষ পর্যন্ত, বিরাট এক পরিসর থেকে তিনি জাতীয়তাবাদ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত খুঁজে বার করে এনেছেন। যখন প্রথম বার ‘ভারত’ নামে একটা ভৌগোলিক অবস্থান কল্পনা করে তার ‘জাতীয়’ চরিত্র সন্ধান শুরু হয়েছিল, সেই সময়ের তাত্ত্বিক মহাদেব গোবিন্দ রানাডেও এখানে আছেন, আবার আছেন স্বাধীন ‘জাতীয়’ রাষ্ট্রে সরকারবিরোধী রাজনীতির কাণ্ডারি ঘোর তার্কিক জননেতা জয়প্রকাশ নারায়ণও। আছেন জাতীয় বৈজ্ঞানিক-দার্শনিক প্রফুল্লচন্দ্র রায়। প্রফুল্লচন্দ্রের ভাবনায় জাতির মধ্যেকার সংঘর্ষগুলির মোকাবিলার কত রকম পথের হদিশ, পড়তে পড়তে নতুন করে বিস্মিত হই। আমার মতে, এটাই এই বইয়ের বড় আকর্ষণ: অনেক রকমের ভাবনা চট করে নাগালে এসে গেল।
আবার ঠিক সেখান থেকেই বইটির সমস্যাও শুরু। প্রতিটি রচনার গোত্র সন্ধান করে এক-একটি শিরোনামের নীচে বিন্যস্ত করার চেষ্টা হয়েছে। এই যেমন, রবীন্দ্রনাথের লেখার উপর শিরোনাম বসেছে ‘কসমোপলিটান ভিশন অ্যান্ড ন্যাশনালিজম’, জওহরলাল নেহরুর লেখার উপর ‘অ্যান একলেকটিক ভিউ অব ন্যাশনালিজম অ্যান্ড কালচার’, বি আর অম্বেডকরের লেখার উপর ‘ন্যাশনালিজম ডিফাইনড’, জয়প্রকাশ নারায়ণের লেখার উপর ‘নেশন অ্যান্ড নেশনহুড ডিফাইনড’ ইত্যাদি। শিরোনামগুলি পাঠককে ধন্দে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট। এই রকম ছোট ছোট লেবেল দিয়ে দিলে ভাবনাচিন্তাগুলোও ছোট ছোট গর্তে আটকে ফেলা হয় কি না, সেই দুশ্চিন্তা চেপে ধরে। যেমন, রবীন্দ্রনাথের জাতি-আলোচনাকে কসমোপলিটান বলাই চলে, কিন্তু যিনি পেট্রিয়টিজম আর ন্যাশনালিজম-এর সম্পর্ক আর পার্থক্য এত যত্ন নিয়ে আমাদের শিখিয়েছেন, কেবল কসমোপলিটানিজম বা আন্তর্জাতিক বীক্ষা দিয়ে তাঁকে বোঝাটা ঠিক হয় কি? কিংবা জওহরলালের লেখায় ‘একলেকটিক’ ভাব থাকতেই পারে, কিন্তু কী যুক্তিতে প্রফুল্লচন্দ্রের লেখার ‘ইনক্লুসিভ ন্যাশনালিজম’-এর গৌরব থেকে জওহরলাল বঞ্চিত হলেন, তা নিয়ে ভাবতে বসতেই হয়। অম্বেডকরের শিরোনামটি ভাবায় সবচেয়ে বেশি। যিনি বলেন, জাতি কেবল এক কাল্পনিক অস্তিত্ব, যিনি ১৯৪০ সালের লাহৌরের পাকিস্তান প্রস্তাবে সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গতি খুঁজে পান কেননা, ন্যাশনালিজম কেবল একটা ‘ডায়নামিক এক্সপ্রেশন অব আ ডিজায়ার টু লিভ অ্যাজ এ নেশন’, তাই ভারতের মধ্যে কোনও একটি জাতি খুঁজে লাভ নেই, নানা জাতির সমাহারই তার বৈশিষ্ট্য— সেই মানুষটির ভাবনার সূত্র হিসেবে কি ‘ডিফাইনিং’ নামক অমোঘ শব্দটি ব্যবহার করা যায়? কী জানি!
শিরোনামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বইয়ের ভূমিকাটিও লেখা হয়েছে, তাই এ নিয়ে এত কথা বলতে হল। ভূমিকায় অনেক তথ্য মেলে, প্রয়োজনীয় তথ্য। অনেকের মতামতের উদ্ধৃতি আছে, প্রাসঙ্গিক ও জরুরি উদ্ধৃতি। কিন্তু বইয়ে পরিবেশিত ভাবনাচিন্তার বিশ্লেষণটি অতিসরল, কখনও বেশ বিপজ্জনক রকমের সরল।
এই ফাঁকে একটি শিরোনাম মনে গেঁথে যায়, গাঁধীর জন্য যেটা বাছা হয়েছে। ‘এমপ্যাথি অ্যান্ড ন্যাশনালিজম’। অনেক দূর পর্যন্ত গাঁধীর ভাবনাচিন্তার প্রতি সুবিচার করে ‘এমপ্যাথি’ শব্দটি, বলতেই হয়। বিশেষত তাঁর যে লেখাটি এখানে গ্রথিত, তাতে সেই অসাধারণ কথাটি আছে: ‘দেয়ার ইজ নো রুম ফর রেস হেট্রেড। লেট দ্যাট আওয়ার ন্যাশনালিজম।’ কল্পনা দিয়েই যখন জাতিকে ভাবতে হবে, তবে অসহিষ্ণুতা ঘৃণা আক্রমণের পথ ছেড়ে সমমর্মিতার কল্পনা দিয়ে জাতির ছবিটিকে ফুটিয়ে তুললেই তো হয়!
সমমর্মিতা: এই ম্যাজিক শব্দটি মনে আগলে রাখলে হয়তো ইতিহাসও একটু নিরপেক্ষ ভাবে পড়া ও বোঝা সম্ভব। প্রফুল্লচন্দ্র রায় বোধহয় সে কালেই আন্দাজ করেছিলেন, জাতীয়তাবাদের অনিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চা শেষ পর্যন্ত কোথায় এনে ফেলবে আমাদের, তাই বেছে বেছে তিনি আওরঙ্গজেবের দৃষ্টান্তটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে গিয়েছিলেন। সমমর্মী দৃষ্টি রাখলে আমরা আজও পুনরাবিষ্কার করতে পারি যে, এই মুঘল সম্রাট অনেক দমনপীড়ন করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ধর্মমতের তফাত মনে রেখে হিন্দুদের খুঁজে খুঁজে বার করে তাদের উপর অত্যাচার করেননি। তাই তাঁর সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন দুই সেনাপতি ছিলেন যশোবন্ত সিংহ এবং জয়সিংহ।
গাঁধীর প্রবন্ধের নামটি প্রশ্নাকারে তীক্ষ্ণ বর্শার মতো আমাদের বুকে এসে বিঁধে যায়, আবার: ‘ইজ হেট্রেড এসেনশিয়াল ফর ন্যাশনালিজম?’ সাম্প্রতিক বাস্তব আমাদের প্রত্যেককে এই গোড়ার প্রশ্নে ফিরিয়ে দিয়েছে। বইটি সেই আত্মমন্থনে অনেকখানি সাহায্য করতে পারে।