প্রতীকী ছবি।
‘হাত ধরে মোর বন্ধু ভুলো একটু মনের ভুল’, কাজী নজরুল ইসলামকে স্মরণে রেখে প্রেয়সীর উদ্দেশে এমন আর্জি বাঙালি হয়তো করতেই পারে। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে অন্তত তিন জন ‘বন্ধু’কে বোধ হয় এমন আর্জি করতে হয়নি স্বয়ং নজরুলকে। কারণ, সে আর্জির অনেক ঊর্ধ্বে তিন বন্ধুর অবস্থান— শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, মুজফ্ফর আহমদ এবং মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। নজরুল ও তাঁর সময়টি কেমন ছিল, এঁদের বন্ধুত্বের রসায়নটিই কোন খাতে বয়েছে, এ সবেরই সন্ধানপ্রয়াসী বইটি। লেখকের আধার মূলত তিনটি বই— শৈলজানন্দের কেউ ভোলে না কেউ ভোলে, মুজফ্ফরের কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা এবং নাসিরউদ্দীনের সওগাত-যুগে নজরুল ইসলাম।
নজরুল স্মৃতিচারণে অবিস্মরণীয় তিন বন্ধু
আনোয়ারুল করীম
৩৫০.০০ (বাংলাদেশি টাকা)
বোধি প্রকাশালয়
‘শৈলজানন্দের দৃষ্টিতে নজরুল’ শীর্ষক অধ্যায়ে ইংরেজ-বিরোধী নজরুল, বোর্ডিংয়ের বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে নজরুলের চড়ুইপাখি নিয়ে কবিতা লেখার মুহূর্তগুলি কী ভাবে এক বন্ধুর চোখে দেখা হচ্ছে, তা-ই বুঝতে চান লেখক। এসেছে কবিবন্ধু ‘ছিনু’র প্রসঙ্গও। ‘নজরুল এবং কমরেড মুজফ্ফর’ অধ্যায়ে এসেছে মোহিতলাল মজুমদার, নলিনীকান্ত সরকারের সঙ্গে কবির সম্পর্ক, ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আত্মপ্রকাশ-সহ নানা প্রসঙ্গ। এ সব প্রসঙ্গ বয়নে মুজফ্ফরের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল, সেটাই লেখক দেখতে চান তাঁর মতো করে। ‘নজরুল ও মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন’ অধ্যায়টি থেকে জানতে পারি, নাসিরউদ্দীন কী ভাবে নজরুল-প্রতিভার বৃক্ষে জল-হাওয়া দিয়েছেন। শুধু কবিতা, গল্প, নজরুল-সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা সওগাত পত্রিকায় প্রকাশের মাধ্যমেই নয়, নাসিরউদ্দীন কবির সঙ্কটে কী ভাবে পাশে দাঁড়ান, জানা যাবে তা-ও। শেষ অধ্যায় ‘সওগাত যুগে নজরুল’-এ কবির জীবন ও সাহিত্যের নানা পর্বকে চুম্বকে ধরতে চেয়েছেন লেখক। নজরুলজীবন-চর্চায় বইটি উপাত্ত ও ভাবনা দুই-ই জোগাবে।
সব পথ বৃত্তাকার
উষসী চক্রবর্তী
২৯৯.০০
দে’জ পাবলিশিং
দু’টি মানুষের প্রেমসম্পর্ক, বিচ্ছেদ, এক দিন উঠে দাঁড়িয়ে ফের আঙুল জড়ানোর হাত বা মাথা রাখার কাঁধের সন্ধান... বহু বার হয়ে উঠেছে বাংলা ছোটগল্প বা উপন্যাসের বিষয়। তার মধ্যেই এই উপন্যাসটি খানিক আলাদা, কারণ সে সমপ্রেমের কথা বলে। আহিরীটোলার শিক্ষিতা নৃত্যপটু কিন্তু রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে দোয়েল ভালবাসে খবরচ্যানেলের মুখ, ঝকঝকে স্মার্ট জয়িতাকে, কিন্তু দু’জনের বিচ্ছেদ দিয়েই এই কাহিনির শুরু। আসলে স্রেফ প্রেম বা সমপ্রেম নয়, দুর্বল হতমান মানুষের ফিরে আসা, আপাত-অসম্ভব উড়ান-কথাই ধরতে চেয়েছেন লেখক। দোয়েলের জীবনের সেই যাত্রাপথটুকুই পাঠকের পড়বার, যে পথে এসে পড়ে অ্যাগনেস লি-র মতো বন্ধু তারও নিজস্ব অন্য রকম এক গল্প নিয়ে, শ্যারন আন্টি জেঠুমা সুমিদিদি সুগত সব চরিত্রই দোয়েলের জীবনে ফেলে যায় অভিজ্ঞতার পাথরছাপ। মেয়ের মন প্রেম ও জীবন যে ঘনত্বে পড়েন লেখক, পুরুষকে পড়েন না তত; সুগত-রাজীব জুটির সুগত চরিত্রটি যত স্ফুট, রাজীব সমপ্রেমী হয়েও তেমন নয়, লি-র প্রেমিক অং-ও স্রেফ ছায়াচরিত্র। কাহিনি-শেষে কলকাতা শহরে গণমাধ্যমে এক নারীর ‘পাত্রী’ চেয়ে বিজ্ঞাপন বেশ লাগে: এই স্বাভাবিকতাই তো প্রাপ্য, ভালবাসার!
কীচক বধ পালা
শুভশ্রী ভট্টাচার্য
১৮০.০০
কৃতি
ঠাকুরমা’র ঝুলি-কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘দেশলক্ষ্মীর বুকের কথা’। সহজ কথায়, মা-ঠাকুমাদের মুখে-মুখে প্রাচীন সরল শিশুকথাগুলি যুগ যুগ ধরে বয়ে চলত, তাই ঠাকুরমা’র ঝুলি। এ তো গেল তার ফর্ম, কিন্তু কন্টেন্ট? আলোচ্য বইয়ের ভূমিকায় অতি জরুরি প্রশ্ন তুলেছেন যশোধরা রায়চৌধুরী— “রূপকথা আর পুরাণ, মহাভারত রামায়ণের গল্প, একটি শিশু প্রথম শুনে ওঠে তার দিদিমা বা ঠাকুমা, মা বা মাসির কোলে বসেই।... অথচ, সেসব গল্পে মেয়েরা প্রায়শই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।” জরুরিতর কাজটি করেছেন শুভশ্রী ভট্টাচার্য। পুরাণের পুনর্কথন করতে গিয়ে টেক্সটের ভিতরে ক্ষমতার অঙ্ককে বদলে দিয়েছেন; এ বইয়ের লেখা দু’টি পুরাণের প্রতিস্পর্ধা, নারীবাদী চোখ বা ‘ফিমেল গেজ়’-এ দেখা পুরাণ-আখ্যান। তাঁর নিবেদনও বড় সহজ— “মহাকাব্যের গল্প পড়ে বা শুনে ছোটবেলা থেকেই নারী-চরিত্রগুলোর জন্য খুব কষ্ট হত।” যশোধরার প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, জাত মহাকাব্যগুলির লেখককুল পুরুষ, অতএব দৃষ্টিভঙ্গিও। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ও ‘কীচক বধ পালা’ শীর্ষক গল্প দু’টি তারই পাল্টা বয়ান— মেয়ের চোখে দেখা ও লেখা মহাকাব্যের আখ্যান। লেখার কলম টান টান, রামায়ণ-মহাভারতের রোমাঞ্চও কম পড়ে না— এ-ও যেন দেশলক্ষ্মীরই বুকের কথা।