বারোমাস/ নির্বাচিত সংকলন: প্রথম খণ্ড (১৯৭৮-১৯৯৮)
সম্পা: পার্থ চট্টোপাধ্যায়, রুশতী সেন
৬৫০.০০
দে’জ
প্রবীণেরা ব্রাহ্ম সমাজের উপাসনায় রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসঙ্গীত জারি রাখতেন বটে, কিন্তু ‘তাঁর প্রেমের গান প্রাচীনদের কাছে অসহ্য ও অব্রাহ্ম মনে হতো।’ সুশোভন সরকার লিখেছিলেন প্রায় ৪০ বছর আগে, অশোক সেন সম্পাদিত ১৯৮২-র শারদীয় বারোমাস-এ। সুশোভনবাবুর এই লেখাটি অবশ্য তাঁর প্রিয় তাতাদা অর্থাৎ সুকুমার রায়কে নিয়ে, যাঁর শেষ পাঁচ বছরের জীবনে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর এ লেখায় বাঙালির চেনা সুকুমারের বাইরেও কম চেনা এক সুকুমারকে খুঁজে পাওয়া যাবে, যিনি গত শতকের গোড়ায় ব্রাহ্ম সমাজের যাবতীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ব্রাহ্ম তরুণদের নিয়ে প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন, চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘হিউম্যানিজ়ম’কে ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠিত আদর্শ করে তুলতে। সুকুমারের প্রধান সহকারী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ একটি পুস্তিকাও লিখেছিলেন: কেন রবীন্দ্রনাথকে চাই।
এ সমস্তের পাশাপাশি সুশোভনবাবুর প্রখর পর্যবেক্ষণ সুকুমার রায় সম্পর্কে— “তাঁর মধ্যে একটা বিষাদের সুর লক্ষ করা যায়।” ১৯২০-র অগস্টে সুকুমার গোপন একটি পত্র লেখেন প্রশান্তচন্দ্রকে— “এই চিঠি আমি দেখিনি। কিন্তু শুনেছি, এতে সুকুমার রায় প্রকাশ করেছিলেন তাঁর চরম ডিসইল্যুশনমেন্ট...”, লিখেছেন সুশোভনবাবু। বহু কাল লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকার পর বাবার সে চিঠিখানি প্রকাশ করেন সত্যজিৎ, এক্ষণ পত্রিকায়। দীর্ঘ সে চিঠির কোথাও সুকুমার লিখছেন, “আশার কথা, আনন্দের কথা, optimism এর কথা, এক বর্ণও সত্যি সত্যি বিশ্বাস করি না।... আসলে মনে মনে যা বিশ্বাস করি তা ঠিক উল্টো— rampant, morbid out and out pessimism.” আবার কোথাও লিখছেন, “আমার মনের অনেক অনেক cherished illusions সব ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে...।”
ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা বরাবরই রহস্যময়। রহস্যময়তার সেই নিদানে কখনও কখনও ব্যক্তির স্বরেও ইতিহাস ভর করে, শতবর্ষ আগে সুকুমার রায়ের ‘ডিসইল্যুশনমেন্ট’ বা বিষাদ যেন পরাধীন ভারতে নিশিদিন যাপনেরও ইতিহাস হয়ে ওঠে, বড় বিষাদময় সে ইতিহাস, প্রবাহিত হতে থাকে পরাধীন থেকে স্বাধীন ভারতেও। বিষাদময় ইতিহাসের সেই স্বরই নানা চিহ্নে, বিবিধ চেহারা-ছবিতে ফুটে উঠেছে বারোমাস-এর এই নির্বাচিত সঙ্কলনটির বিভিন্ন লেখায়।
বারোমাস পত্রিকার (১৯৭৮-২০১৫) সম্পাদক অশোক সেনের সঙ্গে শেষ অবধি সম্পাদনার কাজ করেছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। প্রথমে সম্পাদক সমিতির অন্যতম সদস্য এবং পরে যুগ্ম সম্পাদক হিসাবে, তিনিই সমাজ-রাজনীতি-ইতিহাসের উপর জোর দিয়েছেন প্রথম খণ্ডটিতে। “উদ্দেশ্য ছিল, বারোমাস-এর রাজনৈতিক-সামাজিক প্রবন্ধের বিষয়বৈচিত্রের একটা পরিচয় যেন এই সংকলনে পাওয়া যায়... আজকের পাঠকের সামনে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার রাজনৈতিক বিতর্ক আস্বাদনের সুযোগ করে দেওয়া।”— জানান ‘ভূমিকা’য়।
স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তালতা পরাধীনতা পেরোনোর পরেই কী ভাবে গভীর বিষাদে জড়িয়ে পড়ে, স্বাধীন দেশের অগ্রগমনে তার চরণতল কী ভাবে রক্তমাখা হয়ে ওঠে, দীর্ঘ পরাধীনতা আমাদের কী ভাবে অনিবার্য আত্মবৈপরীত্যের দিকে ঠেলে দেয়, এ সবই প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে সঙ্কলনের লেখাগুলির ভিতর, সে ভাবেই এগুলির বাছাই ও বিন্যাস, সম্পাদকের হাতযশে। উদাহরণে আসি।
গত শতকে চল্লিশের দশকের গোড়ায় কলকাতাকে ঘিরে গড়ে ওঠা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অত্যাবশ্যক শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে গ্রামের মানুষের ভাত কেড়ে নেওয়া হল। ১৯৮১-র শারদীয় সংখ্যায় ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর: গণহত্যার দলিল’ লিখলেন নিরঞ্জন সেনগুপ্ত। মন্বন্তরের এই সব দলিল ঘাঁটতে ঘাঁটতে নিরঞ্জনবাবুর মনে হয়েছে, দীর্ঘ কাল ধরে ভারত খাদ্যে স্বনির্ভর তো ছিলই না, বরং অভাবনীয় খাদ্যাভাব ও অপুষ্টি ছিল ভারতের প্রকৃত চেহারা। “যে রোগে মরছে সেটা তার মৃত্যুর আসল কারণ নয়— মৃত্যুর মূল কারণ খাদ্যাভাব। ভারতীয় অর্থনীতির এক স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল (হয়তো আজও আছে) এই অদৃশ্য দুর্ভিক্ষ।”
এর সঙ্গে মিলিয়ে পড়ুন নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়, বেলা বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌরীন ভট্টাচার্য সংগঠিত সমীক্ষা, ‘কলকাতার শ্রমিক: অসংগঠিত শিল্প’। তাঁরা জানাচ্ছেন, “অসংগঠিত শিল্পের সাহায্যে বেকার সমস্যা দূর করবার কথা যাঁরা বলেন তাঁদের অনেকেই এই নিদারুণ শোষণের প্রতি চোখ ঠারছেন মনে হয়। কোনো আইন বা সংগঠনের বাইরে এদের শোষণের অন্ত নেই। প্রায় প্রস্তর যুগের মানুষের মতো বাঁচবার মরিয়া চেষ্টা করে চলেছে এই-সব শ্রমিকরা।” মনে হয় যেন করোনা-কালে পরিযায়ী শ্রমিকদের কথাই পড়ছি, অথচ ১৯৮০-র জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত।
“উঁচু-নিচু জাতের পার্থক্যের সঙ্গে মালিকে মজদুরে ভেদাভেদের ব্যাপারটা আগাগোড়া জড়িয়ে গেছে।”— মনে করেন নির্মল সেনগুপ্ত, তাঁর সুচিন্তিত ‘জাত নিয়ে হুজ্জোত’ (জুন ১৯৭৮) দিয়েই শুরু সঙ্কলনের। সহমত না হতে পারেন কেউ, কিন্তু জাতিবৈর যে ক্রমক্ষয়িষ্ণু করে ফেলছে ভারতকে, তাতে আর দ্বিমত কোথায়!
পরিবেশবান্ধব না হলে উন্নয়নে অসঙ্গতি তৈরি হবেই, এ নিয়ে প্রথম থেকেই সরব ছিলেন কপিল ভট্টাচার্য। ‘কলকাতা-হলদিয়া বন্দর ও ফরাক্কাপ্রকল্প’-তে (অগস্ট ১৯৭৮) বলেছিলেন, “কলকাতা বন্দরের নাব্যপথ উন্নয়নের কাজে ফরাক্কা-ব্যারেজ প্রকল্প সম্পূর্ণ নিষ্ফল হবেই।” আজ হাড়ে-হাড়ে তা টের পাচ্ছি।
দেশ স্বাধীন হোক বা পরাধীন, মেয়েদের স্বাধীনতা মোটেও সহজলভ্য নয়, এ কথা বোঝাতে মণিকুন্তলা সেন ফিরে যান পঞ্চাশের দশকে, যখন বাল্য ও বহুবিবাহ বন্ধে এবং বিবাহ বিচ্ছেদ ও পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারে মেয়েদের পক্ষে আইন স্বীকৃত হল, সে সময় মেয়েরা এই বিলের সমর্থনে সারা ভারতে প্রায় ১ কোটি স্বাক্ষর সংগ্রহ করে প্রধানমন্ত্রী নেহরুর হাতে তুলে দেন। “কিন্তু প্রচারকালে এই প্রগতির শহর কলকাতার বুকে মেয়েদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন কারা? হিন্দু মহাসভার নায়ক শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, লেখিকা অনুরূপা দেবী এবং আরো অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।”— অপ্রিয় সত্য টেনে আনেন বিষাদগ্রস্ত মণিকুন্তলা (১৯৮০-র জুলাই-অগস্ট), ৪০ বছর পর দেশের স্বাধীনতার ৭৫-এ পা দিয়েও কি দিনযাপনে স্বাধীনতার স্বাদ পান মেয়েরা? জাতীয় মহিলা কমিশন এ বছরের প্রথম আট মাসের (জানুয়ারি-অগস্ট) পরিসংখ্যানে জানিয়েছে, মেয়েদের উপর হওয়া অপরাধের সংখ্যা প্রায় কুড়ি হাজার ছুঁইছুঁই, তার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশে। এ থেকে গত সাত দশকে মেয়েদের সম্পর্কে হিন্দু পুরুষের দখলদারির মনোভাবটা স্পষ্ট হয়ে আসে।
ইতিহাসের এই বিষণ্ণ উচ্চারণ ধুয়ার মতো ঘুরেফিরে আসে সঙ্কলনের বিভিন্ন প্রবন্ধে— গৌতম ভদ্রের ‘১৮৫৭-র কয়েকটি দিন’, দীপেশ চক্রবর্তীর ‘এলিটের গর্ব ও লজ্জা’, তনিকা সরকারের ‘কলকাতায় প্রথম ব্যারিকেড’। শুধুই আমাদের দেশ নয়, বাকি দুনিয়া নিয়েও— কল্যাণ সান্যালের ‘পুঁজি ও রাষ্ট্র’, বিপ্লব দাশগুপ্তের ‘যুগসন্ধিক্ষণে আফগানিস্থানে’, শিপ্রা সরকারের ‘সোভিয়েট রাষ্ট্রে অন্য মত’।
আবার বাঁধা সড়কে না হেঁটে যাঁরা নিজেরাই ইতিহাসে ‘ব্যক্তি’ হয়ে ওঠার দায় তুলে নিয়েছিলেন কাঁধে, তাঁদের নিয়ে লেখা, যেমন অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্তকে নিয়ে অশোক সেনের লেখা, নীহাররঞ্জন রায়কে নিয়ে হিতেশরঞ্জন সান্যালের, রমেশচন্দ্র মজুমদারকে নিয়ে বরুণ দে-র।
আর শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো’র প্রয়াণলেখ: “তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘বিজয়া’, যাঁর সামনে এসে আমাদের কবির কবিতা আর ছবির জগৎ খুলে গিয়েছিল হঠাৎ।” (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯) সৃষ্টির ভিতরে এমন প্রাণময় রহস্যের উদ্বোধন ঘটাতে পারতেন রবীন্দ্রনাথই, ইতিহাসে বিষাদের বিকল্প তৈরির তাগিদেই হয়তো!