—প্রতীকী চিত্র।
এই উপন্যাস পড়ে যশোধরারই এক কালে লেখা কবিতার পঙ্ক্তি মাথার মধ্যে ঘুরেফিরে আসে: ‘দিন সেইদিকে যাচ্ছে আমি শুধু নিজের/ ভেতর থেকে খসে পড়া নিজেকেই নিতে/ নিতে চলে যাব একাকী বোতাম আর/ সুতো সূচে পরিয়েই হাতে হাত জুড়ে নেব উচ্ছিন্ন সময়’...। সঙ্গীতের বিস্তারে যেমন রাগিণীর প্রকাশ, মানুষের তেমন যাপনে। এক সংক্ষিপ্ত সময়খণ্ডের কয়েকটি চরিত্রের ও ঘটনার স্কেচ আঁকতে আঁকতে কালের অমোঘ ইশারাকে ধরেছে যশোধরার কলম। ইতিহাসের ধাবমান স্রোত সম্পূর্ণ নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার এই প্রচেষ্টা বাংলা ভাষায় বিরল। পুরুষতন্ত্রের নামতায় অভ্যস্ত সমাজ কতখানি একঘেয়ে ও অসহায়, এই উপন্যাসে তার প্রকাশ।
“বাচ্চা হবার পর পর, তার তো সেই কন্টিনুয়াস সারভেইলেন্সে বন্দিদশায় থাকা শুরু হল।” সারা জীবন খারাপ মা হওয়ার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা যে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় অবিচ্ছেদ্য অংশ, লেখিকা মনে করিয়ে দেন। তবে নারীবাদী তত্ত্বের ঝাঁঝে যশোধরার রচনায় পুরুষ কখনও বিযুক্ত নয়, বরং তাকে প্রেমে, যাপনে জড়িয়ে নিয়ে বাঁচার গল্পই তিনি শোনান বার বার।
স্রোত
যশোধরা রায়চৌধুরী
৩০০.০০
ঋত প্রকাশন
প্রান্তিক নারীর অসহায়তাকেও সচেতন ভাবে ধরা হয়েছে উপন্যাসে। ব্যবহার করেছেন সেখান থেকে উঠে আসা ভাষা, শব্দ, চিত্রকল্প। একটা দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস ও তার বিশ্লেষণ উপন্যাসটির বিভিন্ন পাতায় সরাসরি উঠে এসেছে; রাজীব জমানা, সোভিয়েটের পতন, মনমোহনের দুয়ারখোলা অর্থনীতি কিংবা জ্যোতি বসুর হাতে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম চলমান দূরভাষের উদ্বোধন। আছে বাম রাজনীতির কথা, কিংবা আমলামহলের প্রাদেশিকতা ও লিঙ্গ রাজনীতির উল্লেখ। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন নতুন উপকরণ কী ভাবে যাপনের ধারা বদলে দেয় তার অনবদ্য প্রকাশ এই কাহিনিতে, যেমন অন্তর্বাসে ইলাস্টিকের ব্যবহার কিংবা মোবাইল ফোন।
মাত্র ১৩৪ পাতার উপন্যাসে বার বার এসেছে ‘ইন এ রিলেশনশিপ’, ‘গ্রো অ্যাপার্ট’, ‘অ্যাডভান্সেস করা’র মতো অল্পবয়সিদের মুখে মুখে ফেরা শব্দবন্ধ। আসলে অতীতের বোঝা নামিয়ে রেখে তিনি সামনে এগিয়ে চলা তরুণদের হাতে ব্যাটন তুলে দেওয়ায় বিশ্বাসী। জোর দিয়ে বলেন, তথ্য, ওয়েল ইনফর্মড হওয়া, এই দিয়েই হতে পারে সামাজিক উত্তরণ।
যশোধরা নিজেই এক বার বলেছিলেন তিনি যতখানি সাহিত্যিক, তার থেকেও বড় সাহিত্যপাঠক! প্রথম থেকেই সচেতন পুরুষের ভাষায় উচ্চারিত, পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা বাংলা কিংবা বিশ্বসাহিত্য নিয়ে। সেই নিশানায় পড়েন সন্দীপন থেকে নির্মলেন্দু গুণ, বহু সাহিত্যিক। তারও মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রঙ্গের ছোঁয়া ভাবায়, “উফ, এমন সাবলিমেশন করেছে বুড়ো, যে পরবর্তী এক্কেবারে ষাট থেকে আশি বছরের জন্য নাকাবন্দি করিয়ে দিয়েছিল বাংলা কবিতাকে।” পঞ্চাশের দশকের আগে কেউ যৌনতা নিয়ে ঠিকঠাক লিখতেই পারলেন না।
বারোটি প্রেমের গল্প
বিতান সিকদার
৩৫০.০০
আনন্দ
২০১৩-১৪ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের স্যানিটারি ন্যাপকিনের উপরে লেখা পোস্টার ও আন্দোলন লেখককে উপন্যাসটি রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। তবে যশোধরার নিজস্ব জীবনদর্শন তাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। আধুনিক মানুষের ক্রমাগত একা হয়ে যাওয়ার গল্প লুকিয়ে আছে রচনার পরতে পরতে। “আরো ভাল যুগ প্রয়োজনে/ নিজচক্ষু, নিজকর্ণ, নিজহাত, নিজঠোঁট নিজবুকে/ চুম্বন ঝরানো।” তাঁর মনোভঙ্গি, ভাষা, কাহিনি তাই— আধুনিক।
তিন পুরুষ নামে উপন্যাস লিখতে শুরু করে মাঝপথে নাম বদলে যোগাযোগ রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিন পুরুষ নিয়ে লিখেছেন তার পর বাংলার অনেক সাহিত্যিক, সমরেশ বসু থেকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তিন প্রজন্মের এ-হেন কথকতায় অপরাজিতার এই বই নতুন সংযোজন। তবে এই উপন্যাস যে ভাবে ছেলে-বৌমা, শাশুড়ি, তার মা, দিদিমার কথা বলে, বৌমা, শাশুড়িদের বন্ধুত্বের কথা বলে, তার মধ্যে একটা ‘একালীন’ প্রবাসী দিক আছে। এঁরা সকলেই দূরে দূরে আলাদা শহরে থাকেন, প্রায় সকলেই বিদেশে, কেউ বস্টনে, কেউ বা ‘ওয়েস্ট কোস্ট’-এ। “জানলার পাশে একটা ফুটন, যাকে দেশে থাকতে সোফা কাম বেড বলে জানত রোহিণী।” এই সব পরিবার ‘হুভার’ দিয়ে কার্পেট পরিষ্কার করে, ওয়াশিং মেশিন থেকে আধা-শুকনো কাপড় মেলে দেয় টাঙানো ‘ক্লোদসলাইন’-এ। পুজোর মিটিং-এ টুনা মাছের চপ খেতে খেতে চন্দ্রবিন্দু না ফসিলস কাকে ডাকা হবে তা নিয়ে হালকা তর্ক হয়। সীমন্তিনী এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ড্রাইভ করতে করতে হেমন্ত, মান্নার গান শোনে। তার ননদ, প্রবাসে বেড়ে ওঠা জিনিয়া সেনের স্বামী গ্রিক, ছেলেটি ‘অটিস্টিক’। প্রবাসে বেড়ে ওঠা জিনিয়া স্বামীকে ডিভোর্স করে, আপাতত বিয়াট্রিস নামে একটি মেক্সিকান মেয়ে তার পার্টনার। এ ভাবেই তৈরি হয় তিন প্রজন্মের প্রবাসী আমেরিকার জীবন।
ম্যানহোলের ঈশ্বর
তন্বী হালদার
৪৫০.০০
সহচর
প্রবাসের সঙ্গে মিলে যায় প্রবাসের পিছনের পথরেখাও। মিলে যায় রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন, দেশভাগের পর দমদম, বেহালার সেনহাটি কলোনি, বাংলাদেশ, পার্ক সার্কাসে অভিন্ন নাগরিকবিধির বিরুদ্ধে জমায়েত। উপন্যাসের পরিসরে আসে পুলিশের গুলিতে নকশাল-হত্যার কথা, আবার ট্রিঙ্কা’স-এ গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের গান। পার্ক স্ট্রিটের পাশে থাকে বেহালা সেনহাটির বাঙালি পরিবার, যারা বালানন্দের শিষ্য। তাদের পরবর্তী প্রজন্মের প্রবাস জীবনে মোহনানন্দ থাকেন, থাকে বেদান্ত সোসাইটি। অম্বিকা আজীবন মেয়েকে একা মানুষ করেছেন, তাঁর স্ত্রী বৃন্দা শিশুকন্যাকে রেখে এক মার্কিন পরিচালকের সঙ্গে পালিয়েছেন। রোসেলিনি-সোনালি দাশগুপ্ত স্মৃতি? দীর্ঘ সময়ের জীবন যাপন চলে নানা বাঁক ধরে, কিন্তু সব বাঁকই যেন কোনও এক বড় নকশার অংশ। তাই পঞ্চাশ বছর আগে শেষ দেখা হওয়া মাসি সীমন্তিনীকে আশ্বাস দেয়, “কোনও কিছুই দেরি হয়ে যায়নি।” আর উপন্যাসের একেবারে শেষে পড়া যায় মেয়েকে লিখে-রেখে-যাওয়া বাবার চিঠি, “তুমি কি পারবে মাগো তোমার অভাগী মাকে ক্ষমা করে দিতে?” সাঁকো তৈরি হয় জীবননদীর এ পারে-ও পারে, নানা বিন্দুকে যোগ করতে।
টলস্টয়ের কথা খানিক বদলে নিয়ে বলা যায়, ‘সব সুখী মানুষই এক রকম; সব দুঃখী মানুষ নিজের নিজের মতো করে আলাদা’। প্রশ্ন হল, প্রেমের গল্পের চরিত্ররা কি সুখী, না দুঃখী? না কি, প্রেমের আখ্যানে দুঃখ-সুখের ফারাক খোঁজা অর্থহীন? সব প্রেমের গল্প— মিলনান্তক হোক বা না-ই হোক— নিজের নিজের মতো করে আলাদা? বিতান সিকদারের বারোটি গল্পের চরিত্ররা তেমনই আলাদা। সঙ্কলনের প্রথম গল্পটির মধ্যেই যেমন দু’টি আলাদা গল্প— এক প্রৌঢ় হোটেল মালিক, যাঁর প্রেম পরিণতি পায়নি, তিনি প্রেমিকার কাছাকাছি থাকবেন বলে হোটেল খুলে বসেছেন। তাঁর হোটেলের ঘরে সিসি ক্যামেরা লাগানো, সেখানে ক্ষণিকের প্রেমে নিবদ্ধ হতে আসা যুগলদের ঘনিষ্ঠতার ছবি দেখেন নিজের কামরায় বসে। এমনই এক ঘরে এল এক যুগল, যাঁরা একদা প্রেমিক-প্রেমিকা ছিল, এখন মেয়েটি অন্য কারও বৌ। দু’টি ভিন্ন অপূর্ণ প্রেমের আখ্যান কোথায় পৌঁছয়, তার আভাসমাত্র দিয়েছেন লেখক। আর একটি গল্পের নায়ক তাঁর স্ত্রীর জিআরই পরীক্ষার ফল জানতে গিয়েছিল— পরীক্ষায় সে সফল হলেই অনিবার্য বিচ্ছেদ, অথচ সেই সাফল্যও তো কাম্য। একটি গল্পে এক যুবক তার স্ত্রীকে বিষ খাইয়ে খুন করতে চাওয়ার পরিকল্পনা জানায় ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে। বন্ধুটি বন্ধুপত্নীকে মেসেজে জানিয়ে দেয় সে কথা। বিষাক্ত চায়ের পেয়ালা অদলবদল হয়, স্ত্রী প্রাণে বাঁচে। যে প্রাণে বাঁচাল, আর যে বাঁচল, তাদের মধ্যে কি কোনও সম্পর্ক তৈরি হবে? লেখক জানান না। গল্পকারের জানানোর দায় নেই বলেই। পাঠক ভেবে নিতে পারেন নিজের মতো করে।
সীমানা নামের নদী
বিশ্বজিৎ রায়
২০০.০০
ধানসিড়ি
প্রেমের গল্পের ছোট পরিসরে অনেক রকম চরিত্র নিয়ে এসেছেন লেখক। তাদের কেউ চোর, কারও জীবনের লক্ষ্য হল ‘সফল’ না হওয়া, কেউ সারা জীবন ধরে ঠকে যাওয়া গোবেচারা নিম্নবিত্ত। কেউ বা নিতান্তই পাড়ার ছোট ব্যবসায়ী, অশিক্ষিত, ক্যাবলাও। তাদের ঈর্ষা আছে, ক্ষুদ্রতা আছে, আবার ভালবাসার জন্য সব ছেড়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকার মতো মনও আছে। বিতানের ছোটগল্প লেখার হাতটি চমৎকার, ফলে গল্পের মোচড়গুলো পাঠককে হঠাৎ দাঁড় করিয়ে দেয় না-ভাবা সম্ভাবনার সামনে। গল্প শেষ হলে মনে হয়, আরও একটু জানতে পারলে ভাল হত, ছোটগল্প হয়ে ওঠার যা আবশ্যিক শর্ত। একটা অভিযোগ অবশ্য থেকে যায়— এই সঙ্কলনের বেশির ভাগ গল্পেরই চালিকাশক্তি হল পুরুষ চরিত্রগুলি। নারী চরিত্র অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্যাসিভ। এমনকি, যে আখ্যান চালিত হচ্ছে নারীচরিত্রের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে, সেখানেও গল্প আবর্তিত হয় পুরুষ চরিত্রের হাতে।
এই গল্পবইয়ের নাম হতেই পারত গঙ্গা কেমনে বহিয়া যায়, বা অথ নাচনি কথা, অথবা উমনো ঝুমনোর গল্প, কিংবা মাগন কিসকুর পথ। এই সব ক’টিই তন্বী হালদারেরই লেখা গল্প, এই বইয়েরই, এবং এই গল্পগুলোও আসলে বলে সেই ম্যানহোলের ঈশ্বর-দের কথা: যে গল্পটির নামে লেখিকা গ্রন্থনামটি রেখেছেন শেষতক। সমাজমাধ্যমধন্য ও প্রচারসর্বস্ব এই সময়ের বাংলা কথাসাহিত্যের, বিশেষত ছোটগল্পের নির্মাণ ও চর্চার সর্বাঙ্গে যে এক রকম মেকি নাগরিক বোলবোলাও এসেছে, তার থেকে অনেক দূরে তন্বীর কলমের অবস্থান। তাঁর গল্পের ঈশ্বর-ঈশ্বরীরাও নাগরিকতার কৃত্রিম আলোকবিন্দু থেকে শতলক্ষ যোজন দূরে— গঙ্গা, হাসু, একাদশী, সুধাবিন্দু, কলমী, ফজিরন, পবন মুর্মু, মিশন ওরাওঁ। তাঁদের ক্লেদাক্ত বসবাস নাগরিক পাঠককে ‘ম্যানহোল’-এর অনুষঙ্গ মনে করায়, রোজের জীবনেও তো ওঁদের কারও কারও কাজ বাবুদের বাথরুম-পায়খানা নর্দমা সাফসুতরো করে তোলা! কিংবা গ্রামেগঞ্জে বাজারে হাবুখেলা— ‘গরান গাছের তেল চুকচুকে লাঠিটা দিয়ে পিঠে মেরে বগলে পকপক আওয়াজ বার করে’ লোক হাসানো! এমন এক জীবনের কথা ছড়িয়ে আছে এই সব গল্পে, কলকাতা যার খবর রাখে না আর।
তন্বী তাঁর গল্পগুলিকে সাজান ছোট ছোট পর্বে। চরিত্রচিত্রণ আর আবহ নির্মাণে তিনি সার্থক; গল্পগুলি পড়তে পড়তেই বোঝা যায়, এ জীবনের ভিতরে ঢুকে ঘেঁটে না দেখলে বুধি হেমব্রম বা মাগন কিসকুদের মতো ঈশ্বরেরা কলমের আগায় এসে বসবেন না। বদলির চাকরি তাঁকে ঘুরিয়েছে বীরভূম পুরুলিয়া থেকে উত্তর দিনাজপুর, মানব-ভূগোল আর ইতিহাসের বিস্তার তিনি দেখেছেন মাতলা থেকে মানবাজারে। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল লেখক-লেখিকাদের সম্পর্কে শোনা যেত লেখার ইন্ধন ও সমিধ খুঁজতে বাংলা ও বহির্বঙ্গেরও ত্রিসীমা তন্নতন্ন আবিষ্কারের কথা। সেই সব সময় আর কলম এখন অলীক, স্বপ্নবৎ মনে হত, যদি না এমন এক-একটি গল্পবই উঠে আসত বর্তমানের গহ্বর থেকে। এই অনুভবই এ বইয়ের বড় প্রাপ্তি।
আকাশপ্রদীপঅপরাজিতা দাশগুপ্ত
৩৯৯.০০
দে’জ়
‘উপন্যাসিকা’, লেখাটির চরিত্র এ ভাবেই নির্দিষ্ট করেছেন বিশ্বজিৎ তাঁর ভূমিকায়। পাঁচটি মূল চরিত্র ঘিরে আখ্যান। সীমানা এক বড় সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান; কালান্তর কর্পোরেট চাকুরে কিন্তু নিজের সত্তায় এক লেখক; বিহান স্বেচ্ছায় গ্রামে থেকে যাওয়া হাস্যমুখ এক মানুষ। সবাই চল্লিশোর্ধ্ব। জয়া কালান্তরের জুনিয়র সহকর্মী, ত্রিশ-অনূর্ধ্ব; সীমানার মা সৌদামিনী সত্তরোর্ধ্ব, গ্রামে থাকেন। তাঁরা পরস্পর নানা সম্পর্কের সুতোয় জড়িয়ে। কিন্তু, ঘনঘটাহীন মন্দলয়ের এই আখ্যানে, খেয়াল করে দেখলে, আরও দু’জোড়া চরিত্র রয়েছে। এক জোড়া চরিত্র কাল— অতীত আর বর্তমান; অপর জোড়া হল স্থান— কলকাতা আর মফস্সল। মাত্র ৮০ পাতার লেখাটিতে বারে বারেই চলে আগু-পিছু যাত্রা— অতীত থেকে বর্তমানে, বর্তমান থেকে অতীতে; সদর থেকে মফস্সলে, আবার ফিরতি পথে। এই যাত্রায় বহু ক্ষেত্রেই অতীত আর মফস্সল, বর্তমান আর কলকাতা একে অপরের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে, পৃথক হয়ে যায়।
কালের দু’টি খণ্ড যেমন পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে থেকেও বিচ্ছিন্ন, কেন্দ্র আর প্রান্ত যেমন পৃথক, উপন্যাসের পাঁচটি চরিত্রও যেন বিচ্ছিন্ন, দ্বীপের মতো। একা। সম্পর্কের সুতোয় বেঁধে থাকার পরও একা। উপন্যাসের গঠন সেই বিচ্ছিন্নতাকে ফুটিয়ে তোলে আরও। একমাত্র শেষের দু’টি অধ্যায় বাদে এক-একটি অধ্যায় এক-একটি চরিত্রের মনোজগৎকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। পাঠক বুঝতে পারেন, এই বিচ্ছিন্নতাও আসলে সময়েরই দাগ— যে সময় আসলে সম্পর্কের স্থায়িত্বকে, সেই স্থায়িত্বের ধারণাকে, ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। অথচ, এই বিচ্ছিন্নতা কিন্তু পরস্পরের প্রতি অনুভূতিহীনতা নয়। এ যেন একটা স্বল্প কিন্তু অলঙ্ঘ্য দূরত্ব বজায় রাখার নিয়তি-নির্ধারিত বাধ্যবাধকতা, যাকে অতিক্রম করার সাধ্য চরিত্রগুলোর নেই। তবে, মনোযোগী পাঠক এই চরিত্রগুলির মধ্যে শুনতে পেতেও পারেন রামকৃষ্ণকথামৃত-এর মৃদু অথচ অভ্রান্ত অনুরণন। সবের মধ্যে থেকেও নির্লিপ্ত থাকতে পারার অভ্যাস যেন চরিত্রগুলির অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে। কাহিনির শেষে লেখক কোনও নির্দিষ্ট উপসংহারে পৌঁছোননি। কোনও চরিত্রের যাত্রাপথকেই বেঁধে দেননি নিজের ইচ্ছানুসারে। জীবন তো এমনই, সচরাচর উপসংহারহীন।