প্রতিবাদী: ধর্মতলায় পার্টিকর্মীদের উদ্দেশে ভাষণরত কানু সান্যাল।
নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে ইতিমধ্যেই সন্তোষ রাণা, অসীম চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ নেতার স্মৃতিকথা পড়ে ফেলেছি আমরা। কিন্তু স্মৃতির সাক্ষ্য তো ফুরোয় না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তার নানা ঝাড়াই বাছাই চলে, আজ যা প্রান্তদেশে, আগামী কাল সেই স্মৃতিই আরও কিছু নিয়ে চলে আসে মূল স্রোতে। অর্জুন গোস্বামী সম্পাদিত বইটিতে যেমন চমকপ্রদ একটি তথ্য পাওয়া গেল— কলকাতার ইংরেজি কাগজ দ্য স্টেটসম্যান প্রথম ‘নকশাল’ শব্দটি ব্যবহার করে। আজ যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ার হয়ে গলা ফাটান, তাঁরা সংবাদপত্রে শব্দচয়নের এই প্রভাবটি মাথায় রাখতে পারেন।
স্মৃতি সতত সুখের নয়। অর্জুনবাবুর বইয়ে সুমিত মুখোপাধ্যায়ের লেখায় এসেছে ২০১০ সালে কানু সান্যালের সাক্ষাৎকার। কানুবাবুর স্মৃতি, ১৯৭০ সালেই চারু মজুমদার খাটের উপর কিল মেরে বলেছিলেন, “১৯৭২-এ রিপাবলিক ডিক্লেয়ার করব। ১৯৭৫ সালেই মুক্ত হয়ে যাবে ভারত, আমি বলছি।” হাঁপানি রোগে অসুস্থ নেতার অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে আত্মগর্বী অহংসর্বস্বতা পরিষ্কার। কানুবাবু পরে ২০১০ সালে আত্মহননের পথ বেছে নেন। চারু মজুমদার, কানু সান্যাল ও তাঁদের কমরেডরা হঠকারী, পথভ্রষ্ট হতে পারেন, কিন্তু তাঁদের আত্মত্যাগ পরবর্তী প্রজন্ম ভোলেনি। সুমিতবাবুর মন্তব্য, “যে দিন থেকে নকশাল আন্দোলন শহরাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হয়, সে দিনই তার মৃত্যুঘণ্টা বেজে গিয়েছিল।”
ফিরে দেখা নকশালবাড়ি আন্দোলনসঙ্কলন ও সম্পা: অর্জুন গোস্বামী
৩০০.০০
অরুণা প্রকাশন
এই বইয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, দুলাল চন্দ ও শান্তি মুন্ডার সাক্ষাৎকার। হাঁপানি-আক্রান্ত বৃদ্ধ দুলালবাবু স্মৃতি ঘেঁটে জানিয়েছেন, সৌরেন বসুর নেতৃত্বে তাঁরা কাঠমান্ডু, লাসা হয়ে বেজিং গিয়েছিলেন। কিন্তু চেয়ারম্যান মাওয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি। দুলাল চন্দের এই স্মৃতি প্রকাশের সূত্রেই বলতে হয় এই বইয়ের অন্যতম দুর্বলতা— অগোছালো সম্পাদনা। উপরে লেখক হিসাবে অভিজিৎ মজুমদারের নাম, লেখার শেষে আবার ছোট ফন্টে লেখা সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পুলক গাঙ্গুলি, মুক্তি সরকার, অপু চতুর্বেদী ইত্যাদি নাম।
সত্তর দশকের বিপ্লবী নারী শান্তি মুন্ডা এখনও জমিতে কাজ করেন। সাধনকুমার পাল তাঁকে প্রশ্ন করেন, এখন তো জোতদার আর নেই। তা হলে? সটান উত্তর, “দেখুন না কত জমি ফাঁকা পড়ে আছে। সমস্ত জমির মালিক শিক্ষক, ব্যবসায়ী, ডাক্তারবাবুরা। এরাই এখন নতুন জোতদার।” শান্তি আরও বলেন, খতমের রাজনীতি, স্কুল পোড়ানো ভুল ছিল। মানুষকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে রক্তপাতহীন বিপ্লবই এখন তাঁর লক্ষ্য। দিলীপ চক্রবর্তীর লেখা ‘সরোজ দত্তের হত্যাকাণ্ড’ নিবন্ধটিও চমৎকার। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, চিন্মোহন সেহানবীশরা তখন পুলিশ হেফাজতে এই মৃত্যুর প্রতিবাদ করেছিলেন। অমৃতবাজার পত্রিকা-র তৎকালীন চিফ সাব-এডিটর, তৎকালীন ইন্ডিয়ান জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন-এর কর্তা ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই রহস্য উদ্ঘাটনে আগ্রহী ছিলেন।
দার্জিলিঙের প্রাক্তন জেলাশাসক দীপককুমার ঘোষ লিখেছেন, “পুলিশ হাজতে পেথিড্রিন না পেয়ে পেথিড্রিন-আসক্ত চারুবাবু সাত দিনেই পটল তুললেন।” কেউ পেথিড্রিন নিতেই পারেন, কিন্তু প্রাক্তন জেলাশাসকের ভাষা-সন্ত্রাস একটু কম হলেই ভাল হত। চারুবাবু যে কার্ডিয়াক অ্যাজ়মার রোগী ছিলেন, জেলে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়নি— এগুলিও বলা উচিত ছিল।
নকশালবাড়ি: স্বপ্ন সত্য সন্তাপ
সম্পা: স্বপন মুখোপাধ্যায়
৫০০.০০
গাঙচিল
স্বপন মুখোপাধ্যায়ের ৪৫৪ পৃষ্ঠার বইটি আবার অন্য রকম। বারাসত, বেলেঘাটা, বরাহনগর, কাশীপুর থেকে ডেবরা-গোপীবল্লভপুর, বীরভূম, হুগলি প্রতিটি অঞ্চল ধরে আলাদা আলোচনা। সবচেয়ে চমকপ্রদ জঙ্গল সাঁওতালকে নিয়ে লেখাটি। আত্মঘাতী কানু সান্যালের স্মৃতি এক রকম, আবার এই লেখায় ১৯৬৭ সালে ময়দানের সমাবেশে সেই চারুবাবু বলছেন, “নেতা আমি নই। নেতা জঙ্গল, নেতা কানু।” বিপ্লবের অন্যতম অসম্পূর্ণতা এখানেই— এক-এক জনের স্মৃতি এক-এক রকম। ভারতীয় দার্শনিকরা তাই বলতেন, স্মৃতি বা প্রত্যভিজ্ঞা কোনও প্রমাণ নয়। ‘মাও সে তুং ও রেড বুকের প্রভাব’ লেখাটিতে আসল কথা বলা হয়েছে, “শ্রেণীবিশ্লেষণ অত সহজ এবং সরল কাজ নয়। মাও সে তুঙের কাছ থেকে একটা মে়ড-ইজি পাওয়া গেল বটে, কিন্তু দেশকালের বিচারে যে বিশ্লেষণ পাল্টে যেতে বাধ্য, সেটা অনেকেই বুঝতে চাইলেন না।... গোঁড়ামি আর অন্ধ অনুসরণ তাঁদের সাধারণ বিচারবুদ্ধিকেও ভোঁতা করে দিল। শ্রেণী বিশ্লেষণে সর্বনাশা ভুল হতে শুরু করল।”
সমরেন্দ্র মণ্ডলের ‘বিযুক্তি-সংযুক্তির পথ বেয়ে’ লেখাটিতে সিপিআই(এমএল), সিসিআরআই ইত্যাদি ২৬টি উপদলের নাম আছে— “মতাদর্শগত বিভাজন নয়, ব্যক্তি সম্পর্কের অবনমনের ফলেও নতুন পার্টির জন্ম হয়েছে।” সিপিআই(মাওবাদী)-ও এসেছে লেখায়; রাডিক্যাল ইউথ লিগ, ক্রান্তিকারী আদিবাসী মহিলা সংগঠন, চেতনা নাট্য মঞ্চ ইত্যাদি গণসংগঠনের মাধ্যমে মাওবাদীরা কী ভাবে তাদের গণভিত্তি বাড়াচ্ছে। লেখক আশাবাদী, “নকশালবাড়ি আন্দোলনের পর ক্রমবিভাজনের যে পর্ব শুরু হয়েছিল, সিপিআই মাওবাদীরা সেই ভাঙনের পথে বাঁধ দিয়েছে।” এখানে আর একটু বিশ্লেষণ দরকার ছিল। সত্তরের নকশালরা যেমন আবেগসর্বস্ব ছিল, আজকের মাওবাদীরা তা নন। গোপন কুরিয়ার নয়, তাঁরা ইমেল ও নব্য প্রযুক্তিতে দড়। কোন কমরেড কোথায় থাকেন, অন্যরা বেশির ভাগ সময়েই জানতে পারেন না। কৃষকের শোষণ-মুক্তির পাশাপাশি তাঁরা বিশ্বায়নের পুঁজিবাদ রোখার কথাও ভাবেন। কৃষি আইনের প্রতিবাদ, শাহিন বাগ আন্দোলন বা এ রাজ্যে নির্বাচনের সময় ‘নো ভোট টু বিজেপি’তেও তাঁদের প্রভাব রয়েছে। নীল মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস দ্য লাইভস অব আদার্স প্রায় এক কথা বলেছিল। গত প্রজন্ম গ্রামে গিয়েও শ্রেণিহীন হতে পারল না, এখন নব্য প্রজন্ম রেললাইনে অন্তর্ঘাতের বয়ান রচনা করে!
প্রথম বইটিতে সেই ‘স্প্রিং থান্ডার’ বা বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের পুনরবলোকন করেছেন তপোধীর ভট্টাচার্য। মহাশ্বেতা দেবীকে নিয়ে আলাদা একটি লেখা লিখেছেন সঙ্গীতা সান্যাল। তপোধীরবাবুও তাঁর লেখায় মহাশ্বেতাকে উদ্ধৃত করেছেন, “বাংলা সাহিত্যে দীর্ঘকাল বাস্তব-বিমুখতার সাধনা চলছে। লেখকরা দেওয়ালের লেখা দেখেও দেখছেন না... শ্রেণীসংগ্রামের ক্ষেত্র স্পষ্টতর হচ্ছে।” হাজার চুরাশির মা, ‘স্তনদায়িনী’ বা ‘বিছন’ গল্পগুলির অভিঘাত যে কী ভয়ঙ্কর! মহাশ্বেতার উত্তরাধিকার হিসাবে অভিজিৎ সেন, সাধন চট্টোপাধ্যায়, নলিনী বেরার নাম করেছেন প্রাবন্ধিক। সাম্প্রতিক এই প্রবন্ধে নবারুণ ভট্টাচার্য কোথায় থাকবেন তা হলে? নবারুণের বিপ্লব-বীক্ষার সঙ্গে মহাশ্বেতার দূরত্ব রয়েছে ঠিক, কিন্তু কাঙাল মালসাট-এ যখন চাকতি পুলিশ কমিশনারের মুন্ডু উড়িয়ে দেয়? কবিতায় বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, তুষার রায় প্রমুখের নাম করেছেন প্রাবন্ধিক। সমাজ-সচেতন তপোধীরবাবু প্রশ্ন তুলেছেন, “প্রায় চার দশক ক্ষমতায় থাকার পরেও কেন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাছে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে এবং বাঙালির রাজনৈতিক সমাজ সম্পর্কিত সত্তর বছরব্যাপী বদ্ধমূল ধারণাকে ফানুস প্রতিপন্ন করে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে— এই সব কিছুর গ্রন্থিল প্রেক্ষিতেই বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের পর্যালোচনা করতে হবে।” বাঙালি আজও সেই পর্যালোচনার প্রতীক্ষায়।