কাকে আমরা বলি গল্প, কোনটা কাহিনি, কোনটা সত্যি ঘটনার বর্ণনা— এর মধ্যে সংযুক্তিই বা কতটা, বিযুক্তিই বা কেমন? প্রশ্নটা বেশ গোলমেলে, সাহিত্য-আলোচকদের মধ্যেও নানা মত, স্বভাবতই। কঠিন এই প্রশ্ন আবার মনে এল আলোচ্য বইটির সূত্রে, যেখানে এই সীমারেখাগুলি মিশে গিয়েছে পরস্পরের সঙ্গে, বা বলা ভাল, পরস্পরের মধ্যে। ‘স্ট্রেস’ বা মানসিক চাপ থেকে মুক্ত হয়ে ‘জ়েস্ট’ বা উদ্দীপনা কী ভাবে পাব তা-ই নিয়েই এই গল্প-সঙ্কলন। লেখক কয়েকটি গল্প বললেও, বইয়ের পূর্ণ নামকরণ পুরোমাত্রায় সার্থক। শিরোনামের নীচেই লেখা আছে ‘স্টোরিজ় অ্যান্ড লেসনস’। বইয়ের কাহিনিগুলো থেকে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে ‘ট্রান্সফরমেশন’ ঘটানোর মতো আশানুরূপ শিক্ষা পেতে পারি বইকি। গল্প তখন আর গল্প থাকে না, গল্প হলেও সত্যি, বাস্তব, প্রাত্যহিকতার দর্পণ হয়ে ওঠে।
মুখবন্ধ, ভূমিকা ও উপসংহার বাদ দিলে বইটির সাতটা পর্ব। লেখকের মতে, আমাদের জীবনে আসা নানাবিধ চাপকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। কোনও কোনও চাপ হল ‘ইনার স্ট্রেস’, বা অন্তর্বর্তী; আবার কোনওটা ‘এক্সটার্নাল’, বাইরে থেকে আসা চাপ। লেখক অবশ্য বইটা সাজিয়েছেন সাত রকম বিভিন্ন ধরনের চাপ বা স্ট্রেস নিয়ে। এই সাতটি ধরন— ‘রিলেশনশিপ’ বা সম্পর্কজনিত, ‘পেরেন্টাল’ অথবা মা-বাবার দেওয়া চাপের পরে এসেছে ‘সোশ্যাল’ বা সামাজিক ও ‘ফাইনানশিয়াল’ অর্থাৎ অর্থনৈতিক চাপ; তদুপরি, ‘হেলথ’ বা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত, ‘জব’ বা চাকরিজনিত চাপ এবং পরিশেষে ‘কম্পিটিটিভ’ বা প্রতিযোগিতামূলক চাপ।
প্রতিটি চাপ এক-একটি পর্বে। প্রতি পর্বের মূল অংশে রয়েছে বড়সড় একটা করে গল্প; গল্পের বিষয় সেই পর্বের সঙ্গে সাযুজ্য বজায় রেখেই। প্রায় সব ক’টাই বিদেশের পটভূমিকায়। প্রথম গল্পটি মুম্বইতে, দ্বিতীয়টা ডেনমার্কের, তিন থেকে পাঁচ আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে, ষষ্ঠটি লন্ডনে শুরু হয়ে আমেরিকায়, আর সব শেষেরটি জাপানে। একটি প্রশ্ন তাই উঠতে পারে, এই বইয়ের লক্ষ্য যে ভারতীয় পাঠককুল, তারা কি চরিত্রদের চাপগুলোর সঙ্গে নিজেদের অভিজ্ঞতাকে মেলাতে পারবেন? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আলোচ্য সমস্যার গুরুত্ব— ঘটনা হল, ভারতীয় পাঠক পারবেন মিলিয়ে নিতে, অন্য দেশের পাঠকও পারবেন, কেননা সমস্যার ধরন এই বিশ্বায়নের দুনিয়ায় বিশ্বজনীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিকই, হয়তো বাদ গেল বেশ কিছু আরও অন্য ধরনের চাপ, যাতে আমরা বাঙালি হিসেবে অভ্যস্ত— যেমন, প্রতিনিয়ত কিছু একটা গেল-গেল চিন্তা, সফল হওয়ার বাসনা বা অসফল হওয়ার আশঙ্কা থেকে অহেতুক চাপ, জ্যোতিষীর কাছে ছোটা। কিন্তু বাঙালি তাতে অভ্যস্ত হলে এগুলিরও কোনওটাই বাঙালির একান্ত নিজস্ব সমস্যা নয়। মারীচ-সংবাদ নাটকের সেই প্রবাদপ্রতিম স্লোগানটি এই সূত্রে মনে পড়তে পারে— ‘চাপের রকমফের’।
স্ট্রেস টু জ়েস্ট: স্টোরিজ় অ্যান্ড লেসনস ফর পার্সোনাল ট্রান্সফরমেশন
অরিত্র সরকার
৩৯৯.০০
পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউস ইন্ডিয়া
গল্প ছাড়াও প্রতি পর্বে রয়েছে আরও দু’টি অংশ, গল্পের আগে এবং পরে। আমার মতে এটাই বইয়ের বিশিষ্টতা। গল্পের আগে লেখক বিষয়বস্তু বা বিশেষ ধরনের চাপটাকে নিয়ে কিছুটা মনস্তত্ত্ব আলোচনা করেছেন; পড়ার আগে আমরা যাতে বুঝতে পারি কোন বিষয় নিয়ে গল্পটা লেখা— এই অংশের নাম সঙ্গত কারণেই ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং’। আর প্রতি গল্পের পরে আছে ‘রিফ্লেকশন’— যাতে কাহিনি থেকে, পাত্রপাত্রীদের আচরণ থেকে কী শেখার তার প্যারাবল-সম সন্ধান।
কোনও বই পড়ার আগে আজকাল আমরা সবাই আগে লেখক সম্বন্ধে কিছু জানতে চাই— গুগল থেকে অনেক তথ্য মেলে; প্রায় সব লেখকেরই আজকাল ইন্টারনেটে ‘পদচিহ্ন’ তথা ‘ই-ফুটপ্রিন্ট’ সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে তা অনাবশ্যক; কারণ, প্রতি পর্বেরই ‘রিফ্লেকশন’ প্রসঙ্গে, লেখক অকপটে নিজে কী ভাবে বিভিন্ন ধরনের চাপ থেকে মুক্ত হয়েছেন তার হদিস পাঠকদের দিয়েছেন।
উত্তমপুরুষ বা আত্মকথনকে কী ভাবে সাহিত্যের মধ্যে, এমনকি বিশ্লেষণের মধ্যে আনা যায়, তা নিয়ে এখন অনেক উত্তর-আধুনিক ভাবনার খোঁজ মেলে। এই পর্বটি সেই ভাবনাকে নতুন উপাদান জোগাতে পারে। আমার মতে, স্বল্পদৈর্ঘ্যের রিল দেখতে অভ্যস্ত প্রজন্ম এতে উপকৃত হবেন।