ভারসাম্য: অন্যোন্যজীবিতার এক অনন্য রূপ— পূর্ব কলকাতা জলাভূমি
উত্তরাধুনিকরা যখন বলেন, সত্যসন্ধান আর মানবকল্যাণ মোটেই বিজ্ঞানের আসল চালিকাশক্তি নয়, মানুষের আর পাঁচটা চর্চাক্ষেত্রের মতো বিজ্ঞানেরও আসল ধান্দা হচ্ছে ‘ক্ষমতা’ বাগানো;— তখন রাগে গা চিড়বিড় করলেও অস্বীকার করার জো নেই, অন্তত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, বিজ্ঞান উত্তরোত্তর মুনাফাসর্বস্ব, সমরবাদী রাষ্ট্র ও উৎপাদন-শিল্পমালিকদের হাতের পুতুল হয়ে উঠেছে। মানবকল্যাণ যেটুকু হয়েছে, সেটা নিছক উপজাতক, মূল উৎপাদন নয়। উত্তরাধুনিকদের মতে, এনলাইট্নমেন্টের সময় থেকেই আধুনিক বিজ্ঞান নাকি এই অপকর্মে নিযুক্ত ছিল। কিন্তু বিজ্ঞানকে আশ্রয় করেই যে ক্ষমতার সর্বাধিপত্যের গুমোট ভাঙার গান গাওয়া যায়, সেই অতি জরুরি কথাটা তাঁরা চেপে যান। সেই কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে গিয়েছেন প্রয়াত প্রযুক্তিবিদ-পরিবেশবিদ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ। তিনি সমস্যাটাকে ‘গণমুখী বিজ্ঞান না পশ্চিমী অনুকরণবাদ’ এই ছকে দেখাতে চেয়েছেন।
১৫১ পৃষ্ঠার বইটিতে রয়েছে দু’টি প্রবেশিকা সমেত ১৯৯০-২০১৬-র মধ্যে লেখা উনিশটি ছোটবড় প্রবন্ধ এবং চারটি ‘পুস্তক পরিচিতি’। গ্রন্থনির্মাণ-শৈলীর সার্বিক অনিপুণতা, নির্ঘণ্ট না-দেওয়া প্রভৃতি অভিযোগ জানানোর অবকাশ থাকলেও, এই ব্যতিক্রমী বইটি প্রকাশের জন্য ‘উৎস মানুষ’কে ধন্যবাদই জানাব।
শিবপুরে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, ১৯৭০ দশকের শেষ দিকে ধ্রুবজ্যোতি পিএইচ ডি করেন ইকলজি নিয়ে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই বিষয়ে ওটিই প্রথম পিএইচ ডি। তারপর কলকাতার নর্দমা-ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে কাজ করতে করতে কলকাতার নোংরা কোথা দিয়ে, কী ভাবে, কোথায় গিয়ে পঞ্চভূতে বিলীন হয়, সেই গোলকধাঁধার রহস্য উন্মোচনে নামলেন। মজা-বিদ্যাধরীর খাত বেয়ে এক বিচিত্র বিদ্যার সন্ধান পেলেন তিনি। সে এক ‘চতুর্থ’ দুনিয়া, যার বাসিন্দা তৃতীয় বিশ্বের গরিবরা। দেখলেন, কলকাতা কল্লোলিনী তিলোত্তমা না হলেও, প্রকৃতির বরপুত্রী। বর্জ্য গিয়ে পড়ছে কলকাতার পূর্ব দিকের বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে। আর সেখানে, কোনও কৃত্রিম প্রক্রিয়াকরণ ছাড়াই, এক পয়সা বিনিয়োগ ছাড়াই, নোংরা জল হয়ে উঠছে মন্দাকিনীর মতো শুদ্ধ। এ এক আশ্চর্য ম্যাজিক। ওয়াটার অব ইন্ডিয়া নয়, ওয়াটার অব ইস্ট ক্যালকাটার ম্যাজিক।
‘ময়লা জল আর জঞ্জালের পুনর্ব্যবহার ও পরিশোধন’-এর যে পদ্ধতি আবিষ্কার ও প্রয়োগ করেছে এ অঞ্চলের মানুষ, সেটা ‘এক অসাধারণ সৃজনশীলতার নজির।’ স্তূপীকৃত জঞ্জালের পাহাড় আর ‘ধাপার ঝিলে’র রহস্য সাদা ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন ধ্রুব। ‘এই ঝিলের জলেই চাষ হয় তামাম ধাপা এলাকার সবজি।’ আবার এই ঝিলেই ‘পৃথিবীর প্রথম ময়লা জলে মাছ চাষের সূত্রপাত’— যা কিনা ‘সৃজনশীল দক্ষতার আরেক সাম্রাজ্য।’ ভেড়িগুলোতে ‘একই সাথে জল ঢোকার এবং বেরোনোর’ অভিনব ব্যবস্থা করেন এখানকার মৎস্যচাষীরা। কেবল ‘বর্ণ, গন্ধ ও আস্বাদ’ এই তিনটি ‘মাপের যন্ত্র’র সাহায্য নিয়ে ‘যাবতীয় সমস্যার অত্যন্ত সুষ্ঠু সমাধান করার পদ্ধতি এই এলাকায় প্রচলিত বিদ্যা।’
গুমোট ভাঙ্গার গান
ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ
১৫০.০০
উৎস মানুষ
এই ‘প্রচলিত বিদ্যা’ বা ‘পরম্পরাগত জ্ঞান’ (যার অবলুপ্তি নিয়ে তাঁর আক্ষেপ এ বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে) শব্দবন্ধটি তাঁর কাছে একটি ধ্রুবপদের মতো। অথচ তাঁর মুখ কিন্তু পিছন দিকে ঘোরানো নয়। তিনি স্পষ্টই বলেন, পরম্পরাগত জ্ঞানকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুক্তির নিরিখে বিচার করে, প্রয়োজনে পরিমার্জনা করে, তবেই ব্যবহার করা যাবে। কেননা, ‘পরম্পরাগত জ্ঞানও পরিবর্তনশীল’, তাও ‘নতুন পরিস্থিতির প্রয়োজনে’ বদলাতে বদলাতেই গড়ে উঠেছিল। তাই আধুনিক বিজ্ঞানের মাপকাঠিতেই তিনি মাছের ভেড়ির ‘পরিশোধন প্রযুক্তি’র হিসেব পেশ করেছেন: রৌদ্র-শোধিত সেই জলে ‘‘কলিফর্ম ব্যাকটিরিয়ার সংখ্যা ৯৯ থেকে ৯৯.৯ শতাংশ কমে যায়। দ্রবীভূত অক্সিজেন ঢোকার মুখে ‘০’ থাকে, আর মাঝ পুকুরে দুপুর বেলায় বেড়ে প্রতি লিটারে ২০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ওঠে। তবে ভোরের দিকে তা লিটার প্রতি ৩-৪ মিলিগ্রামে নেমে যায়।’’ এই ভাবে আপনা থেকে প্রকৃতি শোধন করে চলেছে লক্ষ-কোটি ব্যাকটেরিয়া-অধ্যুষিত সেই ‘ময়লা’। সেই চক্র-প্রক্রিয়ায় মাছেরা পাচ্ছে খাবার, স্থানীয় মানুষ পাচ্ছে জীবিকা, ভদ্রলোকরা পাচ্ছে সবজি আর মাছ, বজায় থাকছে ইকলজির ভারসাম্য। সিম্বায়োসিস বা অন্যোন্যজীবিতার এ এক অনন্য রূপ, যার সাদা অর্থ পরস্পরের ওপর নির্ভর করে বেঁচে-থাকা, যা সব বিপ্লবের অন্তিম লক্ষ্য।
এরই পাশে বানতলায় রয়েছে ‘ভারতবর্ষের বৃহত্তম সেডিমেন্টেশন ট্যাঙ্ক। নিশ্চল নিথর। শয়ে শয়ে সচল ভেড়ির মধ্যে মহাস্থবিরের মতো পড়ে আছে অচল যন্ত্রদানব।’ দোষটা যন্ত্রের নয়, সুষম দৃষ্টিভঙ্গির। সুষম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরিকল্পনা করতে গেলে তিনটি জিনিস খেয়াল রাখতে হবে: ‘‘১) জনস্বাস্থ্য, খাদ্য ও কর্মসংস্থান বনাম নগরপত্তন; ২) স্বনির্ভর প্রযুক্তি বনাম কায়েমী স্বার্থ; ৩) সৃজনশীল জনগণ বনাম ফাটকাবাজি উদ্যোগ।’’ নগরপত্তন, কায়েমি স্বার্থ আর ফাটকাবাজিরই সাম্প্রতিক নাম প্রসাধনী উন্নয়ন। তবু আশা দুর্মর— লবণ হ্রদ বুজিয়ে ‘‘যে-পরিকল্পনার বিদ্যা নিয়ে বিধান নগরের পত্তন হয়েছিল তা ছিল একপেশে।... একই ভুলের পুনরাবৃত্তি নিশ্চয় কোনো সুস্থ পরিকল্পনার নজির বহন করবে না।’’
‘পরিবেশ-প্রতিবন্ধী’ বা ‘ইকলজিক্যালি হ্যান্ডিক্যাপ্ড’রা হল সেই সব গরিব মানুষ, ‘একটা নিস্তব্ধ পরাজয়ের মনোভাব’ যাদের ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে।’ এঁদের বাদ দিয়ে ‘‘প্রকৃতির সংরক্ষণ একটি উৎকট রসিকতা।... ’’ ‘‘... এখন একটা বিপর্যস্ত, পরাজিত মনুষ্য জাতির কথা মেনে নিতে বলা হচ্ছে সহ্যশক্তি বাড়ানোর টোটকা দিয়ে।’’ বিশ্বায়ন-লালিত এই টোটকাদাতাদের সম্পর্কে ধ্রুবজ্যোতির উপভোগ্য শ্লেষ: ‘‘গয়লা যে দুধে জল দেয় তা না বলে গয়লা কি মহান, সে তো কিছুটা দুধও দেয়, এ কথা বলা। এইসব ঠিকাদার লেখকরা লেখেন ভালো।’’ কেউ কেউ পান ‘রাইট লাইভলিহুড অ্যাওয়ার্ড!’
‘পশ্চিমবঙ্গের কৃষিচিত্র/শিল্পায়ন ও কৃষকের ভবিষ্যৎ’ এবং ‘পুরুলিয়ার যৌথ সেচ ব্যবস্থা’ শীর্ষক দুটি ক্ষেত্রসমীক্ষা-ভিত্তিক গবেষণাধর্মী লেখায় ইতিহাস ও তত্ত্ব আলোচনার ভিত্তিতে ‘কি করব বলে ভাবছি তার একটা খসড়া’ পেশ করেছেন ধ্রুব। প্রত্যেকটি প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রয়েছে তাঁর। আর রয়েছে চেতাবনি। যে-উন্নয়নের জন্য আমরা ‘হাঁকপাঁক করছি’ তার তীর্থক্ষেত্র ইদানীং চিন। তার ‘কী হাল হয়েছে চীনের জলসম্পদের উপরে?’ যে-হুয়াং পু নদী সাংহাই শহরের পানীয় জল সরবরাহ করে, ২০১৩ সালে ‘হাজার হাজার মরা শুয়োর ভেসে যাচ্ছিল’ তার বুকের ওপর দিয়ে। কারণ অজানা।
পরিবেশ সমস্যার উপলব্ধি ও তার সমাধানের দুরূহ পথ গ্রামের মানুষ নিজেরাই তৈরি করে নেবেন। তাঁদের সেই কাজে সাহায্য করার জন্যই ধ্রুবজ্যোতির ‘এই লেখা’। কিন্তু মিডিয়ার দাপটে তাঁর এই বাণী গ্রামের মানুষের, এমনকি শহরের মানুষেরও, কানে অবিকৃত ভাবে পৌঁছবে তো?