সতু সেনের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন হাসান সুরাবর্দি, প্যারিস শহরে এক সন্ধ্যায়। তখন ১৯২৫, আমেরিকা পাড়ি দেওয়ার পথে সতুবাবু প্যারিসে কিছু দিন কাটাবেন মনস্থ করে নেমে পড়েছিলেন সে শহরে, বারাণসীর হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র হিসেবে বৃত্তি পেয়েছিলেন আমেরিকার পিটসবার্গে কার্নেগি ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পড়বার।
সেই সন্ধ্যায় একটি রেস্তরাঁয় ঢুকে (ফরাসি না জানায়) ইংরেজিতে খাবারের অর্ডার দিতে ওয়েটার এক প্লেট মাংস রেখে যায় টেবিলে, সতুবাবু মাংসের বিরাট টুকরো দেখে রীতিমতো আতঙ্কিত— গোমাংস নয় তো? তাঁর এই দ্বিধান্বিত অবস্থা দেখে পাশের টেবিল থেকে এক প্রৌঢ় উঠে এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন: ইন্ডিয়ান? বিস্মিত সতুবাবু ঘাড় নাড়তে প্রৌঢ়ের পরের প্রশ্ন: হিন্দু? তার পর তাঁর টেবিলের উল্টো দিকে বসে প্রৌঢ় জেনে নেন যে, সতুবাবুর জন্ম বরিশালে, আর তাঁর হাত গুটিয়ে বসে থাকার কারণ জানতে পেরে অট্টহাস্য করে অকৃত্রিম পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় বলেন “আমি মোছলমানের ছাওয়াল, শুয়র খাইয়্যা ফাঁক কইর্যা দিলাম, আর তোমার গোরু ছোঁয়নে ডর!”
ওই প্রৌঢ়ই হাসান সুরাবর্দি, সতু সেনের ভাষায়, “প্রথম ভারতীয়, যিনি নাটকের কলাকৌশল শেখার জন্য যৌবনে দেশের মায়া কাটিয়ে রাশিয়া আমেরিকা জার্মানি ব্রিটেন ফ্রান্সে চষে বেড়িয়েছিলেন।” সে দিন তিনি সতুবাবুর থেকে কলকাতার নাট্যচর্চার খোঁজ নিতে-নিতে টের পেলেন, নাট্যশিল্পে কতখানি আসক্ত সতু সেন, বললেন “নাটকের ব্যাপারে তোমার যখন এত আগ্রহ, তখন এসব ইঞ্জিনিয়ারিং-টিয়ারিং পড়ার কি দরকার তোমার?” বলতে-বলতে প্রায় উত্তেজিত সুরাবর্দি সাহেব: “এখানে এসেছ, নাটক নিয়ে পড়াশোনা করো, হাতেকলমে কাজ শেখো, তার পর দেশে ফিরে গিয়ে তোমার শিক্ষাকে কাজে লাগাও। বাঁধা পথে না হেঁটে অন্তত একটা নতুন ছেলে নতুন সড়কে হাঁটুক।”
প্রাণিত হয়েছিলেন সতু সেন। বাকিটা ইতিহাস... কার্নেগি ইনস্টিটিউটে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি না হয়ে নাট্য বিভাগের ছাত্র হন। সুরাবর্দি সাহেবের চিঠি নিয়ে নিউ ইয়র্কের ল্যাবরেটরি থিয়েটারের তৎকালীন কর্ণধার মস্কো আর্ট থিয়েটারের প্রবাদপ্রতিম বলিস্লাভস্কি (স্তানিস্লাভস্কি-র উত্তরসূরি) ও অন্য শিক্ষিকদের তত্ত্বাবধানে থিয়েটারের মঞ্চস্থাপত্য আলোকনির্মাণ অভিনয়বিজ্ঞান আয়ত্ত করেন তিনি, ১৯২৮-এ ওই নাট্য প্রতিষ্ঠানেরই টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হন। ১৯২৯ থেকে ফের বেরিয়ে পড়েন বিভিন্ন দেশের থিয়েটার ও নাট্যব্যক্তিত্বদের সন্ধানে, তাঁর ভ্রমণসূচি ভরে ওঠে নিরন্তর শিল্পান্বেষণে। ত্রিশের দশকের গোড়ায় থিতু হন স্বদেশে, অবিরাম কাজ করে গিয়েছেন বঙ্গরঙ্গমঞ্চে, নাট্যশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, এমনকি চলচ্চিত্রেও, ষাটের দশকের গোড়া পর্যন্ত। ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-র তিনিই প্রথম ডিরেক্টর।
ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা থেকে প্রকাশিত এই বইটিতে সতুবাবুর শিল্পসংক্রান্ত মননের তন্নিষ্ঠ হদিস পাবেন পাঠক, আত্মস্মৃতি থেকে মঞ্চ-আলো-অভিনয়, সব কিছু নিয়েই লিখেছেন তিনি। আবার তাঁকে নিয়ে লিখেছেন তাঁর সমসাময়িকেরা, অনুজেরাও— যেমন ‘আমার অনুপ্রেরণা ও পথপ্রদর্শক’ মনে করেন তাঁকে তাপস সেন।
আসলে সতু সেন তেমনই এক ভারতীয়, যিনি আন্তর্জাতিক নাট্যরীতি অধিগত করেছিলেন, গত শতকের প্রথম পর্বে বিশ্বব্যাপী নাট্যপ্রয়োগকলার যে জোয়ার, তার অচ্ছেদ্য সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন, আবিশ্ব এই বৈভবকে বাংলার মাটিতে বপন করতে চেয়েছিলেন। এখন তো আমাদের কূপমণ্ডূক সংস্কৃতিতে তেরো হাঁড়ির ভেদ, কৃত্রিম বেড়াগুলো হয়তো-বা ভেঙে পড়তে পারে সতুবাবুর ভাবনার অভিঘাতে।