কবি শঙ্খ ঘোষের বন্ধু বললেই সচরাচর ‘কৃত্তিবাসী’দের কথা উঠে পড়ে। তাতে ভুল নেই, তবে তাঁর গভীরতর আর একটি বন্ধুবৃত্ত ছিল। শেফালী মৈত্র লিখেছেন, “শঙ্খ ঘোষ (শঙ্খদা), শচীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (শচীনদা), ও প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য (প্রদ্যুম্নদা) ছিলেন পরস্পরের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। মনের মিল এঁদের এতটাই যে একজনের মনোজগতের পরিচয় থেকে অপর দুজনের চেতনার পরিমণ্ডল কেমন হতে পারে, তা অনুমান করা সম্ভব।” এই প্রদ্যুম্নের স্মৃতি আর চিঠি নিয়ে শঙ্খ ঘোষের বই পরম বন্ধু প্রদ্যুম্ন। এই বই কেবল বন্ধুর খবর দেয়নি, বাঙালির জ্ঞানচর্চার বিশেষ এক মর্জি ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছে। নিজেকে যতটা সম্ভব প্রচ্ছন্ন রেখে সে কাজটি করেছেন শঙ্খ ঘোষ।
প্রদ্যুম্ন লিখেছিলেন, “অহং-বিসর্জন মানে: বিশ্বকে আত্মীকরণ, এবং নিজেকে জ্ঞেয় রূপে তদ্গত চোখে দেখার ক্ষমতা। ক্রমাগত, ক্রমাগত।” তাঁর এই কথাটুকুর সামনে চুপটি করে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে, বিশেষ করে মন আটকে যায় শেষের ওই দু’বার লেখা ক্রমাগত শব্দটির কাছে এসে। কোনও ব্যক্তি তাঁর চার পাশের পৃথিবীকে নানা ভাবে নিজের মধ্যে গ্রহণ করবেন। গ্রহণ করার ফলে তাঁর নিজেকে ‘সর্বজ্ঞ’ বলে মনে হবে না আর। ওখানেই কিন্তু থেমে গেলে চলবে না। নিজের ভিতরে বিশ্ব প্রবিষ্ট হওয়ার পর এক মনে নিজেকেই নিজে দেখা ও জানা চাই, আর এই হল অহং বিসর্জন দেওয়ার উপায়। অহং মানে তো নিজেকে প্রকাণ্ড বলে ভাবা; এই ভাবনার বেলুন ফুটো হয়ে যায়, যখন চার পাশের সঙ্গে নিজের সম্পর্ককে বিচার করতে বসি। এই বিচার থামালে কিন্তু চলবে না। নিজেকে জানার এই কাজটি করে যাওয়া চাই, আজীবন-আমৃত্যু। প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য সেই বিরল বাঙালিদের এক জন, যিনি সত্যি এই কাজটি করতেন।
তিনি বিশ্বকে কী ভাবে নিজের মধ্যে গ্রহণ করতেন? শঙ্খ ঘোষের লেখায় তার খোঁজ মেলে। প্রদ্যুম্নের ‘কলেজের দিনগুলি’ ছিল চলাচলময়। “প্রদ্যুম্ন ক্লাসে না থাকলে বুঝতে হবে সে তার স্কুলের বন্ধু বিনোদকিশোর রায়চৌধুরী আর অরুণ দাশগুপ্তের সঙ্গে বসে আছে নিশ্চয় ইংরেজি অনার্সের ক্লাসে। যেখানে হয়তো পড়াচ্ছেন তারকনাথ সেন। বা, কিছু পরে, অমল ভট্টাচার্য।... এই দুই ভাষাতেই এম.এ. পরীক্ষা দেবে সে (আর পরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও)।” বিদ্যাচর্চার একাধিক বিষয়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া প্রদ্যুম্ন আবার কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী। তবে শঙ্খবাবু জানিয়েছেন, “ছিল না কোনো আগ্রাসনের ধরণ। ধীরভাবে সে শুনত সবার কথা, বলত হয়তো ক্বচিৎ-কখনো একটাদুটো শব্দ।” পরবর্তী কালে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যাঁরা সর্বজ্ঞ-বাক্বিভূতিময় ছাত্রনেতাদের দেখেছেন, তাঁদের সঙ্গে প্রদ্যুম্নের চরিত্রের মিল নেই স্বভাবতই। এই মিতবাক মানুষটি মাঝে মাঝে কৌতুকমুখর হয়ে উঠতেন। মোহিতলাল মজুমদার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর প্রেসিডেন্সি কলেজের ‘অযোগ্য’ শিক্ষকদের উপর বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, “উড়ছে, উড়ছে। পিএইচ.ডি আর পি.আর.এস-এর দুই ডানা মেলে দিয়ে উড়ছে সব!” “ক্লাসঘরের মাঝখানে প্রদ্যুম্ন ঠিক সেইরকম দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে নাচাতে নাচাতে বলেছিল সেই গল্প, আর তার চোখেমুখে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল অদম্য এক নিরুচ্চার হাসি।” কলেজের দিনগুলিতে যে নিরুচ্চার হাসি মাঝে মাঝে দেখা দিত তাঁর চোখে মুখে, তাই ধরা পড়েছিল পরবর্তী কালে তাঁর লেখা বই তেরছা নজরে: মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প-তে। শঙ্খ ঘোষ তাঁর বইতে ’৭৪ সালের মার্চ মাসে লেখা প্রদ্যুম্নবাবুর একটি চিঠি উদ্ধার করেছেন। “কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবী মানে সেই লোক, যিনি লেখেন কিন্তু প্রুফ দেখেন না। আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, এও এক ধরণের বামনাই নয়তো? উঁচু বর্ণের হিন্দুর মজ্জাগত শ্রম-বিতৃষ্ণা? গতর খাটাতে এঁরা বড়ই নারাজ। শ্রমিক-শ্রেণীর এই নয়া বামুনদের আলস্যের পাশে, বহুনিন্দিত বুদ্ধদেব বসুর নিষ্ঠা আর শ্রমশীলতার কত তফাৎ!” বামেরা তখনও ক্ষমতাসীন হয়নি, কিন্তু কমিউনিস্টকর্মী প্রদ্যুম্ন রোগটা ঠিক ধরতে পেরেছিলেন। সে রোগ-বালাই পরে এমন জায়গায় গেল যে, সবজান্তা বাবু-কমিউনিস্টরা কথা শোনার কান হারালেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখাতেও এই সঙ্কটের কথা আছে।
পরম বন্ধু প্রদ্যুম্ন
শঙ্খ ঘোষ
২৫০.০০
প্যাপিরাস
এখানে একটি কথা খেয়াল করিয়ে দেওয়া উচিত। সম্পাদক হিসেবে ও লেখক হিসেবে তিনি ছিলেন অসম্ভব শ্রমনিষ্ঠ। বিষ্ণু দে প্রবর্তিত সাহিত্যপত্র সম্পাদনার সময় অসম্ভব বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বভারতী পত্রিকা (নবপর্যায়)-র সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণের পর বলতেন, পুলিনবিহারী সেনের উত্তরাধিকার বহন করার সামর্থ্য নেই তাঁর, বিশ্বভারতী পত্রিকা-র শেষে ছাপা হত তাঁর সম্পাদকীয়। তবে তাঁর সম্পাদিত বিশ্বভারতী পত্রিকা জ্ঞানতত্ত্বালোচনায় বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিল, তা স্বীকার না করে উপায় নেই। তারাশঙ্করের উপন্যাস ছিল তাঁর আগ্রহের বিষয়। সে জন্যই বীরভূমের পথে পথে ঘুরতে চেয়েছিলেন তিনি।
শ্রমসাধনা ও মানুষের সঙ্গে সহজ যোগাযোগই বুদ্ধিবৃত্তের মানভূমিতে আটকে থাকা মানুষদের মুক্তি দিতে পারে। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে দু’টি ‘অসফল’ উদ্যোগের মধ্যে প্রদ্যুম্নের সেই প্রয়াসের ছবি ধরা পড়েছে। ভারতকোষ-এর কাজ যখন শুরু হল তখন মনে হয়েছিল তাঁর: “এখানেও জ্ঞানচর্চার এমন একটা আন্দোলন গড়ে উঠবে, যা কেবল কয়েকজনের বুদ্ধিচর্চাই নয়, যা হয়ে উঠতে পারে গোটা একটা সমাজবদলের সূচক।” পরে বামেরা পশ্চিমবঙ্গে যখন ক্ষমতায়, তখন গড়ে উঠেছিল ‘লোকবিদ্যাকেন্দ্র’। প্রদ্যুম্নবাবু সেই বিদ্যাকেন্দ্রের কর্মসূচি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘এনলাইটেনমেন্ট প্যারাডাইম’-এর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। জ্ঞানদেনেওয়ালা এক দিকে আর জ্ঞানলেনেওয়ালা আর এক দিকে। এই প্রভুত্বের সম্পর্ক বা ক্ষমতার সম্পর্ক কী ভাবে ভাঙা যায়? প্রদ্যুম্নবাবু আহ্বান করেছিলেন কমবয়সি ছেলেমেয়েদের। বলেছিলেন, কনফারেন্স টেবিল থেকে যে পারিভাষিক শব্দ বেরোয়, সেগুলো বেশির ভাগই মরা পাথর। নিরেট। বিদ্যুৎহীন। “রাজমিস্ত্রিদের মুখে, ঘরামিদের মুখে মুখে চলেছে স্থাপত্যের বহু পারিভাষিক শব্দ।” তাঁদের কাছে যাওয়া চাই। শঙ্খ ঘোষ সেই প্রাণবন্ত আহ্বানের ছবি আঁকার পর শেষে যোগ করেন অমোঘ একটি বাক্য: “অবশ্য ব্যর্থ হলো তাও।” এই ব্যর্থতার কারণ প্রদ্যুম্নের পরিকল্পনাকে মেনে নেওয়ার মতো সচল গঠনতন্ত্রের অভাব।
তখন কী করলেন তিনি? লিখলেন, পড়লেন। লেখা আর কতটুকু, পড়াটাই তাঁর সব কিছু। কেন লেখেন, সে খবর দিয়েছেন ব্যক্তিগত ডায়েরিতে— “লেখাটা আমার হয়ে-ওঠার, আমার আত্মচিকিৎসার, প্রক্রিয়া।” এই হয়ে ওঠার কাজটা কমিউনিস্টদেরও করা উচিত। তাঁর সিদ্ধান্ত, “শুদ্ধ হয়ে-ওঠা, কমিউনিস্ট হয়ে ওঠা... তৎক্ষণাৎ আয়ত্ত করবার ব্যাপার নয়।... দিনে রাতে অতন্দ্র প্রখর চৈতন্যে’ তা অর্জন করতে হবে।” ২০০১-এ শঙ্খবাবুর জন্মদিনে ব্রেশ্টের কবিতা অনুবাদ করে পাঠালেন তিনি, “যা ঘটে গেছে তা ঘটে গেছে। যে-জল/ তুমি একবার মদে ঢেলে ফেলেছ তা তো/আর বের করে দেওয়া যায় না, কিন্তু/ সব কিছু বদলায়। তোমার শেষ নিঃশ্বাস দিয়ে/ তুমি নতুন করে শুরু করতে পার।”
শঙ্খবাবুর পরম বন্ধুর কথা পড়তে পড়তে মনে হয়, এ ভাবে যদি বাঙালি চিন্তকেরা তাঁদের ক্ষুদ্র অহংসর্বস্ব ‘আমি’ হারানোর সাধনায় ব্রতী হতেন, তা হলে সংস্কৃতির ও পড়াশোনার যোগাযোগময় আলোকিত পরিসর গড়ে উঠতে পারত। আমরা কি নতুন করে শুরু করতে পারি না?