চিনের লুডো আমাদের লুডো! স-স্ক্য পণ্ডিত নামে এক তিব্বতি বৌদ্ধ পণ্ডিত গোতম বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলি ঘুরে দেখবেন বলে ভারতে আসছিলেন। তখন নেপালের ‘নাগপাশ’ বা ‘বৈকুণ্ঠ-খেল’এর সঙ্গে তাঁর পরিচয়। খেলার ছকে ৭২টা ঘর, মাঝে-মাঝে লাল আর কালো রঙের সাপ। লাল সাপ শুভ, সেখানে পড়লে অনেক দূর উঠে যাবেন। মানে, খেলোয়াড়ের কর্মফল ভাল। কিন্তু কালোর মুখে পড়লে সর্বনাশ! তার সঞ্চিত কর্মফল ভাল নয়, সিধে কয়েক ধাপ নেমে আসতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন ঘরে নানা দেবতার মূর্তি, একেবারে উপরে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের ত্রিমূর্তি। ওখানে পৌঁছলেই জিত!
মজাদার এই খেলাটি নিয়ে স-স্ক্য ফিরে এলেন দেশে। কিন্তু তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা তো বৌদ্ধ। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের পদতলে পৌঁছলে জয় ভাববেন কী ভাবে? অতএব, খেলাটা একটু বদলে গেল। সাপ থাকল, কিন্তু শেষ ৭২ নম্বর ঘরে নির্বাণ বা পরম আনন্দের সুখাবতী ভূমি। বৌদ্ধমতে, এই দুঃখময় সংসারচক্রে তো ৭২টা স্তর, সেটা অতিক্রম করে নির্বাণ।
পুরাণী
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
৪৫০.০০
দীপ প্রকাশন
স-স্ক্য পণ্ডিতের সেই খেলা থেকেই আজকের সাপ-লুডো। শুভ কর্মফলের লাল সাপ নেই, কিন্তু মই, রকেট আছে। মজার না? গবেষণা মানে কি শুধুই গরু খোঁজা? গো শব্দের আর এক অর্থ বাক। অর্থাৎ বাগ্দেবী সরস্বতী। নতুন জ্ঞানই তো আমরা গবেষণায় খুঁজে বেড়াই। ব্রজ মানে কি শুধুই যমুনাপুলিনের বৃন্দাবন? শব্দটির আসল অর্থ গো-প্রজনন কেন্দ্র, যেখানে গরু, মোষ, উট, ঘোড়া প্রভৃতি কেনাবেচা থেকে দুধ, দই, মাখন এমনকি ভেড়ার লোম পর্যন্ত রাজার আয়-ব্যয়ের নিদান তৈরি হয়। সেই মহাভারতীয় অর্থ আজ বিস্মৃত। কিন্তু হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ বারংবার জানিয়েছে, শ্রীকৃষ্ণের পালক পিতা নন্দ মথুরার রাজা কংসের কাছে ব্রজভূমির ‘রেভিনিউ কালেকশন’ দাখিল করতেন। এমনকি গোরক্ষা মানে হাড়-জিরজিরে গরুদের পিঁজরাপোলে টিকিয়ে রাখা বা গোমাংসভোজীদের পেটানো নয়। গোরক্ষা শব্দটিকে মাঝখানে রেখে ভগবদ্গীতা আসলে বৈশ্যদের স্বভাবজ বৃত্তির কথা বলে, ‘কৃষি-গোরক্ষা-বাণিজ্যং বৈশ্যং কর্ম স্বভাবজম্’। আর গরু খাওয়া নিষিদ্ধ শোনার পর মহামুনি যাজ্ঞবল্ক্য সাফ জানালেন, ‘আমি অবশ্যই এ সব মাংস খাই, যদি রান্না করার পর সেটি বেশ তুলতুলে নরম হয়।’ বন্ধ্যা গাভীর পারিভাষিক নাম ছিল বসা। আর ঋগ্বেদে অগ্নির আর এক নাম, বসান্ন। ওই মাংসমিশ্রিত অন্নই তো তাঁকে দান করতে হবে। আধুনিক ভারত যে ফতোয়াই দিক না কেন, প্রেমদিবসে গরুকে সপ্রেম আলিঙ্গনের কথা সনাতন ভারতে আদৌ ছিল না।
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর ৩০টি পুরনো নিবন্ধের সঙ্কলন পুরাণী সহজ সরল ভঙ্গিতে এ ভাবেই নানা কথা জানিয়েছে। নিবন্ধগুলি একদা তাঁর তরুণ বয়সে সবই আনন্দবাজার পত্রিকা-র রবিবাসরীয় বা শারদীয় সংখ্যায় বেরিয়েছিল। তার পর কথা অমৃতসমান বা মহাভারতের লঘুগুরু-র লেখক প্রবীণ হয়েছেন, চুলে পাক ধরেছে। লেখার ভঙ্গিও স্বাভাবিক ভাবে বদলেছে। তরুণ বয়সে তিনি আরও বিপজ্জনক! ‘শালাবাবু’ নিবন্ধে সংশয় প্রকাশ করে সহাস্য বলেছেন, অর্জুনের মতো মহারথী থাকতেও কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ধৃষ্টদ্যুম্নকে পাণ্ডবপক্ষের ব্যূহ রচনার ভার দেওয়া হয়, কারণ পাঁচ ভাইয়ের একটি মাত্র শ্যালক! পড়তে পড়তে বোঝা গেল, ‘কিঁউ কি সাসভি কভি বহু থি’ আমাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। বৌমারা কবে না শাশুড়িকে তেরছা খোঁচা দিয়েছে? এক উদ্ভট সংস্কৃত শ্লোকে দুর্যোধনের স্ত্রী ভানুমতী দ্রৌপদীকে পরিহাস করে বলেন, ‘তোমার তো আবার পাঁচটা স্বামী ছাড়া পোষায় না।’ দ্রৌপদীর ঝটিতি জবাব, ‘পতিবৃদ্ধিঃ কুলে মম। এটা আমার শ্বশুরবাড়ির রেওয়াজ।’ অম্বা, অম্বালিকা থেকে কুন্তী, সকলকে এক তিরে গেঁথে দিলেন তিনি।
কিন্তু বাংলা ভাষার সংস্কৃতজ্ঞ পুরাণচিন্তক কি শুধুই রসিকতা করেন? ‘হিন্দু বিবেকানন্দ’ প্রবন্ধে তিনি নতুন ভারতের রাজনীতি নিয়ে ক্ষুরধার, “কেন্দ্রের সরকার, তদনুগামী রাজনৈতিক দল এবং তাদের অন্তর্যামী সাক্ষী চৈতন্য হিসাবে অবস্থিত একটি সঙ্ঘ হিন্দু, হিন্দুধর্ম এবং বিবেকানন্দকে যে ভাবে দেখেন, তা মূর্খ পণ্ডিতদের মতো।” কথাটা অনেক সমাজবিজ্ঞানী এবং রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যে বহু বার বলেছেন, নতুন কিছু নয়। কিন্তু নৃসিংহ নিয়ে আসেন বিষ্ণুপুরাণের শ্লোক, ‘বর্ষং তদ্ ভারতং নাম ভারতী যত্র সন্ততিঃ।’ মানে, ভারতের বাসিন্দারা সকলে ভারতেরই সন্তান। যাঁরা অনর্থক দেশের মানুষের মধ্যে নাগরিকপঞ্জি তৈরি করে বিভাজন ঘটাতে চান, তাঁদের কাছে অবিলম্বে এই প্রবন্ধ হিন্দিতে অনুবাদ করে পাঠানো উচিত!
কিন্তু রাজনীতিক লাভালাভের হিসাবের কাছে চৈতন্য সুদূরপরাহত। ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় কয়েক বছর আগে তাঁর বইয়ে দেখিয়েছিলেন যে, অশোকের আমলেও বনবাসীরা বিশেষ সুবিধা পাননি। আমাদের মতো সংস্কৃতে আনপড়দের লেখক জানালেন, রামের বন্ধু নিষাদরাজা গুহ বনে থাকেন বটে, কিন্তু বাল্মীকি তাঁর বর্ণনা সে রকম করে দেননি। তিনি রামের ‘আত্মসম’ বন্ধু, তাঁর ব্যবহারও প্রায় আর্যজনোচিত। নৃসিংহের মেজাজ তাঁর শিক্ষকের মতোই। বাংলা ভাষায় ‘নিয়তিবাদের উদ্ভব ও বিকাশ’-এর সুকুমারী ভট্টাচার্যের কাছেই তো তাঁর গবেষণা! ফলে এই বইয়ের ‘নিয়তি’ নিবন্ধ শেষ হয় চমৎকার ভঙ্গিতে, “শুভাশুভ কর্মের নিয়তি মানুষ নিজেই সৃষ্টি করে, সেখানে ঈশ্বরে কর্ম অর্পণ করার সুবিধে এটাই যে, জীবনে দুর্দৈব নেমে আসলে মানুষ সেটাকে ঈশ্বরদত্ত শাস্তি ভেবে সইতে পারার শক্তি পায়।”
লেখক-ছাত্র এক জায়গায় শিক্ষকের থেকে আলাদা। ‘ফুলডোরে বাঁধ ঝুলনা’ নিবন্ধে তিনি ভাগবতের সঙ্গে প্রায় একমত, “বৃন্দাবনে তাঁর কোনও ঐশ্বর্য নেই, বড়মানুষের গুমোর নেই, তিনি সবার বড় কাছের মানুষ।” অতঃপর সাতবাহন হালের নাটক থেকে রসিকতাচ্ছলে কিঞ্চিৎ আদিরসের ইঙ্গিতও দেন। জননী যশোদা গোপরমণীদের সামনে তরুণ কৃষ্ণের বালকস্বভাবের কথা বলেন, ‘কৃষ্ণ তাঁর ছেলেমানুষ। অজ্জবি বালো দামোঅরেত্তি।’ লেখক জানান, এই শ্লোকই পরে চৈতন্য-পার্ষদ রূপ গোস্বামীর বিদগ্ধমাধব নাটকে প্রভাব ফেলে। পালক পিতা নন্দ শ্রীকৃষ্ণের বিয়ে দিতে চান, যশোদা বলেন, “কৃষ্ণ আমার এখনও বালক। দুধ খাওয়ার বয়স। এখনই কী বিয়ে?” কৃষ্ণের সখা মধুমঙ্গলের বক্রোক্তি, “সত্যি, তোমার ছেলে দুগ্ধমুখই বটে। শত শত ব্রজাঙ্গনা তাই এই বালকের মুখদুগ্ধ পান করে।” মহাভারত, পুরাণের পাশাপাশি বৈষ্ণবশাস্ত্রে অধিকার নৃসিংহপ্রসাদের করায়ত্ত।
উৎসর্গপত্রে লেখক জানান, এই বই তাঁর প্রয়াত সাহিত্যগুরু রমাপদ চৌধুরীর উদ্দেশে বালকোচিত নিবেদন। ‘কথামুখ’ সেই সাহিত্যগুরুকে নিয়েই। রূঢ় ব্যবহার, ভ্রুকুটি নিয়ে তাকান, তার পর লেখাটা ড্রয়ারে পোরার নির্দেশ দেন। কয়েকটা লেখা বেরোনোর পর সম্পাদকের নির্দেশ, চার দিনের মধ্যে একটা লেখা দিতে হবে, বাঙালির চোখে সেকালের উত্তর ভারতীয়। নৃসিংহ অবাক, ‘মাত্র চার দিন!’ সম্পাদকের ছোট্ট জবাব, ‘কে বলল, চার দিন? রাত, দিন এক করে লেখা নামিয়ে দিন।’ বহু পরে লেখককে তাঁর উপদেশ, “আগামী পাঁচ বছর কোনও সভাসমিতিতে যাবেন না। আপনার নামটা ভারী, রামায়ণ-মহাভারত নিয়ে লেখেন, সেটা আমার কাজে লাগে। কিন্তু আপনি জামাপ্যান্ট পরেন, গটমট করে চলেন এ সব দেখলে পণ্ডিতের ইমেজটা নষ্ট হয়ে যাবে।... আমি সারা জীবন উপন্যাস লিখে গেলাম বটে, পছন্দের পড়ার বিষয় কিন্তু প্রবন্ধ।” রমাপদবাবুর শতবর্ষে তাঁর লেখকসত্তা নিয়ে অনেকে আলোচনা করেছেন, কিন্তু প্রতিভাবান তরুণ লেখকের কাছে কেমন ছিলেন সেই সম্পাদক? এই কারণেই এই লেখা বারংবার পড়া যায়। এর পাশে আজকের সম্পাদনা? সঙ্কলনের ৩০টা নিবন্ধই পুনঃপ্রকাশ। কোনটা কবে প্রকাশিত হয়েছিল, সন-তারিখও নেই!