চিন্তক: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তর-এ কমলাকান্ত মন্তব্য করেছিল, “তার পরে মালা— এটি স্ত্রীলোকের বিদ্যা— কখন আধখানা বৈ পুরা দেখিতে পারিলাম না। নারিকেলের মালা বড় কাজে লাগে না; স্ত্রীলোকের বিদ্যাও বড় নয়। মেরি সমরবিল বিজ্ঞান লিখিয়াছেন জেন্ অষ্টেন্ বা জর্জ এলিয়ট উপন্যাস লিখিয়াছেন— মন্দ হয় নাই, কিন্তু দুই মালার মাপে।”
ঊনবিংশ শতাব্দীতেই অবশ্য বাংলা ভাষায় ‘স্ত্রীলোক’-এর বিদ্যার নানা ক্ষেত্রে পূর্ণবিকাশ দেখা গিয়েছিল। কেবল সাহিত্য নয়, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও তাঁরা পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছিলেন। বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক কালের বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকদের প্রবন্ধাবলি খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ করছে ‘এবং মুশায়েরা’। তার মধ্যে গোপা দত্ত ভৌমিকের প্রবন্ধ সংগ্রহ দ্বিতীয় খণ্ডের প্রবন্ধগুলি পড়তে গিয়ে কমলাকান্তের ‘একপেশে’ মন্তব্যটি মনে পড়ল— সেই মনে পড়ার কারণ আছে। প্রয়াত সুতপা ভট্টাচার্য কমলাকান্তের ভাবনার বিরোধিতা করার জন্যই সাহিত্য অকাদেমি থেকে ‘বাঙালি মেয়ের ভাবনামূলক গদ্য’ নামের বইটি সঙ্কলন ও সম্পাদনা করেছিলেন। সুখের কথা, এই ‘ভাবনামূলকতা’ ‘বিদ্যা’ এ সব যে পুরুষদের একচেটিয়া নয়, এই সহজ ‘প্রাকৃতিক’ সত্য সামাজিক ভাবে আমরা আজকাল ক্রমশই স্বীকার করছি। বর্তমান সময়ের বেশ কয়েক জন ‘মহিলা’ প্রাবন্ধিকের ভাবনামূলক বিদ্যাবিষয়ক বাংলা লেখা পড়ার সময় আলাদা করে তাঁদের লিঙ্গপরিচয় ‘নেতিবাচক’ অর্থে যেমন আমরা মনে রাখি না; তেমনই আমরা অনেক সময় খেয়াল করি যে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁদের মগজ যে মনের অধিকারী সেই সংবেদন তাঁদের সাংস্কৃতিক লিঙ্গগত অবস্থানের ফলেই সম্ভব— তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমৃদ্ধ করছে। গোপা দত্ত ভৌমিক তেমন প্রাবন্ধিকদের মধ্যে এক জন। রুশতী সেন আর এক জন।
গোপা দত্ত ভৌমিকের বইটির প্রবন্ধগুলি চারটি অংশে বিভক্ত। ‘উনিশ শতক: বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র’, ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘সুকুমার রায়’ এবং ‘কথাসাহিত্যিক ও কথাসাহিত্য’ এই চার ভাগে লেখাগুলি সাজানো। এর মধ্যে ‘সুকুমার রায়’ অংশে একটি প্রবন্ধ রয়েছে। বাকি তিনটি অংশই নানা সময়ে রচিত বিবিধ প্রবন্ধের সঙ্কলন। ‘কথাসাহিত্যিক ও কথাসাহিত্য’ অংশে প্রমথ চৌধুরী থেকে শুরু করে হাল আমলের স্বল্পপরিচিত কিন্তু বিশিষ্ট প্রদীপ রায়গুপ্তও রয়েছেন।
এর থেকে পাঠক হিসেবে গোপা দত্ত ভৌমিকের সচলতার ও কৌতূহলী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘উচ্চকিত নারীবাদ’ তাঁর স্বভাবধর্ম নয়— প্রসন্ন সংবেদনশীলতা ও যুক্তিনিষ্ঠতার তিনি অধিকারী। তিনি জানেন, স্ত্রীলোকের বিদ্যা নিয়ে যে বঙ্কিম নারকেল মালার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন, সেই বঙ্কিমই ভ্রমরকে ‘অপরাজিতা’-র উপমায় বিশেষিত করেন। এ বইয়ের প্রথমাংশে ‘বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে নারীর অস্মিতাবোধ’, ‘দুটি বিনষ্ট কিশোরী জীবন: বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে’ ও ‘বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে ঘরছাড়া এবং অপহৃতা মেয়েরা’ এই লেখা তিনটির পৃথক উল্লেখ জরুরি। প্রাবন্ধিক খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন, “বঙ্কিমচন্দ্রের নারীরা সকলেই প্রায় অপূর্ব সুন্দরী, সেই সৌন্দর্যময়ীদের মিছিলে হয়তো একমাত্র ব্যতিক্রম ভ্রমর।” (পৃ ৭৭) সেই ভ্রমর অপটু হস্তাক্ষরে, সুন্দরী বিধবা রোহিণীতে আসক্তা গোবিন্দলালকে লিখতে পেরেছিল বৈপ্লবিক একটি বাক্য, “যতদিন তুমি ভক্তির যোগ্য, ততদিন আমারও ভক্তি, যতদিন তুমি বিশ্বাসী, ততদিন আমারও বিশ্বাস।”
প্রবন্ধসংগ্রহ, দ্বিতীয় খণ্ড
গোপা দত্ত ভৌমিক
৫০০.০০
এবং মুশায়েরা
মেয়েদের ‘অস্মিতাবোধ’-এর প্রসঙ্গে এ লেখাটিতেই কপালকুণ্ডলা-র প্রসঙ্গ সঙ্গত কারণেই তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন। বঙ্কিমের কপালকুণ্ডলা বলেছিল, “যদি জানিতাম যে, স্ত্রীলোকের বিবাহ দাসীত্ব, তবে কদাপি বিবাহ করিতাম না।” এ সূত্রেই প্রাবন্ধিক সিমোন দ্য বোভোয়ার “ম্যারেজ টুডে স্টিল রিটেনস, ফর দ্য মোস্ট পার্ট, দিস ট্র্যাডিশনাল ফর্ম”— এই চেনা ভাবনা বাঙালি পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তবে বঙ্কিমকে সঙ্গত কারণে সমালোচনা করতেও দ্বিধা করেননি। সূর্যমুখী কুন্দর মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে তাকে অক্লেশে ভাগ্যবতী বলেছিল। গোপার প্রবন্ধের শেষ বাক্য “কুন্দকে ‘ভাগ্যবতী’ বলা আধুনিক পাঠকের কাছে এক নিষ্ঠুর ঠাট্টার মতো শোনায়।” (পৃ ১০৯) বঙ্কিমের মন যে উভবলতার শিকার, সেই উভবলতার হাত থেকে বঙ্গজ সমাজ এখনও মুক্তি পায়নি।
রবীন্দ্রনাথ অংশের প্রথম লেখাটির নাম ‘অ-যোগাযোগের আখ্যান’। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক দু’টি উপন্যাস শেষের কবিতা ও যোগাযোগ। শেষের কবিতা-য় লাবণ্য অমিতকে প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছিল। যোগাযোগ-এর কুমু দাম্পত্য-ধর্ষণের শিকার। তার গর্ভে যে সন্তান এল, তারই জন্য ফিরতে হল স্বামীগৃহে। দাদা বিপ্রদাস কুমুকে পাশ্চাত্যে নারীবাদী সাহিত্যের কথা বলেছিল। এ প্রসঙ্গে অমিয় দেবের আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। কুমু অবশ্য সেই মেয়েদের মতো পারিবারিকতার বন্ধন উপেক্ষা করতে পারেনি। বুদ্ধদেব বসুকে রবীন্দ্রনাথ যোগাযোগ উপন্যাসের বৈপ্লবিক পরবর্তী খণ্ডের গল্প শুনিয়েছিলেন। তা লেখা হয়নি। গোপা দত্ত ভৌমিক রবীন্দ্রনাথের আঁকা একটি ছবিকে কুমুদিনীর পরিণতির সূত্রে মনে রেখেছেন। “রবীন্দ্রনাথের আঁকা একটি চিত্রে দেখা যায় চতুর্দিকে দাউ দাউ অগ্নিশিখার মধ্যে একটি দু হাত আকাশে ছুড়ে দেওয়া দীর্ঘাঙ্গী নারীমূর্তিকে— ঠিক তেমনি যেন কুমুদিনী ঘোষাল।” (পৃ ১৪৫)
বঙ্কিমচন্দ্র যে উভবলতা বহন করেছিলেন সেই উভবলতার চাপ রবীন্দ্রজীবনেও ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র পিতার অধীন ছিলেন না, রবীন্দ্রনাথ তো অনেক দিন অবধি মহর্ষির অধীন। ‘পলাতকা মেয়েদের দল’ প্রবন্ধে সে কথা মনে করিয়ে দেওয়া হল। আদি ব্রাহ্মসমাজ সংযুক্ত পরিবারের তরুণ রবীন্দ্রনাথ পিতার আদেশে বলেন্দ্রনাথের বিধবা স্ত্রী সাহানাকে বিধবাবিবাহের হাত থেকে ‘রক্ষা’ করার ‘দূত’ হিসেবে এলাহাবাদ যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, সঙ্গে ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ। মহর্ষির মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ সক্রিয় ভাবে দু’টি বিধবাবিবাহ দিয়েছিলেন। বিপত্নীক মধ্যম জামাতা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে ছায়ার বিবাহ দিলেন, পরের বছর পুত্র রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে বালবিধবা প্রতিমার বিবাহ সম্পন্ন হল। (পৃ ২৩০) তবে বঙ্গজ সমাজ তো অঙ্ক বইয়ের সেই তেল মাখানো বাঁশে ওঠার গল্প মনেপ্রাণে বহন করে। যেটুকু উঠল তার থেকে নেমে আসতে হয় বেশি। সুকুমার রায় তাই তাঁর ‘সৎ পাত্র’ কবিতায় উনিশ বার ম্যাট্রিকে ফেল করা গঙ্গারামকে পাত্র হিসেবে পাওয়ার পর ‘এমন কি আর মন্দ ছেলে?’ লেখেন। বাংলাদেশে তো মেয়েরা চিরকালই সস্তা! গঙ্গারামই নিঃসন্দেহে যোগ্য পাত্র! (পৃ ২৪৫)
সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে গোপা দত্ত ভৌমিক সুপরিচিত। মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য পড়া ও পড়ানোর ভাষায় সচরাচর মুদ্রাদোষের মতো যে বিশেষণপ্রিয়তা, মগজবিহীন আবেগের তারল্য, একভাষিক সঙ্কীর্ণতা ক্রিয়াশীল, গোপা দত্ত ভৌমিকের চিন্তন ও লিখনের ভাষা তার থেকে একেবারেই আলাদা। তাঁর প্রবন্ধগুলি ‘ছোট-অর্থে’ ছাত্র-ছাত্রীপাঠ্য নয়। তবে বাংলা সাহিত্যের পড়ুয়ারা এই লেখাগুলি পড়লে চিন্তাক্ষেত্রে কী ভাবে মুক্ত ও সংবেদনশীল হওয়া সম্ভব তা বুঝতে পারবেন। আর লেখাগুলি সাহিত্যপ্রেমী সাধারণ বাঙালি পড়ুয়াদের মগজ ও মনের পক্ষে উপকারী।
আশা করি বাঙালি পাঠকের মগজের মন ও মনের মগজ এই লেখাগুলি জাগিয়ে তুলতে পারবে।
বিশ্বজিৎ রায়