নেতৃত্ব: রামগড় কংগ্রেসে যোগদানের পথে মহাত্মা গান্ধী, রাজেন্দ্র প্রসাদ প্রমুখ। ১৯৪০।
ইতিহাসের বিতর্ক,
বিতর্কের ইতিহাস: অতীতের ভারত ও
আজকের গবেষণা
সম্পা: প্রত্যয় নাথ ও কৌস্তুভ মণি সেনগুপ্ত
৬০০.০০
আনন্দ
বারো জন লেখকই আশির দশকের সন্তান— কেউ কলেজে পড়ান, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে, দু’-এক জন পুরো সময়ের গবেষণায় ব্যাপৃত। প্রায় সবারই কিছু না কিছু আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা রয়েছে। কেউ সবে বই বার করেছেন, কেউ এখনও লিখছেন, কারও বই যন্ত্রস্থ। এই ‘উঠতি’ লেখকরা হঠাৎ বাংলা ভাষায় এমন একটা রাজানুকূল্যহীন, ছাত্রমুখী কাজ করতে যে একত্র হলেন, সেটা (আমাদের ভাষার দুর্ভাগ্যই বলতে হবে) একটা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আজকাল উজ্জ্বল ইতিহাসবিদরা কর্মজীবনের এই পর্যায়ে এ রকম কাজ করেন না।
করেন না বলে কেবল বাংলা-জানা ছাত্রদের সঙ্গে ইংরেজিতে দড় ছাত্রদের একটা বড় ব্যবধান ঘটে যাচ্ছে। স্বদেশি হোক, বিদেশি হোক, উপমহাদেশের ইতিহাস নিয়ে অধিকাংশ উচ্চমানের গবেষণাই ইংরেজিতে লেখা হয়। আগেও হত। কিন্তু আমাদের সব্যসাচী মাস্টারমশাইরা অনেকেই ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতেও বিবিধ মৌলিক লেখা লিখেছেন। নানা জটিল কারণে গত কয়েক দশকে এই ধারায় একটা ভাটা এসেছে। অন্য দিকে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জনচরিত্র পাল্টানোর একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে, অনেক বেশি ছাত্র স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়তে আসছেন, অনেকেরই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার গাঁথুনি বাংলায়, অথচ বাংলা ভাষায় পড়ানোর মতো গবেষণাঋদ্ধ উচ্চশিক্ষার বই নেই। বাংলা মাধ্যম স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমিও অনেকের মতো এ নিয়ে মাঝেমধ্যে হা-হুতাশ করে থাকি।
কিন্তু আমাদের মতো অলস পাঠকের যা নেহাত আলগা আশঙ্কা, এই তরুণ তুর্কিদের কাছে সেটাই যুদ্ধপরিস্থিতি। তাঁরা পাদটীকাসঙ্কুল, দুরূহ পরিভাষাকণ্টকিত, পেশাদারি ইংরেজি সন্দর্ভের জটিল যুক্তিপরম্পরা প্রাঞ্জল বাংলায় উচ্চশিক্ষার্থী ও আগ্রহী পাঠকের কাছে সহজ ভাবে পেশ করার শক্ত কাজটি স্বীকার করেছেন। তাঁদের যত্ন ও শ্রমের সাক্ষ্য এই সঙ্কলনের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে। যিনি যে বিষয়ের উপর লিখেছেন, সেই ক্ষেত্রে নিজে প্রাথমিক সূত্র ঘেঁটে গবেষণা করেছেন, ফলে বিষয়বস্তুর উপর তাঁদের দখল গভীর। আবার বিশেষজ্ঞরা লিখলে অনেক সময়ে একটা একপেশে অত্যুৎসাহ-জনিত বাহুল্যের ভয় থাকে। কিন্তু খুব সচেতন ভাবেই পক্ষপাত না ফলিয়ে, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের অরণ্যে হারিয়ে না গিয়ে, একটা বিশেষ দাবি-প্রতিষ্ঠার হাতছানি সামলে এই দ্বাদশ অশ্বারোহী চেষ্টা করেছেন ইতিহাসরচনার বড় চালচিত্রের একটি পর্যায়ভিত্তিক, তথ্যনির্ভর আন্দাজ দিতে। সব প্রবন্ধই এক নির্দিষ্ট বিষয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মূল বিতর্ক কী নিয়ে, গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলির বক্তব্য ও যুক্তি কী কী, এখন কোন কোন দিকে নতুন গবেষণা চলছে, আট-ন’হাজার শব্দের মধ্যে তার কুশলী, নির্মেদ বিবরণ হাজির করেছেন। এ ধরনের বইয়ে কোন কোন ইতিহাসবিদকে প্রাপ্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হল, ইতিহাসের কোন ধারার শরিকি ভাগে কতটা কম পড়ল, তা এক চিরন্তন তর্কের ব্যাপার। এই তর্কের সর্বজনগ্রাহ্য মীমাংসা সম্ভব তো নয়ই, হয়তো কাম্যও নয়। প্রত্যয় নাথ লিখেছেন, “ইতিহাসে শেষ কথা বলে আদৌ কিছু হয় না। ...একেক সময়ের ইতিহাসবিদ একেক ভাবে একই অতীতকে পড়েন ও একেক রকমের ইতিহাস লেখেন।” কেন, কোন সময়ে, কিসের তাগিদে, কোন সূত্র ব্যবহার করে কোন ইতিহাসবিদ কোন ব্যাখ্যায় উপনীত হয়েছেন, পেশার বাইরের মানুষকে তা বোঝানোই উদ্দেশ্য।
প্রবন্ধগুলির বিষয় নির্বাচনে পাঠ্যক্রমের দাবি স্বভাবতই গুরুত্ব পেয়েছে। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস নিয়ে আছে তিনটি প্রবন্ধ। আর্য-সমস্যা নিয়ে লিখেছেন জয়িতা পাল, রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে দেবকুমার ঝাঁজ, প্রাচীন ভারতে ইতিহাসচেতনা বিষয়ে ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক তর্কাতর্কির বিবরণ নিয়ে কণাদ সিংহ। এই উপমহাদেশের মধ্যযুগের গোড়ার দিকের অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থাকে সামন্ততন্ত্র বলা যায় কি না, এই পুরনো তর্ককে নতুন করে ঝালিয়েছেন সংযুক্তা দত্ত। মধ্যযুগের ভারতে ইসলামের ইতিহাসচর্চায় উনিশ, বিশ ও একুশ শতকের নানা বাঁকবদল নিয়ে ঈর্ষণীয় মুনশিয়ানায় লিখেছেন কাশশাফ গনী। মোগল রাষ্ট্রের চরিত্রের উপর প্রত্যয় নাথের দাপুটে প্রবন্ধটি সুখপাঠ্যও বটে। শান্তনু সেনগুপ্ত বেছে নিয়েছেন ষোলো থেকে আঠারো শতকের ভারত মহাসাগরের ইতিহাস। পাঠ্যসূচিতে খানিক অবহেলিত বিষয়টিতে তাঁর নিপুণ ভাষ্য প্রশংসার দাবিদার। আবার অষ্টাদশ শতাব্দী অবক্ষয় ও সঙ্কটের সময়, না কি আঞ্চলিক সমৃদ্ধির, সে কি ঔপমহাদেশিক ইতিহাসের ধারায় ছেদ না ধারাবাহিকতার প্রকাশ, ছাত্রদের কাছে এই পরিচিত অথচ জটিল বিতর্কের চমৎকার সারসংক্ষেপ করেছেন কৌস্তুভ মণি সেনগুপ্ত। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উপর বিশেষ নজর রেখে ভারতে জমি-জঙ্গল ও কৃষি-পরিবেশ নিয়ে ছয় দশকের ইতিহাস-গবেষণার দক্ষ মানচিত্র এঁকেছেন দেবারতি বাগচী। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে লেখা মিমাষা পণ্ডিতের প্রবন্ধটি হয়তো কিছু নতুন জরুরি লেখা ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কথোপকথনে এলে আরও জোরদার হত, তবে দেশভাগের ইতিহাস নিয়ে অন্বেষা সেনগুপ্তের ঠাসবুনোট অধ্যায়টি অভিজ্ঞ ও অনভিজ্ঞ পাঠকের কাছে সমান জরুরি। ঔপনিবেশিক ভারতের তুলনায় ঔপনিবেশিকোত্তর ইতিহাস নিয়ে প্রামাণ্য বই এমনিতে কম, কিন্তু সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, সাংবিধানিকতা, নাগরিকতার ইতিহাস নিয়ে ঋতজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলোচনা জোরালো ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন।
ভাষার প্রাঞ্জলতার কথাটা বিশেষ করে উল্লেখ করা দরকার। তপন রায়চৌধুরীর ঠাট্টা ধার করে বলতে গেলে, ইংরেজি না জানলেও যে বাংলা বোঝা যায়, এ বইয়ের প্রায় সব প্রবন্ধই সে রকম বাংলাতে লেখা। খটোমটো পরিভাষা যথাসম্ভব বর্জন করে, বুঝিয়ে বলার দিকে লেখকদের ঝোঁক। কিন্তু যে ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়, সেখানে তাঁরা বন্ধনীর মধ্যে বাংলা হরফে ইংরেজি পরিভাষাটি দেওয়ার রীতি অবলম্বন করেছেন। তার দু’-একটা প্রথমে কানে লাগলেও হয়তো পরে সয়ে যাবে (‘আর্লি মডার্ন’-এর বাংলা ‘আদি-আধুনিক’)। কয়েকটা হয়তো টিকবে না। ‘ফিউডালাইজ়েশন’-এর বাংলা ‘সামন্তায়ন’ না হয়ে ‘সামন্ততন্ত্রীকরণ’ কেন হল, ‘অ্যানথ্রোপলজি’কে নৃবিদ্যা বা নৃতত্ত্ব না বলে নৃকুলবিদ্যা বলার দরকার কী, এ সব চুলচেরা পারিভাষিক তর্ক থাকবে। আসল কথা, এমন দু’-একটা শব্দে লেখকদের সহজ গদ্যের গতি আটকায় না। তবে সাধারণ পাঠকের কাছে মাঝেমধ্যে একটু শুকনো ঠেকতে পারে। লেখাগুলি আর একটু সাহিত্যরসসিঞ্চিত হলে হয়তো ভাষার প্রসাদগুণ বাড়ত। সম্ভবত যথেষ্ট অ্যাকাডেমিক হবে না, এই ভয়ে প্রবন্ধকাররা ছাত্রদের চেনাজানা সাংস্কৃতিক উদাহরণের উল্লেখ থেকে বিরত থেকেছেন, যদিও এই সঙ্কলনে আলোচিত প্রতিটি বিতর্কের প্রতিধ্বনি আমাদের সমকালীন জনপরিসরে সহজেই পাওয়া যায়। যোগাযোগের সে সূত্র ধরিয়ে দিলে ছাত্র ও অ-বিশেষজ্ঞ পাঠকের আরও সুবিধা হত।
প্রতিষ্ঠিত, প্রামাণ্য গ্রন্থগুলির সঙ্গে সঙ্গে একদম নতুন, সম্ভাবনাময় কাজের হদিস দেওয়ার দিকেও লেখকেরা নজর রেখেছেন। প্রতিটি প্রবন্ধের শেষে গোটা পঞ্চাশ করে আলোচিত বই ও প্রবন্ধের তালিকা দেওয়া আছে। যেখানে যেখানে বাংলায় প্রাসঙ্গিক লেখালিখি হয়েছে, সেগুলো তাঁরা খেয়াল করে উল্লেখ করেছেন। ইংরেজি লেখাগুলির বাংলা অনুবাদ থাকলে অনেক ক্ষেত্রেই সে দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। লেখাগুলির গঠনভাবনা, পরিভাষা-ব্যবহার, পাদটীকার শৈলী, এমন নানা ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সম্পাদকদের কড়া নজর। এক-একটি লেখা অন্য লেখার সূত্র ধরিয়ে দিয়েছে। বারোটি পৃথক প্রবন্ধের জোড়াতালি সেলাই না হয়ে এটি সামগ্রিক ভাবে একটি বই হয়ে উঠেছে। প্রবীণ ইতিহাসবিদ রণবীর চক্রবর্তীর লেখা উৎসাহী ভূমিকাটিও এই সঙ্কলনের সম্পদ।
আশা, এটি নির্জন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে না। নয়তো, ইতিহাস গবেষণা আর ইতিহাস পড়ানোর মধ্যে বাড়তে-থাকা ফাটল যে ইতিহাসবিদের পেশার সামাজিক অস্তিত্বই বিপন্ন করে তুলবে!