Handloom Artisans of Bengal

আখ্যানের বুননে ধরা ইতিহাস 

শিশিরের জলে হত সুতো মাড়ি।” সময় বদলেছে, আজকের সবচেয়ে সূক্ষ্ম কাপড়ের সুতোর নম্বর ১২০। তবে বুনন প্রক্রিয়ার জটিলতা ও তাঁতির কাজের যত্ন আজও রয়েছে।

Advertisement

মানসরঞ্জন ভৌমিক

শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০২৩ ০৭:০৭
Share:

গ্রাম বাংলার তাঁত শিল্পীরা। — ফাইল চিত্র।

দেশভাগ, উদ্বাস্তু মানুষদের ভারতে আসা, পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ সংলগ্ন এক অঞ্চলে ও-পার বাংলা থেকে তাঁতিদের আগমন। এই পরিপ্রেক্ষিতেই শুরু হচ্ছে এই বইয়ের কাহিনি। প্রথাগত নায়ক-নায়িকাহীন এই আখ্যানে মূল চরিত্র তন্তুবায় সমাজ। তাঁত ও তাঁতির (হস্তচালিত বা হ্যান্ডলুম) ইতিহাস-ভূগোল-অর্থনীতি-সমাজনীতির পরিমণ্ডলেই আবর্তিত হয়েছে বই। পড়তে পড়তে পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাস, ‘শিল্পী’ গল্পের মদন তাঁতির কথা মনে আসতে পারে। তাঁত নিয়ে আজও নানা শাখায় প্রচুর গবেষণা হচ্ছে, সেই গবেষকদের জন্য তন্তুবায় বিষয়ক সরস প্রথম পাঠ হওয়ার দাবি রাখে এই বই। লেখকের বাস্তব রক্তমাংসের অভিজ্ঞতায় পরতে পরতে জারিত এর প্রতিটি পৃষ্ঠা। এটি উপন্যাস, না কি ডকু-ফিচার, না কি সৎ বস্তুনিষ্ঠ এক দলিল, তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। তবে তন্তুবায় সমাজের হাসি-কান্না, স্বেদ-রক্ত, পতন-অভ্যুদয়ের যে চিত্র দুই মলাটের মধ্যে মুনশিয়ানার সঙ্গে ধরা আছে তাঁর ঐতিহাসিক গুরুত্ব প্রশ্নাতীত।

Advertisement

মসলিন বয়নের ইতিহাস, টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিহাস, দেশভাগের পটভূমিতে তন্তুবায় সমাজের একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান মহাজনব্যবস্থার সমৃদ্ধি— সবই উঠে এসেছে লেখায়। ‘নিউ ইনস্টিটিউশনাল ইকনমিক্স’ বা ‘ইকনমিক্স অব অর্গানাইজ়েশন’-এর আপাত-জটিল সন্দর্ভ প্রাঞ্জল ভাষায় বলা হয়েছে, যখন বিস্তারিত ভাবে লেখক তাঁত সমবায়ের কথা আনলেন। তাঁত সমবায় (সমিতি) ও মহাজনব্যবস্থার তুলনামূলক যে আলোচনা লেখার পরতে পরতে মিশে আছে তা বইটির সম্পদ।

মসলিনের ইতিহাস, তাঁতশিল্পের অপরিসীম যত্নের কারিগরির ইতিহাস ঢুকে পড়ে আখ্যানে। “কালনার খাদি সমিতির এক প্রবীণ কারিগর সাহস করে আদ্যিকালের মসলিনের সূক্ষ্ম সুতো তৈরির চেষ্টায় নেমেছিলেন। অনেক খেটেখুটে চরকায় কেটে তিনি ৫০০ কাউন্ট পর্যন্ত উঠতে পেরেছিলেন।… এই সুতোয় কাপড় বুনে তিনি ‘শিল্পগুরু’ সম্মান পেয়েছিলেন ভারত সরকার থেকে। তাঁতশিল্পে এটাই সর্বোচ্চ সম্মান এ দেশে।… আর মসলিনের সুতোর নম্বর ছিল কত? পনেরোশো কাউন্ট… সাধে কি আর খালিচোখে অদৃশ্য সে সুতো! সাধে কি আর সে সুতো দেখতে অণুবীক্ষণ লাগে! সেই সুতোয় তৈরি কাপড় মেলে দিলে সাধে কি আর ঘাসের মধ্যে হারিয়ে যায়! সাত ফেরতা করে পরলেও মেয়েমানুষেরে নগ্ন দেখায়!” মসলিনের ইতিহাস আলোচনায় আসে বুনন প্রক্রিয়ার কথাও। “সুতো তো কাটা হল, এ বার সেই ‘সোহাগী’ সুতোর মাড়ি করতে হবে, পাড়ি করতে হবে। শীতের খুব ভোরে মেয়েরা ঘটি নিয়ে চলে যেত কাশবনে… ঘটিতে শিশির ধরে আনতে। ওই শিশিরের জলে হত সুতো মাড়ি।” সময় বদলেছে, আজকের সবচেয়ে সূক্ষ্ম কাপড়ের সুতোর নম্বর ১২০। তবে বুনন প্রক্রিয়ার জটিলতা ও তাঁতির কাজের যত্ন আজও রয়েছে। বুনন প্রক্রিয়ার এত যত্নের দাম বাজারের নিয়মের চাহিদা–জোগান কী ভাবে নির্ধারণ করবে!

Advertisement

লিঙ্গবৈষম্যের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কেও ধরা হয়েছে এই আখ্যানে। “বধূ নির্যাতন বলতে যা বোঝায়, সে জিনিস তাঁতিদের মধ্যে খুব বেশি দেখা যেত না। কারণ, বউ না থাকলে তাঁতির তাঁত বোনা চুলোয় যায়।… ঘরগেরস্থালির কাজ… আর সবার উপরে রয়েছে তাঁতের জোগানদারির কাজ।… তাই বউকে যন্ত্রণা দিয়ে নিজের যন্ত্রণা বাড়াতে চাইত না কোনও তাঁতি।” দেশভাগ–অর্থনীতি-জাতপাত-প্রেম-বিরহ, সম্পর্কের জটিল রসায়ন, তন্তুবায় সমাজকে ঘিরে এই মিশেল বইটিকে নানা রুচির পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement