শিল্পী: ইন্দ্রাণী বর্মণ
স্বাধীনতার পর ভারত সরকারের উদ্যোগে সাহিত্য, সংগীত, নাট্যকলা ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য দিল্লিতে বিভিন্ন জাতীয় অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। শিল্পকলার জন্য ললিতকলা অ্যাকাডেমির সূচনা হয় ১৯৫৪ সালে। ক্রমান্বয়ে তা বিস্তৃত হয় বিভিন্ন আঞ্চলিক শাখায়।
কলকাতার আঞ্চলিক কেন্দ্রটি খোলা হয়েছিল ১৯৮৪ সালে, দিল্লিতে মূল অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পরে।
কেয়াতলায় ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর স্টুডিওতে এই কেন্দ্রটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। তার পর থেকে নানা অভাব ও সমস্যার মধ্য দিয়েও এই কেন্দ্র নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে যাচ্ছে।
পূর্বাঞ্চলের শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা ও অনুশীলনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এর অবদান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তবু এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণ বিকশিত হতে পারেনি এই কেন্দ্র। এখনও এর নিজস্ব প্রদর্শনী কক্ষ বা গ্যালারি নেই। নেই স্থায়ী কোনও সংগ্রহালয়।
এ সব অভাব সত্ত্বেও শিল্পীদের উৎসাহ ও ঐকান্তিক প্রয়াস এই প্রতিষ্ঠানটিকে সঞ্জীবিত রেখেছে। সম্প্রতি এখানে অনুষ্ঠিত হল— এর সঙ্গে যুক্ত ৪২ জন শিল্পীর কাজের প্রদর্শনী ও কলামেলা। এখানে যাঁরা গবেষণার জন্য যুক্ত থাকেন এবং এর স্টুডিও ব্যবহার করে যাঁরা নিয়মিত অনুশীলন করেন— এই দুই ধারার শিল্পীদের কাজ নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনী। এ ছাড়া নানা রকম কারুকলা প্রদর্শন ও বিপণনের ব্যবস্থাও আছে। অধিকাংশ শিল্পীই চেষ্টা করেছেন প্রচলিত রূপরীতির বাইরে গিয়ে নতুন আঙ্গিক ও ভাবনাকে তুলে ধরতে। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষাই প্রদর্শনীটিকে তাৎপর্যপূর্ণ করেছে।
এই পোস্ট-পোস্টমডার্ন সময়ে সারা দেশ ও বিশ্ব জুড়েই এক নৈরাজ্যের পরিমণ্ডল বিস্তৃত। দেশ-কাল ও জীবন সম্পর্কে গভীর এক সংশয় শিল্পীর ভাবনাকেও বিপর্যস্ত করে। সেই অনিকেত সংশয়ই যেন এই প্রদর্শনীর প্রধান সুর।
আবির চট্টোপাধ্যায়ের কালি ও অ্যাক্রিলিকের রচনা ‘ক্রিপি নাইট’, অমিত ভট্টাচার্যের কালি ও জলরঙের ছবি ‘ওয়াকিং থ্রু ডেসটিনি’, অম্লান দত্তের টেম্পারা ‘স্পিরিচুয়ালিটি ইন মি’, অপু দাশগুপ্তের জলরং ‘দ্য ম্যান উইথ রেড’, অসীম পালের অ্যাক্রিলিক ‘ডাউন দ্য মেমোরি লেন’ ইত্যাদি কাজে এই সংশয়েরই প্রতিফলন। তাঁরা মেনে নিতে পারছেন না এই পরিস্থিতিকে। অথচ নিষ্ক্রমণের পথও জানা নেই। এই বেদনা প্রতিবাদ হয়ে দেখা দিচ্ছে তাঁদের রচনায়। প্রচলিত অভিব্যক্তিবাদী প্রতিবাদী রূপরীতিতে তাঁরা পরিতৃপ্ত নন। গড়ে তুলতে চাইছেন নতুন প্রকাশভঙ্গি। কিন্তু পৌঁছতে পারছেন না অভীষ্ট লক্ষ্যে। এই টানাপড়েনই এই প্রদর্শনীর মূল সুর।
মেরি বোরা তেলরঙে এঁকেছেন ‘লোকাল ট্রেন’ শিরোনামে এক ট্রেন যাত্রার দৃশ্য। ভিড় ও অব্যবস্থায় বিপর্যস্ত যাত্রীরা আর্তনাদ করছে। এডওয়ার্ড মুঙ্ক-এর সেই আর্তনাদ, যা আধুনিকতার অনিবার্য ভবিতব্য, সেটাই ফুটে উঠেছে রূপায়িত প্রতিটি যাত্রীর চোখেমুখে। এই সংশয় থেকেই উঠে এসেছে অভিমুখহীনতা। কী করতে চাইছেন, সে সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই, এ রকম রচনাও রয়েছে।
মোহনা দত্তর ‘নস্টালজিয়া অব লাইফ’ এ রকম রচনার কয়েকটি দৃষ্টান্ত। এর মধ্যে কেউ কেউ আছেন, যাঁরা ঐতিহ্যের স্মৃতিকে আধুনিকতায় উদ্ভাসিত করেছেন। দশরথ দাসের ড্রয়িং ও প্রিন্ট ‘মাই ড্রিম’ এর অনবদ্য দৃষ্টান্ত। জয়স্মিতা দে-র ‘হ্যাপি ফেস’ শীর্ষক কাঠ খোদাইটিও মনে রাখার মতো। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও মননের প্রকাশে উজ্জ্বল সিদ্ধার্থ ঘোষের এচিং। বিষ্ণু দাস তার ‘হি’ শীর্ষক ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যে প্রকাশের নতুন অভিমুখ তৈরি করেছেন। এই কেন্দ্রের সিরামিক বিভাগটি যথেষ্ট উন্নত। সেই তুলনায় কাজের সংখ্যা কম।
মৌসুমী রায়ের সিরামিক স্টোনওয়ারের নিসর্গ, সতীশ চন্দ্রের বিশ্লিষ্ট পাত্রের উপস্থাপনা সিরামিকের নানা সম্ভাবনাকে তুলে ধরে। শিবরাম দাসের সিরামিক ‘সুইচ বোর্ড’— বাস্তব ও শিল্পের ব্যবধানকে অবলুপ্ত করতে চায়।