বুনো স্ট্রবেরি। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। দে’জ, ১৫০.০০
দুই কালীঘাট আসলে একই কালীঘাট। একটি উপন্যাস আর একটি স্মৃতিকথা। বলতে গেলে কি দুই লেখক মহাতীর্থ কালীঘাট সিনেমা লিখেছেন দুই ভাষায়। আমার বাল্যে মা-বড়মামির সঙ্গে সেই সিনেমায় কী দেখেছিলাম তা আর মনে নেই, যা মনে রাখার নয় বিস্মরণই তার ভবিতব্য। আমাকে নতুন করে নগর কলকাতার এই ক্ষয়িষ্ণু প্রাচীন জনপদকে চিনিয়েছেন দুই লেখক। জয়ন্ত দে তাঁর নতজানু উপন্যাসে যে বিধ্বংসী কালীঘাটের কথা লিখেছেন, আর যে কালীঘাটের কথা লিখেছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বুনো স্ট্রবেরি গ্রন্থে তা অধার্মিক এই প্রতিবেদকের কাছে মহাতীর্থ দর্শনই হয়ে ওঠে। মাতৃমন্দিরের ঘৃত প্রদীপের পিলসুজের নীচে যে অন্ধকার সেই অন্ধকার কালীঘাট আর প্রদীপের অনুজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত মুখচ্ছবি নিয়ে নতজানু উপন্যাস। এই নগর নিয়ে যে গল্প পড়েছি মতি নন্দীর তা উত্তর কলকাতা, এই নগর নিয়ে, নগর কলকাতার ছোট এক জনপদ নিয়ে, আর এক অকথিত সময় নিয়ে উপন্যাস রচনা তেমন হয়েছে বলে জানা নেই। সময়ই এর মূল চরিত্র। কালীঘাটের কথা আমি প্রেমেন্দ্র মিত্রতে পেয়েছি। বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে, সংসার সীমান্তের কালীঘাট আর জয়ন্ত দে-র কালীঘাট আলাদা হয়েও এক, এক হয়েও আলাদা। জয়ন্ত যে কালীঘাটের ছবি এঁকেছেন তাঁর এই বৃহৎ উপন্যাসে তা মন্দিরের সেবায়েত এক হালদার পরিবারকে নিয়ে। সেই পরিবারের বালক মুকুট যে সময়ে বড় হয়ে ওঠে সেই সময়ের সাদা কালো জীবনই এই উপন্যাস। এমন সত্য এখানে উচ্চারিত যা ছিল অশ্রুত। চেনা শহর আর এই প্রাচীন জনপদ অচেনা হয়েই বারবার ধরা দিয়েছে আমার কাছে। পড়তে পড়তে বিস্মিত হয়েছি কত বার। এ কোন শহর, চার্লস ডিকেন্সের সেই মস্তান, অন্ধকার জগতের শহর, অলিভার ট্যুইস্টের শহর ? রাস্তার এপারের ভদ্রপাড়া, রাস্তার ওপারের দেহোপজীবিনীদের খারাপ পাড়া, ভদ্রপাড়া আর খারাপ পাড়ার সীমারেখা, সীমারেখা পেরিয়ে আসা কিশোর কিশোরী, মন্দির, পাণ্ডা, মন্দির নিয়ে রাজনীতি, ১৯৭২ থেকে যুবশক্তির উত্থান, হত্যা, ক্ষুধা, রক্তপাত, ক্ষুধার্ত বালক বালিকা মিছরি, ফিটন, বেশ্যার কন্যা জুঁই, হালদার পরিবারের মস্তান পুত্ররা, শ্মশান, আদিগঙ্গা, গঙ্গার ওপার, পোটোপাড়া... সময়ের ছায়ায় ঢাকা এই উপন্যাস সময় থেকে বেরিয়ে সময়কে অতিক্রম করে জীবনের চিরকালীন মহত্বে পৌঁছেছে বারবার। মুকুটের জেঠা শ্রীনাথ মন্দির পরিচালনা সমিতির প্রধান। সৎ ব্যক্তি। শ্রীনাথের বড় ছেলে দেবু রাজনীতির আশ্রয়ে থাকা মস্তান, বাবাকে সরিয়ে মন্দির কমিটি দখল করতে চায়। অনেক টাকা সেখানে। তার জন্য সে বাবাকে প্রকাশ্যে ন্যাংটা করে দিতেও পিছু-পা হয় না। সে কী না পারে, পার্টির নামে বিধবার দোকান দখল করে নিজ দখল কায়েম করে। তার আর এক ভাই উমা এক দেহোপজীবিনী শশীর বাবু হয়ে থেকে তারই বড় হয়ে ওঠা মেয়ে জুঁইকে বিয়ে করে ঘরে তুলতে চায়। খারাপ পাড়া থেকে ভাই বোন মিছরি ফিটন মুকুটের জানালার সামনে তার খাবারের ভাগ নেওয়ার জন্য প্রতি সন্ধ্যায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে। একটা অঞ্চল তার শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। তার ক্লেদ আর প্রতিমা গড়ার মাটির গন্ধ ভেসে উঠেছে আখ্যান জুড়ে। লেখক যেন পোটোপাড়ার প্রতিমা শিল্পীর মতোই কাঠামো খড় মাটি কল্পনা, ভালবাসা, জীবনের প্রতি মুগ্ধতা নিয়েই নির্মাণ করেছেন এই উপন্যাস-প্রতিমা। নিরূপায় কিছু মানুষের এই কাহিনি চিনিয়ে দিয়েছে সেই চল্লিশ বছর আগের নৈরাজ্যের সময়, আমাদের জানা আর চেনা মূল্যবোধের সঙ্গে সময়ের নৈরাজ্যের ভয়ানক অমিল। পড়তে পড়তে দম বন্ধ হয়ে আসে। মুকুটের দিদি, শ্রীনাথের কন্যা, দুই মস্তানের বোন পুতুল যে উৎকল যুবকের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে হারিয়ে যায়, সেই পন্ডাদা তো বিবাহিত পুরুষ। পুতুলের খোঁজ কেউ করে না। আবার খুনে মস্তানের বোন যে তুলতুলকে বিয়ে করে আনে দেবু, তার ভিতরের আগুন যেন শীতার্তের উষ্ণতা। কী ভাল অঙ্ক জানে বউদি। মুকুট সেখানে শ্বাস নিতে পারে। প্রায় ভিখিরি মেয়ে মিছরির সঙ্গে মুকুটের ছিল অনুচ্চারিত ভালবাসা। লেখার গুণে, বিশ্লেষণে দুই কিশোর কিশোরীর সম্পর্ককে সোনার জলে লিখেছেন লেখক। মিছরি বাস্কেটবল খেলতে রাজ্যদলে সুযোগ পায়। এইটুকুই যা প্রদীপ শিখায় উদ্ভাসিত মুখ। বাকিটা প্রায় কালো শহর কালো সময়। পুত্রের লোভ আর হিংস্রতার কাছে পরাজিত শ্রীনাথ আত্মহননে যায়। কী ভয়ানক সময় ঘনিয়ে এসেছিল যে সেই বছর ৪৫ আগে। বাংলা উপন্যাস নিয়ে হতাশ পড়ুয়া যাঁরা উচ্চারণযোগ্য একটিও সমকালীন বাংলা উপন্যাসের নাম খুঁজে পান না, তাঁরা পড়ুন না পড়ুন, আমাদের এই সময়ে উপন্যাসের মতো দুরূহ শিল্পে নিমগ্ন হয়েছেন যে নবীন উপন্যাসকাররা তাঁদের চিনে নিতে এই বই যথার্থ।
নতজানু। জয়ন্ত দে। মিত্র ও ঘোষ, ৪০০.০০
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের মেধাবী কলমে আমরা সিনেমার কথাই শুনেছি। তাঁর এই বই বুনো স্ট্রবেরি-ও সিনেমার ছায়াটি রেখে দিয়েছে নামে। নামে কী আসে যায়। আসে যায়, সঞ্জয়ের কালীঘাটে মানুষজন যেন সেই বুনো স্ট্রবেরির মতো যত্রতত্র জন্মেছে। এই বই কালীঘাট অঞ্চলের তুচ্ছাতিতুচ্ছ মানুষজন নিয়ে এক বালকের স্মৃতি কণ্ডূয়ন। প্রায় এক সময়ে লেখা দুই বইয়ে দুই আঙ্গিকে যেন একই কালীঘাট দুই রকমে উঠে এসেছে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের শেষ থেকে ষাটের দশক, সত্তর দশকের কলকাতা এই বইয়ে এসেছে অনেকটা সামাজিক দলিলের মতো। নগর কলকাতার এক টুকরো অংশকে সঞ্জয় যে ভাবে চিত্রিত করেছেন তা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কথনেই বিশিষ্ট। সঞ্জয়ের দেখার ভিতরে যে তির্যকতা তা এই বইকে আলাদা করেছে আর পাঁচটি বই থেকে। শ্লেষ, রসিকতা সঞ্জয়ের দেখা আর লেখায় জড়িয়ে থাকে। সেই গুণে বইটি পড়তে পড়তে কালীঘাটের ভিতর দিয়ে পুরো শহরটাকেই দেখতে পাই। আমিও এই শহরে বাৎসরিক খোস-পাঁচড়া, ঢোলা হাফ প্যান্টুলুন নিয়েই বড় হয়েছি। আবার সেই সময় নিজেকে চিনতে চিনতে বুনো স্ট্রবেরি-তে ডুবেছি। চিন যুদ্ধ, চিনামাটির কাপ আছড়ে ভাঙা, চিনা বাদাম বর্জন, পাকিস্তান যুদ্ধ, কাবুলিওয়ালার হেনস্তা, টেলিগ্রাম, নেহরু আর নাই..., কালীঘাটের সঙ্গে টালার কোনও তফাত নেই। হ্যাঁ, তফাত অবশ্যই আছে, তা দেখার ধরনে। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের তির্যকতা অসামান্য। শ্লেষ আছে আবার নিতান্ত রসিকতাও আছে। ঋত্বিক ঘটকের মৃত্যুর পর ঋত্বিক স্মরণে ৭২ ঘণ্টা সাইকেল চালানো প্রতিযোগিতা কিংবা ঋত্বিক ঘটক মুলীবাঁশ কার্যালয় প্রতিষ্ঠা। কালীঘাট, সঙ্ঘশ্রীর দুর্গাপুজো, কেওড়াতলা মহাশ্মশান, সত্যজিতের মৃত্যুর পর সেই ভুবনবিদারী ডাক, ‘সাহাদা’— সঞ্জয় স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেছেন সময় থেকে সময়ান্তরে পরিভ্রমণে। বইটির ২৮টি অংশ। ২৮ অংশ ২৮ রকম। কোনওটি কোনওটির মতো নয়। ১৮০ ডিগ্রিকে ২৮ ভাগে ভাগ করে ২৮টি কোণ থেকে নানা রঙের কালীঘাট এঁকেছেন তিনি। তার ভিতরে লোকাল কমিউনিস্ট নেতা, পার্টি কর্মী সব আছে। আছে চিরকুমারী শিক্ষিকা, প্রতিবাদী নেত্রী। লেখকের সহমর্মিতা আছে, কিন্তু তা লুকিয়ে রেখে জীবনের বিচিত্র রূপ এঁকেছেন তিনি। এমন বাস্তবতা যে স্তম্ভিত হতে হয়। কালীঘাটে যা আছে, তা টালায় নেই। উঁচু তক্তপোশের নিচে সহপাঠীর সঙ্গে বাগানের ক্ষেত্রফল কষে বের করছে কিশোর, উপরে বন্ধুর মায়ের বাবু এসেছে। তক্তায় ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দ। বোঝা যায়নি সবটা তাদের অপরিণত মস্তিষ্কে তখন। বাবু জামা কাপড় পরে চলে গেলে শায়া পরা বন্ধুর মা তার গাল টিপে মিষ্টি খাওয়ার টাকা দেন (কালীঘাটের মা-জননী)। বুনো স্ট্রবেরি-র জন্ম হেথাহোথা, তীব্র গন্ধ বাতাসে ভেসে আসে, সবই পাওয়া যায় এই বইয়ের পাতায় পাতায়। ‘কালীঘাটের কুকুর’ পড়তে পড়তে ভাবি কত তুচ্ছ সারমেয়কুল আর মন্দিরের লোভী সেবায়েত পালাদার হাওলাদার হালদাররা। লেখকের কলমে বুনো ডেওয়ার গন্ধ। আঁচড়ে আঁচড়ে তিনি মন্দির কাহিনি যা শুনিয়েছেন তার অনেকটাই অকথিত। আর তার সঙ্গে কালীঘাটের কুকুরের যে কথা শুনিয়েছেন, তা বড় কষ্টের, লেখার গুণে মুগ্ধতা আনে। সঞ্জয়ের ইতিহাসবোধ অসামান্য। তা পেয়েছি নানা লেখায়। এক কালীঘাট নিয়ে দুই বই আমাকে সম্পূর্ণ কালীঘাটের সমুখে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। দুই লেখককে অভিনন্দন।