আরেকটা কলকাতা
সুপ্রিয় চৌধুরী
২৫০.০০ , আনন্দ পাবলিশার্স
‘‘এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা/ হেঁটে দেখতে শিখুন...।’’ শঙ্খ ঘোষের এই পংক্তি তো অনেকেরই পড়া, কিন্তু সত্যিই কি শহরটাকে হেঁটে দেখতে শিখেছি আমরা? তা হলে সুপ্রিয় চৌধুরীর নতুন বইটি একনিঃশ্বাসে পড়ে ফেলে আজন্ম এই শহরবাসী কোনও পাঠকের মনে হত না, কলকাতার অনেক কিছুই জানা হয়নি! লেখকের পায়ের তলায় সর্ষে, কারণে-অকারণে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন কলকাতার ‘‘বহু জানা-অজানা, উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যে, কিঞ্চিৎ বেয়াড়া আর বিপজ্জনক সব রঙরুটে।’’ আর এই চলার পথেই তাঁর নজরে পড়েছে এমন অনেক কিছু, যা দৈনন্দিনের যাত্রাপথে চোখের আড়ালেই থেকে যায়। বনেদি কলকাতার লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য নিয়ে অশ্রুবর্ষণ তাঁর উপজীব্য নয়, তিনি বইয়ের অনেকটা জুড়ে আলোকিত করেছেন কলকাতার তথাকথিত অন্ধকার জগৎকে। মস্তানদের বিবর্তন থেকে শুরু করে এই জগতের সাঙ্কেতিক ভাষা, হরেক কিসিমের জুয়ো, দিনরাতের ময়দান, ‘এসকর্ট গার্ল’ থেকে রামবাগান-দর্জিপাড়ার লালবাতি এলাকা, পকেটমার এমনকী ট্রামবাসে সতর্ক থাকতে ‘রঙরুট’-এর হদিশ, আর সারা রাতের ফুটপাথ। আর এরই মধ্যে উঁকিঝুকি মেরে যায় সুমনের গান, হারিয়ে যাওয়া পাখপাখালি আর জীবজন্তু, মেলা আর হাটবাজারবিপণি, শহরজোড়া ঢালাও খাবারের পসরা, আর সব শেষে চেনা শহরের ক’জন অচেনা মানুষ। তাঁর লেখায় বিষয়ের সঙ্গে ভাষারও যোগ্য সঙ্গত রয়েছে। এ বই পড়লে শহরটাকে অন্য চোখে দেখতে ইচ্ছে করবে, চাইকি একটু ভালবেসেও ফেলতে পারেন।
সদা থাকো আনন্দে... শান্তিনিকেতনে
দীপঙ্কর রায়
১৯৫.০০, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস
শান্তিনিকেতন নিয়ে তো কম লেখালেখি হয়নি, বহুচর্চিতও, তবু কবির স্বপ্নের আশ্রম সম্পর্কে কেমন যেন এক মায়াবি হাতছানি জেগে থাকে দীপঙ্কর রায়ের গদ্যে। যেমন পৌষ মেলা নিয়ে লিখছেন: ‘‘মেলায় রাত বাড়ে। ঠান্ডাও বাড়ে।... তারায় ভরা খোলা আকাশের নীচে, মাঠের মাঝে, বাদাম-ভাজা বিক্রেতার উনুনের নিভন্ত আগুনটুকু সম্বল। নাহ্! তার মনে চিন্তা জাগে, শীতের রাত আজ বড্ড লম্বা হবে।’’ এমনই আরও নানা অনুষঙ্গে শান্তিনিকেতন ক্রমবিস্তৃত হয় এ-বইয়ের পনেরোটি গদ্যে। তাতে নিসর্গ, ঋতুবৈচিত্র, আশ্রমিক ঐতিহ্য, শিল্পকলা, শিক্ষা, সমবায়ী বেঁচে থাকা, আদিবাসী সংস্কৃতি। বিশ্বভারতীর ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক এই মানুষটির কাছে বইটির রচনাদি ‘‘এক আত্মজৈবনিক আত্মানুসন্ধানও বটে।’’ নিজেই স্বীকার করেছেন তাঁর মুখবন্ধে। ফলে শান্তিনিকেতনের চাঁদ, খোয়াই, গান, নৈঃশব্দ্য, পাখির ডাক, বসন্তোৎসব, বাউলস্ফিয়ার প্রায় সুররিয়্যাল অচিনপুর আবিষ্কার হয়ে ওঠে তাঁর গদ্যে। ‘‘যে-তাড়নায় রবীন্দ্রনাথ বারবার কলকাতায় এসেও ফিরে যেতেন শান্তিনিকেতনে, তাঁর সেই বিশাল জীবনের আবেগানুভূতির দ্বন্দ্ব যে শিক্ষিত কলকাতাবাসীর মন আজও আলোড়িত করে, দীপঙ্করের রচনায় সেই কথাই বারবার মনে পড়ে যায়।’’— ভূমিকায় লিখেছেন দীপেশ চক্রবর্তী।
জগৎশেঠ
নিখিলনাথ রায়
২২০.০০, কল্লোল
প্রথম জীবনে চতুষ্পাঠীতে সংস্কৃত শাস্ত্র-সাহিত্য পাঠ করেন, পরে পাশ করেন ওকালতি। কিন্তু শেষাবধি স্মরণীয় হয়ে রইলেন বাংলার ইতিহাসের নষ্টকোষ্ঠী উদ্ধারের জন্য। নিখিলনাথ রায়ের প্রথম গ্রন্থ ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’ (১৮৯৭) তাঁকে বাংলার আঞ্চলিক ইতিহাসের অন্যতম পথিকৃতের সম্মান দিয়েছে, কিন্তু ইতিহাসবিদ হিসাবে তিনি সমধিক খ্যাতি পেয়েছেন ‘জগৎশেঠ’ (১৯১২) গ্রন্থের জন্য। প্রকাশের পরেই ব্রিটিশ সরকার বইটিকে বাজেয়াপ্ত করে। কিন্তু ঠিক কী কারণে এই সিদ্ধান্ত, লেখ্যাগারে অনেক অনুসন্ধানেও সেই সংশ্লিষ্ট নথির খোঁজ পাননি গবেষক নিখিল সুর। তুলনায় অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় তাঁর ‘সিরাজদ্দৌলা’ গ্রন্থে ইংরেজের বিরুদ্ধে অনেক কটু মন্তব্য করেছেন। বর্তমান সংস্করণের ভূমিকায় নিখিলবাবু লিখেছেন, ‘‘জগৎশেঠদের নিয়ে স্বতন্ত্র এবং সামগ্রিক ইতিহাস নিখিলনাথ রায়ের পূর্বে কেউ রচনা করেছেন বলে জানা যায় না। ‘জগৎশেঠ’ প্রকাশিত হওয়ার আট বছর পরে ১৯২০ সালে J. H. Little-এর The House of Jagat Seth প্রকাশিত হয় 'Bengal Past and Present' পত্রিকায়।’’ জগৎশেঠদের বৃত্তান্ত আঠারো শতকের বাংলার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেই পর্বের রাজনীতি-অর্থনীতি দুইয়ের সঙ্গেই জগৎশেঠরা অঙ্গাঙ্গি। রাজস্ব, বাণিজ্যে প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণ ছাড়াও শাসনকার্যে তাঁদের বুদ্ধি-পরামর্শ থাকত, মুদ্রা তৈরি হত তাঁদের মতানুসারেই। তাঁদের সম্পদ ছিল প্রবাদপ্রতিম। মুর্শিদাবাদের মসনদে বার বার রদবদল ঘটেছে তাঁদের অঙ্গুলিহেলনে। ইংরেজদের ক্ষমতায় আসার পিছনে জগৎশেঠদের ভূমিকা বড় কম ছিল না, কিন্তু শেষে আঠারো শতকের ঝঞ্ঝা তাঁদেরও পতনের কারণ হয়।