দ্য মর্টাল গড: ইম্যাজিনিং দ্য সভারেন ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া
মিলিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়
কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১৮
বিতর্কিত মন্দিরের বোধন হল তা হলে। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার শাসন আদৌ আর রইল কি না, সেই প্রশ্ন আবার সামনে। উত্তর দেবে সময়। তবে স্বাধীনতার আগে উপমহাদেশের মানুষ কেমন শাসন চাইছিলেন, তার ইতিহাসের প্রেক্ষিতেই সেই বিতর্ক হতে পারে। মিলিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই এই প্রেক্ষিতে আবার মনে পড়ে।
খুঁটিনাটিতে গত দু’শোর ওপর বছরে অনায়াস যাতায়াত এই বইয়ের। না কি আরও বেশি? গত দেড় হাজার বছরে গোটা বিশ্বে পলিটিক্যাল থিয়োলজি বিষয়ে বহু রকম চিন্তা নিয়ে ভাবনার ছায়া রয়েছে এতে। বহু রকম চিন্তন এবং মননের উত্তরসমালোচনাবাদী পাঠ।
গোড়াতেই স্বীকার করা যাক যে বইটির বিষয়বস্তুর সারসংক্ষেপ অল্পে সারা কঠিন কাজ। লেখকের মূল দাবি, সমস্ত মানুষ তাঁদের কেমন শাসন চাই সেই বিষয়ে তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক, দুই দিকেই সচেতন এবং সবল মননে ভাবনা তথা কল্পনির্মাণে সক্ষম। ইতিহাসনির্দিষ্ট মানুষ রাজা কেমন হলে আশ মেটে সেই বিষয়ে নিজেদের অনুভূত তথা কল্পনির্ভর একটা আদর্শ শাসকের আভাস বি-নির্মাণ করে। লেখক সেই রকম পাঁচটা বহুরূপী মুহূর্ত পাঁচটা অধ্যায়ে ভেঙেছেন। গতানুগতিক রাজনীতি বা দর্শন চিন্তার বৌদ্ধিক ইতিহাসের ঠিক বিপ্রতীপে না, আবার সমসত্ত্বেও না। এই স্বতন্ত্র পাঠের দাবি তৈরি হয়েছে একটা বিশেষ শব্দবন্ধে। ‘দ্য সভারেন ফিগার’, বৃহত্তর শাসকের অবয়ব। অর্থাৎ গত দু’শো বছরে ভারতীয় উপমহাদেশে বৃহত্তর শাসকের অবয়ব ভাঙাগড়ার ইতিহাসের একটা পাঠ আছে এই বইয়ে। সেই পাঠ কতটা গ্রহণযোগ্য, সেই বিচার রইলই।
প্রথম অধ্যায়ে বহু রূপে ইংরেজ শাসক, মানে বিলেতের রাজা। বিলেত ধারণাটার ইংরেজ-পূর্ব ইতিহাসগুলি এই প্রসঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেশি করদ রাজারা। তৃতীয় অধ্যায়ে ভারতভাগ্যবিধাতা। তার পরে যথাক্রমে কৃষকের এবং দলিতের বৃহত্তর শাসক এবং সার্বভৌমত্ব কল্প নির্মাণ বিনির্মাণ। মনে রাখতে হবে রাজা কেবল এ ক্ষেত্রে উপলক্ষমাত্র। চিহ্নিত অবয়ব বা অবয়বী চিহ্ন। উপজীব্য হচ্ছে একটা প্রতিশাসন-কল্প। এইখানেই মিলিন্দর মুনশিয়ানা। ওঁর নিজস্ব সন্দর্ভে মিলিন্দ আগাগোড়া যুক্তিপূর্ণ। বস্তুত রণজিৎ গুহ এবং আরও কয়েক জন মহারথী ইতিহাসবিদ সে কথা বইখানির মলাটেই লিখে দিয়েছেন।
তৃতীয় অধ্যায়টি সবচেয়ে বড় এবং বিচিত্রগামী। জাতীয়তাবাদী উচ্চবর্গের নেতৃবৃন্দের ভাবনায় স্বাধীন ভারতের ‘রাজা’ কোন বিশেষ বহুত্বের অবয়ব গ্রহণ করলে ভাল হয়, সেই বিষয়ে চিন্তাভাবনার ইতিহাসবাদী পশ্চাৎদৃষ্টিপ্রসূত একটা পাঠ সেখানে রয়েছে। তবে সেই পাঠে সব সময় এই সমস্ত শাসনকল্পের রাজনীতির পারস্পরিক সামঞ্জস্য থাকতেই হবে, এমন দাবি ওঠেনি। লক্ষণীয় এখানে, কী ভাবে মহত্তর শাসকের ধারণাটা উনিশ শতকের তথা বিশ শতকের গোড়ার ভারতের নেতা-চিন্তাবিদদের লেখাপড়ায় একটা মোটের ওপর প্রজাতান্ত্রিক আঙ্গিকে ভাবা হত। রাজা চাই, কিন্তু সেই রাজা আবার ‘‘অতীতের বা বিলেতের স্বেচ্ছাচারী রাজার মতো’’ হলে চলবে না। ব্রিটিশ বিরোধিতা ছিল, জাপান, জার্মানির একটা অনুরণন ছিল, শিবাজি ছিলেন, দেশটাকে একটা ঐকিক ভাষা তথা ধর্মের কোণঠাসা বাঁধনে ঘেরার বিপজ্জনক আকাঙ্ক্ষাও ছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘সমাজপতি’ও ছিলেন। কল্পিত হচ্ছিলেন পশ্চিমি যান্ত্রিকতা এবং স্বৈরতন্ত্রের ওপরকার এক ‘জাতীয়’ রাজা, যিনি তাঁর ব্যক্তিত্বের আবেদনে এবং সহানুভূতিতে কী ভাবে যেন প্রজাদের সমতুল্য হয়ে যাবেন। এই রাজাকে যেন প্রজাদের প্রতিনিধিত্ব করতেই হবে।
‘জাতীয়’ কথাটা দুই অর্থে; ভারতের জাতি এবং নতুন জাতের রাজা। অবতারত্ব এবং প্রতিনিধিত্ব নিয়ে রাজাকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতিভূ প্রতিপন্ন করার এই স্ব-বিরোধী বৌদ্ধিক প্রকল্পের চরম সীমা বোধ হয় বিনয়কুমার সরকারের ‘সাম্রাজ্যবাদী’ জাতীয়তাবাদ— যা কেবল আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী নয়। পরে টিলকের শিবাজি আর বহু রাজপুত মরাঠা শিখ রাজা বাংলা জাতীয়তাবাদী সাহিত্যে হয় যুদ্ধজয়ী বীর নয়তো দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে শহিদ। সশস্ত্র বিপ্লবীরাও রাজার মহিমা সততই কল্পনা করেছেন। আবার জাতীয়তাবাদী নেতারা কেউ হাতেকলমে রাজা সাজুন বা হোন, তেমনও চাওয়া হত না। এশিয়া বা ভারতের অতীত থেকে বাছাই করে রাজা কেমন হলে ভাল, সেই বিতর্ক আজও। তবে সেই রাজা কিছুতেই ব্রিটিশ বা ইউরোপীয় নন। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জাতীয়তাবাদীর চিন্তার দোটানার ঔপনিবেশিক ধাঁধাটা এই ভাবেই পরতে পরতে খোলে।
এই অধ্যায়ে অনুপস্থিত— দেশীয় করদ রাজ্যগুলোর ভবিষ্যৎ ভারত শাসন ভাবনা। যখন জাতীয়তাবাদীরা রাজাকে প্রজাতন্ত্রের প্রতীকী পোশাকে সাজাচ্ছেন, সেই সময়ই দেশের এক চতুর্থাংশে কিন্তু জন্মগত রাজাদের রাজত্ব। ১৯৪৭ সালের আগে এঁদের সকলের ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দেওয়ার কোনও বাসনা ছিল না। থাকলেও সেই বাসনা জাতীয়তাবাদ এবং রাজাবাদে বিশেষ পার্থক্য করেনি। এইখানেই করদ রাজ্যগুলোর বর্তমান প্রতিভূদের পেলে মন্দ হত না। সে বিষয়ে লেখা নিশ্চয় আছে এবং বইও থাকবে। ত্রিপুরা আছে, এই বইতে। তবে সেখানে রাজশাসন কল্প মানে নিম্নবর্গের হাতে সুদৃঢ় ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের কাহিনি। রাজবংশী ক্ষত্রিয়দের কথাও আছে, অন্য প্রেক্ষিতে। রাজাবাদের প্রজাতন্ত্রীকরণ মানে প্রজা তথা নাগরিকদের সশক্ত-করণ। রাজাবাদের প্রজাতন্ত্রীকরণের এই রাজনীতি বিষয়ে চমৎকার আলোচনা এই বইতে রয়েছে। প্রাক্তন দেশি রাজ্যগুলির রাজাদের কিন্তু হবু-স্বাধীন রাষ্ট্রের কল্পনার পরিসরে তেমন উৎসাহিত করা যায়নি।
পঞ্চম তথা শেষ অধ্যায় বিষয়ে কয়েকটা কথা বলার আছে। নিম্নবর্ণ শব্দটি ব্যবহার না করে দলিত শব্দটি ব্যবহার করা যেত কি? দুটো শব্দেরই নিজস্ব অন্তর্জগৎ এবং বহির্জগৎ রয়েছে। খানিক কৌতূহল হয় আরও এক অনুপস্থিতিতে। মহিলা নেত্রীদের দেবীকল্প নির্মাণের একটা ইতিহাস বাংলায় অতি পরিচিত। অবশ্য এই ইতিহাসের অন্য একটা রূপের বয়ান আছে জাতীয়তাবাদী রানিকল্পনির্মাণ পর্যালোচনার অধ্যায়টিতে।
দু’টি কথা শেষে। স্বপ্ন বা কল্পের নির্মাণ এবং সেখানে পৌঁছবার পথ এক নয়। তাদের দ্বন্দ্বের বাস্তবটা এখানে সে ভাবে মেলে না। দুই, ভূমিকাটা শেষে পড়লে ভাল। নইলে অযথা লেখকের মননভার পাঠককে কিছুটা বিভ্রান্ত করতে পারে। বাকিটা কিন্তু পাঠকের দায়িত্ব— বইটি পড়তেই হবে।