সুন্দরবনের স্মৃতি। বরেন্দু মণ্ডল। গাঙচিল, ২৫০.০০
তুষার কাঞ্জিলাল সুন্দরবন এলাকা ও তার মানুষজনকে নিবিড় ভাবে চেনেন। তাঁর সুন্দরবনের গপ্পোসপ্পো (আজকাল, ১২০.০০) তেমন কয়েকজনকে নিয়েই। লেখক কল্যাণব্রতী। মানুষ সম্পর্কে আগ্রহ তাঁর স্বাভাবিক। এঁদের দেখেছেন, এঁদের কথা শুনেছেন, সুখদুঃখের সন্ধান নিয়েছেন। পারলে পাশে থেকেছেন, জীবনের শরিক হয়েছেন। দুই কুড়ি গল্প। আর তার চেয়েও অনেক বেশি মানুষের কথা বলেছেন লেখক।
সুন্দরবনে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের বাস। এখানে মানববর্ণালীর হরেক তরঙ্গদৈর্ঘ্য উপস্থিত। তবে রতন বৈরাগীর কম্পাঙ্ক সব অ্যান্টেনায় ধরবে না। এই বৈরাগী বৈরাগ্যের ধার ধারে না, তৃপ্তি ওর সদাসম্বল। দুনিয়ার সঙ্গে বিবাদ নেই, আছে পূর্ণ প্রীতির সম্পর্ক; গৃহিণীর সঙ্গে নিখাদ প্রেম। আছে সূর্যদেব থেকে পেয়ারাগাছ, সবার সঙ্গে দৈনিক কথোপকথন। ওর তৃপ্ত মন জগতে অভাব দেখে না, তাই মানবোন্নয়নের প্রোজেক্টে ওর আকর্ষণ নেই। জীবনের প্রতি সহজ টানের সঙ্গে রয়েছে মৃত্যুকে আত্মীয় করে নেওয়ার মৃত্যুঞ্জয়ী ফর্মুলা। এর সাহচর্যের ছিলিমে টান মারতে পারলে মানববৈচিত্রের জোর ঝটকা একটু ধীরে সে লাগে, আমরা হজম করতে পারি তুষারবাবুর গল্পের আর এক চরিত্র— রামাই খুঁজিয়াল-কে। রামাই সর্বনাশের কাণ্ডারি। ডাকাতকে খবর দিয়ে গেরস্তের সর্বনাশ করে, পুলিশকে খবর দিয়ে ডাকাতের সর্বনাশ করে, আবার প্রয়োজনে পুলিশকে ফাঁসাতেও পিছপা হয় না। সর্বনাশ শুধু তার পেশা নয়, নেশা। মিথ্যাভাষণে শুধু পটু নয়, এতেই তার আনন্দ। কখনও চেপে ধরতে পারলে, কৈফিয়ত তৈরি: সবাই মিথ্যা বলে, বদমাইসি করে। যে খুব সফলভাবে করে সে অনেক টাকা ক্ষমতা কামায়। তাকে সবাই খাতির করে। এর জবাব হয় না। গপ্পোসপ্পো-র বহু চরিত্রের জীবন যে সওয়াল হাজির করে, তার জবাব পাওয়া দুষ্কর।
একের পর এক মেয়ের গল্প। বালিকা, কিশোরী, যুবতী, প্রৌঢ়া, বৃদ্ধা। সুন্দরবনই ভারতের একমাত্র জায়গা, যেখানে নদীতে মৎস্যজীবী মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নৌকোয় মাছ ধরতে যায়। সেই সপ্তমুখী নদীর মেয়ে মাছমারাদের কথা লেখক লেখেননি। যাদের কথা লিখেছেন, তাদেরও হিম্মতে কোনও কমতি নেই। অবিরত অপমান, দুর্বিষহ যন্ত্রণাকে কাবু করে এরা জীবন গড়ার চেষ্টা করেছে। এ ক্ষেত্রে লেখকের মতো মানুষের সাহায্য তাদের শক্তিকে সংহত করতে, তাদের সংগঠিত হতে, সাহায্য করেছে। এদের প্রসঙ্গে বারে বারে এসেছে লেখকের খেদ— শহুরে নারীবাদ এদের চিনতে শেখেনি, এদের শক্তিকে মর্যাদা দিতে শেখেনি। এই রকম ক্ষেত্রে আখ্যান কখনও একটু বক্তৃতা হয়ে ওঠে। গল্পের আবেদন যেন একটু ক্ষুণ্ণ হয়। তবু এমন একটি গল্পের ঝুলি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে এ কথা বলতে দ্বিধা হয় না।
লেখার গুণে কখনও কখনও স্মৃতিকথা অনবদ্য হয়ে ওঠে। বরেন্দু মণ্ডলের সুন্দরবনের স্মৃতি (গাঙচিল, ২৫০.০০) তাই হয়েছে। একটু স্বাদ দিতে ইচ্ছে হয়: নদীর বাঁধভাঙা লোনা বানে গ্রাম ডুবেছে, খেত ডুবেছে, অভাবের হাঁ আরও বেড়েছে। তাও মন স্বাভাবিকতা খোঁজে। স্মৃতিকথা জানায়, “পিসিমাকে ঘিরে আমরা ছোটরা তখন গল্প শুনতে বসে পড়তাম। পিসিমা বলত— তার ছোটবেলায় এ রকমই পুজোর আগে যে বন্যা হয়েছিল তার গল্প। সাদা-ডানা সারসের মতো নদী ছুটে যায় কপালিপাড়ার দিকে। পিসিমা বলত, ‘গাঙ শত্তুর হয়ে গেচে’। আকাশে তখন ফালতু একটা চাঁদ ওঠে। নস্করপাড়ার দিক থেকে কাদের চিৎকার ভেসে আসছিল। উঠোনে নেমে আকাশের দিকে একনজর দেখে পিসিমা এসে বলে সামনের বৃহস্পতিবার কোজাগরী... ধন ধান্যে পুষ্পে ভরে উঠবে আমাদের গাঁ-ঘর। তখন নাকি আমাদের আর কোনও অভাব থাকবে না।... পুজো আসত আমাদের খিদের মধ্যে, আমাদের অভাবে অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে যেত কোজাগরী চাঁদ।” সাতজেলিয়ার গাঁড়াল নদীর পারের একটি পরিবার ও গ্রামের টুকরো কাহিনি বলতে বলতে স্মৃতিকথা কখনও সুন্দরবনের সমাজ-অনুসন্ধিৎসার খোরাক জোগাতে আগ্রহী হয়। তবে কাহিনিতে রসচ্ছেদ ঘটে না।
বরেন্দু মণ্ডলের অপর বইটি সুন্দরবন ও আমাদের কথা (গাঙচিল, ২৫০.০০) প্রধানত সুন্দরবন-বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন। ‘বাইরের’ মানুষের নয়, ভূমিপুত্রের সুন্দরবন চর্চা। এই চেতনার প্রকাশ প্রবন্ধগুলিতে আছে। কিন্তু দম্ভ হিসেবে নয়। প্রবন্ধকার বলেন, ভালবাসা থাকলে ‘শহরের এলিট’-ও পারেন সুন্দরবনকে নিবিড় ভাবে জানতে। তবে, অনেক ক্ষেত্রে দরদের ঘাটতি চোখে পড়েছে তাঁর। সুন্দরবনের সমাজ, ইতিহাস, ভূগোল, বাস্তুতন্ত্র এবং এখানকার মানববসতির পরিণতি সংক্রান্ত প্রবন্ধে তিনি এই ঘাটতির ইঙ্গিত দিয়েছেন। বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ সুন্দরবন-সংক্রান্ত সাহিত্য বিষয়ে। বিদগ্ধ পাঠকও হয়তো ভাবনার খোরাক পাবেন। তবু যেন তাঁর স্মৃতিকথাই বেশি স্পর্শ করে, বেশি ভাবায়।
সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সত্য ঘটনা অবলম্বন’ আটটি গল্পের সঙ্গে তিনটি অপ্রকাশিত লেখা জুড়ে প্রস্তুত মিতা সিংহের বাঘ কুমির সুন্দরবন (নিউ স্ক্রিপ্ট, ১২০ ০০) পড়তে শুরু করলে ছাড়া কঠিন। মোটের উপর তরতরে পরিবেশন। জানার পরিধি ও গভীরতা তাক লাগায়। জগদ্দল নদী থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের পূর্বপ্রান্তে চিংড়িপোতা খাল অবধি জলজঙ্গলের জীবন্ত ভূগোল তাঁর নখদর্পণে; বাঘ, কুমির, কচ্ছপ, কাঁকড়া, পাখি, গুলেমাছ, মেনুমাছ, কানমাগুর সকলকে তিনি ঘনিষ্ঠ ভাবে চেনেন; সুন্দরবনের গরিব মানুষের কষ্ট বোঝেন। জেলে ডিঙি থেকে কিংবা কাঁকড়া শিকারি আদিবাসীর দৃষ্টিতে বন ও বনের সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্তদের কেমন দেখায় তার খবর সাধারণত বন্যপ্রেমীর থাকে না। লেখক অনেকটা ব্যতিক্রম। আলোকচিত্রগুলি বইয়ের আকর্ষণ।