জ নগোষ্ঠীর সমাজ-সংস্কৃতিতে ধর্ম, ইতিহাস, পুজো-পার্বণ, প্রবাদ-প্রবচনের অস্তিত্বের প্রবহমানতার সঙ্গে পুরাবৃত্ত চর্চার পরিসর তৈরি করে। সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মাঝি রামদাস টুডু রেস্কা উনিশ শতকের শেষভাগে খেরওয়াল তথা সাঁওতাল আদিবাসীর আচার-অনুষ্ঠানের ধর্মীয় বিষয় অনুসন্ধানে খেরওয়াল বংশা ধরম পুথি বইটি প্রকাশ করেন। তিনি সাঁওতালি ভাষায় বাংলা লিপিতে সৃষ্টিতত্ত্ব, মানুষের আবির্ভাব, বিবাহ, সংস্কার নিয়ে লেখার সঙ্গে নিজের আঁকা রেখাচিত্র দিয়ে পুরাণ-কথার চিত্রমালা সাজিয়েছিলেন। ধলভূমের রাজা জগদীশচন্দ্র দেও ধবলদেব ও ম্যানেজার বঙ্কিমচন্দ্র চক্রবর্তীর উৎসাহে ১৯৫১-য় বইটির যে সংস্করণ প্রকাশিত হয়, তাতে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের একটি ভূমিকা ছিল। পরে অন্য সংস্করণ প্রকাশিত হলেও, খেরওয়াল বংশা ধরম পুথি-র (মনফকিরা, ৪৫০.০০) বর্তমান সংস্করণ মূল বইয়ের অবিকল প্রতিলিপি সহ সুহৃদকুমার ভৌমিক-কৃত বঙ্গানুবাদে মূল্যবান প্রকাশনা।
ঊষর মানভূমের ঝুমুর সাহিত্য ও সংগীতে বিস্তৃত জায়গা নিয়ে আছে। আবহমানের এই মোহিনী সুর বাঁধা নিয়মের দেওয়াল পেরিয়ে জনমানসের এক উন্মুখ আকাশ। আত্মনিবিষ্ট গবেষক ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায় প্রায় ৬০ বছর আগে ঝুমুর নিয়ে যে সন্দর্ভ রচনা করেছিলেন, তা পাণ্ডিত্যে ও প্রামাণিক তথ্যভিত্তিতে এক উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল। সেই মানভূমের ঝুমুর (পারিজাত প্রকাশনী, পুরুলিয়া, ২০০.০০) দিলীপকুমার গোস্বামীর সম্পাদনায় প্রথম পুস্তকাকারে প্রকাশিত হল।
পারিপার্শ্বিক সমাজের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতায় ছন্দোবদ্ধ রূপে জীবনের অন্তর্নিহিত কথা প্রবাদে প্রবহমান। প্রবাদে বাঙালীর সমাজজীবন (ইউনাইটেড বুক এজেন্সি, ৯০.০০) গ্রন্থে কৃষ্ণা ভট্টাচার্য বাংলা প্রবাদ উল্লেখে বাঙালি সমাজকে দেখিয়েছেন। পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতের চরিত্রগুলি আর কৃষিভিত্তিক বাঙালি সমাজের কত বিষয় এ সব রম্য প্রবাদে মিশে আছে।
সংখ্যার হিসেবে ১৩৫৯টি প্রবাদ প্রবচনের বর্ণানুক্রমিক উল্লেখ নথিবদ্ধ করেছেন পুরঞ্জয় মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রবাদ প্রবচন: দক্ষিণ ২৪ পরগনা (পুস্তক বিপণি, ২৫০.০০) বইতে। এখানে জেলাকেন্দ্রিক উল্লেখ থাকলেও, এ সব প্রবাদ-প্রবচনের অনেকাংশই সারা বাংলাতেই পরিচিত। লেখকের পরিশ্রমী প্রয়াসে জেলার আঞ্চলিক ভাষা-শব্দের ব্যবহারে স্বতন্ত্র হয়েছে এই সংকলন; আছে উল্লেখ্য শব্দের নির্ঘণ্ট ও বিষয়-তালিকা।
ক্ষীণ-প্রবাহী হতে হতে এ বঙ্গের যমুনা নদী আজ মরা গাঙ। ইছামতীর উজানে আজ স্থবিরতা। কয়েক দশক আগের স্মৃতিপটের সঙ্গে এখনকার উত্তর চব্বিশ পরগনার নদীকে মেলালে আক্ষেপ জুড়ে বসে। নদী-সংলগ্ন জনপদে বেড়ে ওঠা স্বপনকুমার বিশ্বাস রচিত যমুনা ইছামতীর তীরে তীরে (বেস্ট ফ্রেন্ড, ২৩০.০০) বইয়ের প্রথম খণ্ডে স্মৃতিচারণায় মিশেছে ইতিহাস।
ময়ূরাক্ষী, দ্বারকা, কোপাই, ব্রাহ্মণী— এমন নদী অববাহিকায় শুধু ভৌগোলিক সীমানা নয়, আঞ্চলিক জনজীবনের বৈভব-বৈচিত্রের ধারাও জানা যায়। মুর্শিদাবাদের পটভূমিতে বন্যার অভিঘাতের আলোচনা করেছেন অপরেশ চট্টোপাধ্যায় তাঁর নদী বন্যা ও কান্দি মহকুমা (অঙ্গাঙ্গী প্রকাশনী, কান্দি, ৫০.০০) বইতে। আছে পাঁচালি গানে কান্দি মহকুমার বন্যা এবং নদী সংক্রান্ত আঞ্চলিক শব্দার্থ।
আঞ্চলিক জনসমাজে উনিশ শতকের চেতনাবোধ আর তার প্রতিবাদের রীতি আমাদের বিস্মিত করে। বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগনার গোবরডাঙ্গা-খাঁটুরায় ব্রাহ্মধর্মে বিশ্বাসী হয়ে কুমুদিনী দেবীর প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধাচরণ স্বতন্ত্র দিগদর্শী। তাঁর স্বল্পায়ু জীবনের উপলব্ধি ও মানসিকতার বর্ণনা ‘বামাবোধিনী’, ‘কুশদহ’ পত্রিকা সহ অন্য তথ্যে পাওয়া যায়। গোবরডাঙ্গা গবেষণা পরিষৎ ও শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন সেন্টার ফর সোশ্যাল স্টাডিজের প্রকাশনায় বিদ্রোহিণী কুমুদিনী (৫০.০০) সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন সুখেন্দু দাশ।
সরযূবালার ভেষজকথা (কলাবতী মুদ্রা, ৬০.০০) গ্রন্থে অন্তঃপুরের জ্ঞান চর্চার স্মৃতিচারণামূলক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন সোমা মুখোপাধ্যায়। শিকড়, বাকল, পাতা, ফুল, ফল দিয়ে তৈরি হাজারো টোটকা শারীরিক উপসর্গ ও অসুখ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়, তা কৌতূহলোদ্দীপক। জ্ঞান চর্চার এই ধারা পরম্পরাবাহিত অতীত স্বাস্থ্য সচেতনতাকে সমৃদ্ধ করে আজও প্রাসঙ্গিক। পারিবারিক আঙিনায় সরযূবালা গোস্বামীর অভিজ্ঞতালব্ধ কথা শুনিয়েছেন লেখক।
কৌলাল (সম্পাদনা: স্বপনকুমার ঠাকুর) পত্রিকা প্রত্নতত্ত্ব, আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতির নানা লেখায় সমৃদ্ধ। এপ্রিল সংখ্যায় বিলুপ্ত রাজ্য হরিকেল, আলপনা ও চট্টগ্রামের আইলবানা, পদ্মতামলীর বেণীপুতুল, কবিয়াল গুমানি দেওয়ান, পুরাতীর্থ আমূল ইত্যাদি লেখা ছাড়া আছে প্রবীণ গবেষক মুহম্মদ আয়ুব হোসেনকে নিয়ে ক্রোড়পত্র। মে সংখ্যায় বর্ধমানের পাটুলি, বাঁকুড়ার মালিয়াড়া, মুর্শিদাবাদের প্রাচীন মসজিদ ইত্যাদি বিষয়ে লেখা।