শিল্পী: রণেন আয়ন দত্ত।
রণেন আয়ন দত্ত বিজ্ঞাপন শিল্পের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ১৯৪০-এর দশক থেকে ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত বাংলায় বিজ্ঞাপন শিল্পের যে অসামান্য উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল, এর প্রধান প্রাণপুরুষদের মধ্যে ছিলেন অন্নদা মুনশি থেকে সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত নানা ধারার অনেক বিশিষ্ট শিল্পী। বাংলার পরম্পরাগত শিল্পের প্রবাহ থেকে তাঁরা উদ্ভাবন করেছিলেন বিজ্ঞাপন-শিল্পের বিশিষ্ট আঙ্গিক। রণেন আয়ন দত্ত এই ধারারই একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী। কিন্তু এটুকুই তাঁর শিল্পী ব্যক্তিত্বের একমাত্র পরিচয় নয়। সৃজনশীল শিল্পে বা ললিত-কলাতেও তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। এটা উপলব্ধি করা গেল গ্যালারি ৮৮-তে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তাঁর ছবির একটি প্রদর্শনী দেখে।
তেলরং, জলরং, অ্যাক্রিলিক ও কালি-কলমে আঁকা মোট ৩০-টি ছবি নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘রণেন আয়ন দত্ত: এ পেরিস্কোপিক জার্নি থ্রু সেভেন ডিকেডস’। এই প্রদর্শনী থেকে তাঁকে নব্য-ভারতীয় ঘরানার একজন বিশিষ্ট শিল্পী বলে চিনে নিতে পারি, যিনি প্রায় সাত দশক ধরে এই ধারার ঐতিহ্যগত আঙ্গিককে অতীত থেকে সাম্প্রতিকে প্রসারিত করে যাচ্ছেন। অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু ও যামিনী রায়ের চিত্রদর্শন ও আঙ্গিক দ্বারা তিনি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
অবনীন্দ্রনাথের ১৮৯৭-এর ‘রাধা-কৃষ্ণ’ চিত্রমালা থেকে ‘আরব্য রজনী’ (১৯৩০), ‘কৃষ্ণ-মঙ্গল’ (১৯৩৮), ও ‘কবি কঙ্কনচণ্ডী’ চিত্রমালা পর্যন্ত বিবর্তনকে একক আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করা যায় না। নন্দলাল বসুরও যে বিবর্তন (১৯০৫-১৯৬০) তাতে ভারতশিল্পের মহাসাগর থেকে নানা তরঙ্গের উন্মীলন ঘটেছে। তা শুধু ভারতীয় ঐতিহ্যেও সীমাবদ্ধ থাকেনি। সমগ্র প্রাচ্য ঐতিহ্যের সঙ্গে আত্মস্থ করেছে পাশ্চাত্য ঐতিহ্যের নানা সারাৎসারও। নীতিগতভাবে যামিনী রায়কে নব্য-ভারতীয় ধারার শিল্পী বলা যায় না। তথাপি চিত্রকলায় দেশাত্মবোধকে তিনি যে পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, এবং পাশ্চাত্য আধুনিকতাকেও তার সঙ্গে যেভাবে সমন্বিত করেছেন, তাতে দেশীয় আত্মপরিচয়েরই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে। এই উত্তরাধিকার যখন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের সৃজনে এসে পৌঁছয়, তখন জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতার যে বহুমাত্রিক উত্তরণ ঘটে, তাকে একক কোনও সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না। তবু এই বৈচিত্রের মধ্যে কেন্দ্রীয় কোনও অভিমুখ সন্ধান করতে হয়, তা হয়তো এই যে জীবনব্যাপ্ত বাস্তবতার মধ্যে বা লৌকিক প্রবাহের মধ্যে এক অলৌকিক সৌন্দর্যের স্পন্দনকে উন্মীলিত করার প্রয়াস। নব্য-ভারতীয় ধারার শিল্পীরা এই সদর্থক জীবনবোধকে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন সব সময়।
রণেন আয়ন দত্তের ছবিতে এই তন্ময় রূপচেতনাই নানাভাবে প্রকাশিত হয়। একজন ঢাকী ঢাক বাজাচ্ছে এই বর্ণিল চিত্রকল্পে নন্দলালের হরিপুরা চিত্রমালার অভিঘাত যেমন অনুভব করা যায়, তেমনই গভীর কৃষ্ণ প্রেক্ষাপটে বিপরীত ক্রমে শুভ্র আলুলায়িত জঙ্গম রেখায় আঁকা ঘোড়ার প্রতিমাকল্পে চৈনিক ঐতিহ্যের অনুরণনকেও উপেক্ষা করা যায় না। ‘টুইলাইট’ (১৯৪৫) জলরঙে আঁকা গোধূলির চিত্রায়ণে অবনীন্দ্রনাথের প্রভাবকে তিনি সচেতনভাবেই আত্মস্থ করেছেন।
১৯৪৬-এর একটি জলরঙের মুখাবয়ব-চিত্র ‘আত্মা’-তে স্বাভাবিকতাবাদী রূপায়ণের মধ্যেই কোমল এক অনৈসর্গিকতার সঞ্চার করেছেন। ১৯৪৫-এর ‘দার্জিলিং মিস্ট’, ১৯৬২-র ‘ট্রাফলগার স্কোয়ার’ দুটি ছবিই জলরঙে আঁকা নিসর্গ-রূপায়ণ। এর ভিতর শিল্পী ইম্প্রেশনিস্ট আঙ্গিককে যে ভাবে সমন্বিত করেছেন, সেটাই আরও পরিশীলিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে ১৯৯২-এর ! ‘রুফটপ’ শীর্ষক কলকাতার নিসর্গে।
শেষোক্ত ছবিটির বিষয় ঘরের ভিতর পালঙ্কে পাশ ফিরে শুয়ে বা ঘুমিয়ে আছে এক মানবী। পাশে টেবিলে ফুলদানিতে একটি প্রস্ফুটিত গোলাপ। দৈনন্দিন জীবনের খুব সাধারণ বিষয়। কিন্তু ছবিটির আঙ্গিকে তুলিচালনা ও বর্ণলেপনের সুস্মিত সৌকর্যে যে জীবনবোধের বিচ্ছুরণ, সেটিই রূপকে রূপাতীতের দিকে নিয়ে যায়।
এই রূপাতীতের ধ্যানই নব্য-ভারতীয় ধারার বিশেষ অন্বিষ্ট ছিল। রণেন আয়ন দত্তের ছবিতে সেই তন্ময়তাই প্রকাশ পায়।