জেন্ডার অ্যান্ড ক্রিমিনালিটি ইন বাংলা ক্রাইম ন্যারেটিভস/ লেট নাইনটিন্থ অ্যান্ড আর্লি টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরিজ়
শম্পা রায়
মূল্য অনুল্লেখিত, পলগ্রেভ ম্যাকমিলান
আধুনিক অর্থে বাংলায় গোয়েন্দা কাহিনি লেখা শুরু হয় উনিশ শতকের শেষ দশকে। সাহিত্যের এই ধারাটি কখনওই প্রাপ্য মর্যাদা বা গুরুত্ব পায়নি। শম্পা রায় বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বলে তাঁর বইয়ের সূচনাতেই সে কথা উল্লেখ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি যে সময়োচিত আর একটি দায়িত্ব নিয়েছেন তা হল বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যকে ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠকের সামনে তুলে ধরা। তাঁর বিষয় হল বাংলা অপরাধ-সাহিত্যে লিঙ্গ আর পাপাচরণ।
লেখিকা তাঁর আলোচনাকে পাঁচটি ভাগে সাজিয়েছেন। পঞ্চাশ পাতার মুখবন্ধে আলোচনা করেছেন বিষয়টিকে তিনি কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখছেন, তার জন্য তাঁর উপাদানগুলি কী কী আর কেন তিনি সেগুলি বেছে নিয়েছেন। তাঁর বিভিন্ন বিভাগের শিরোনামগুলি বাংলা করলে অনেকটা এই রকম দাঁড়ায়: ‘নীরস গৃহ: গার্হস্থ্যের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি আর বঙ্কিমের বিষবৃক্ষ ও কৃষ্ণকান্তের উইলে অপরাধ’। পরের অধ্যায়, ‘রঙ্গিলা বধূ ও রাঁড়ী: প্রিয়নাথ দারোগার আখ্যানে অপরাধী নারী’। চতুর্থ অধ্যায়ের শিরোনাম, ‘বিপথগামী ফন্দিবাজ: প্রিয়নাথের প্রমীলা অপরাধীরা’। শেষ অধ্যায়ের নাম, ‘অনুসন্ধান ও কামনা: বাংলা গোয়েন্দা কাহিনির সূচনাপর্বে পুরুষ গোয়েন্দা আর তার অপছন্দের ছুঁড়ি’।
সমাজবিজ্ঞান চর্চার মজা হচ্ছে এখানে কোনও যুক্তিকেই অকাট্য বলে মেনে নেওয়া হয় না। যে উপাদান ও উপকরণের সাহায্যে এক জন সমাজবিজ্ঞানী একটি যুক্তি খাড়া করেন সেই একই উপকরণ ব্যবহার করে আর এক জন আর একটি তত্ত্ব অনায়াসেই হাজির করতে পারেন। শম্পার যুক্তিতে বাংলা অপরাধ-সাহিত্যের সূচনা পর্বে পুরুষ লেখকদের নারী চরিত্রগুলিকে কালো রঙের পোঁচ লাগিয়ে হাজির করার পিছনে এক বিশেষ ধরনের প্রতিক্রিয়া ও মানসিকতা কাজ করত। খুব সঠিক ভাবেই তিনি বলেছেন যে, বাংলা অপরাধ-সাহিত্য সৃষ্টির আগে অপরাধ সংক্রান্ত লেখাপত্র মানেই ছিল কেচ্ছা বৃত্তান্ত। তেমনই অপরাধের একটা সুসংহত ও মার্জিত রূপ প্রকাশ পেল প্রিয়নাথের মতো লেখকদের রচনায়। শুধু কেচ্ছা বা খেউড় করা নয়, প্রিয়নাথদের লেখায় চিহ্নিত হল অপরাধ, অপরাধী, অনুসন্ধানের মাধ্যমে তাদের চিহ্নিত করা আর সর্বোপরি ঔপনিবেশিক আইন মোতাবেক তাদের সাজা দেওয়া। উনিশ শতকের শেষ কয়েক দশক থেকে সম্পত্তির অধিকার দাবি করে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের বিরুদ্ধে আদালতে যাচ্ছিলেন মেয়েরা। তাঁদের সম্পর্কে পুরুষ সমাজের একাংশের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন শম্পা গোয়েন্দা উপন্যাসে খুঁজে পেয়েছেন। সমকালীন প্রহসনে ও নিচু তলার সাহিত্যে কলিযুগের কল্পনার একটি অন্যতম প্রধান চরিত্র ছিল অবাধ্য বিপথগামী বধূ। এই রকম নারীচরিত্র সম্ভাব্য অপরাধী হিসেবে সে কালের গোয়েন্দা সাহিত্যে উঠে আসতেই পারত। সেই তালিকায় ‘মামলাবাজ’ মধ্যবিত্ত বিধবা বেশ খাপ খেত সন্দেহ নেই। কিন্তু ঘটনা হল সূচনা পর্বের গোয়েন্দা কাহিনিতে নারী অপরাধীরা প্রায় সবাই পরিবারের বাইরের চরিত্র— তথাকথিত পতিতা। শম্পার গবেষণায় অন্য উদাহরণ বড়ই কম।
গল্প-কাহিনিতে পতিতার অনুষঙ্গ কেন এত বেশি তারও একটা বাস্তব ভিত্তি আছে। আদমসুমারির এক-একটি রিপোর্ট প্রকাশ পেলেই হইচই পড়ে যেত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজে। আসলে তাঁদের ভয় ছিল কলকাতায় পড়তে আর চাকরি করতে আসা পুরুষরা সহজেই বিপথগামী হয়ে পড়তে পারে। ১৩১০ বঙ্গাব্দের ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় লেখা হল, ‘‘১৯০১ সালের আদমসুমারি অনুসারে কলিকাতায় পুরুষের সংখ্যার তুলনায় স্ত্রীলোকের সংখ্যা অত্যন্ত কম। বিবাহিত পুরুষের সংখ্যা ৩৫৮৩৩৬ কিন্তু বিবাহিত নারীর সংখ্যা ১৩১৮১৬। তাহা হইলে ২২৬৫২০ জন কলিকাতাবাসী স্বামী অস্ত্রীক বাস করিতেছেন।... মানুষ পরিবারী হইয়া বাস না করিলে অনেক সময়েই দুর্নীতিপরায়ণ হয়। কলিকাতায় স্ত্রীপুরুষের সংখ্যায় এত পার্থক্য বাঞ্ছনীয় নহে। ইহা না কমিলে কলিকাতার দুর্নীতির স্রোত বাড়িয়া চলিবে।’’ বাংলা অপরাধ-সাহিত্যের আলোচনায় এই দিকটা উপেক্ষা করলে তার বুনিয়াদ পোক্ত হয় না।
অপরাধিনী: পি এম বাক্চির পঞ্জিকায় (১৯১৫) পাঁচকড়ি দে-র ডিটেকটিভ উপন্যাসের চিত্র।
কেন বাঙালি গোয়েন্দা কাহিনির প্রতি আকৃষ্ট হল তা নিয়েও লেখিকার নির্দিষ্ট বক্তব্য আছে। শম্পা মনে করেন এর পিছনে কাজ করেছিল বাঙালির বাহুবলের ধারণা। হিন্দু ভদ্রলোক পাঠককুলের কাছে বেপরোয়া বাঙালি গোয়েন্দা (যার ভিত্তি হল হোমসীয় ছক) এতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণ হচ্ছে তাঁরা চাইতেন বাঙালি মরদরা যে চূড়ান্ত তৎপরতা দেখাতেও সক্ষম তার প্রমাণ। সেই সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল নায়কোচিত পরাক্রম আর শরীরী উদ্যম। লেখিকা দু’টি বইয়ের উদাহরণ হাজির করেছেন। এক, শরচ্চন্দ্র সরকারের সাবাস চুরি আর ক্ষেত্রমোহন ঘোষের প্রমদা। দুই ক্ষেত্রেই গোয়েন্দা হরিদাস আর যদুনাথ লেখাপড়ায় তেমন দড় না হলেও অপরাধ অনুসন্ধানে যথেষ্ট এলেমদার এবং শারীরিক সক্ষমতায় পারঙ্গম। তবে বাংলা গোয়েন্দা কাহিনির সূচনাপর্বে কি পুলিশ আর কি শখের গোয়েন্দা, কেউই যে খুব বলদর্পী ছিলেন এমনটা তো নজরে পড়ে না। শরচ্চন্দ্রই যখন হরিদাসকে নিয়ে অন্য কাহিনি ফাঁদেন তখন তাঁর পরিচয় দেন এই বলে যে, ‘‘... কথাবার্ত্তায় তিনি মিষ্টভাষী। ... পরামর্শ দানে তিনি মুক্তকণ্ঠ, পরশ্রী কাতরতা ও দ্বেষ হিংসা বর্জ্জিত চিত্ত, বিপন্ন ব্যক্তিকে সাহায্য করিতে সদা সর্ব্বদাই প্রস্তুত...’’ (বেমালুম চুরি, ১৩০৮ বঙ্গাব্দ)
বাংলা অপরাধ-সাহিত্যের জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে যে প্রশ্নটা অনেক বেশি জরুরি তা হল কেন লেখক ও প্রকাশকরা তখন মনে করলেন সাহিত্যের এই নতুন ধারাটি পাঠকসমাজকে আকৃষ্ট করবে? মনে হয় লেখকরা উপলব্ধি করেছিলেন সম্ভাব্য ক্রেতারা এই বিশেষ পণ্যটির ভেতর খুঁজে পাবেন নতুনত্বের স্বাদ আর পণ্যটির সঙ্গে জুড়ে থাকবে এক ধরনের সামাজিক দেখনদারি। যে নব্যশিক্ষিত সম্প্রদায় প্রভুদের অনুকরণ করতে চায় তারা এর আবেদন উড়িয়ে দিতে পারবে না। যে কোনও ভোগ্যপণ্যের মতোই গোয়েন্দা কাহিনিরও একটা সুবিধাজনক অবস্থান ছিল। তার গায়ে লেগে গিয়েছিল আধুনিকতার তকমা। একটা ভাবনা খুব সুকৌশলে শিক্ষিত বাঙালি সমাজের মধ্যে চারিয়ে দেওয়া হয় আর তারাও সেই মতো ভাবতে শুরু করে বিড়ির থেকে সিগারেট উন্নত, কাপড় ধোলাইয়ের জন্য চাই কারখানায় তৈরি সাবান কারণ সেটা স্বাস্থ্যসম্মত কিংবা ধুতি-চাদরের থেকে কোটপ্যান্ট অনেক পরিশীলিত। সেই একই যুক্তিতে গোয়েন্দা কাহিনি পড়া মানে আধুনিক রুচির পরিচয়। হয়তো এই কারণেই হোমসীয় মডেলকে আপন করে নিয়েছিল বাঙালি পাঠক কারণ তা লক্ষ লক্ষ ইংরেজ আর আমেরিকান পড়ে থাকে।
শম্পা রায় অবশ্যই একটা নতুন দিক তুলে ধরেছেন যা এর আগে বাংলা অপরাধ-সাহিত্যের ক্ষেত্রে আলোচিত হয়নি। নারী-পুরুষ সম্পর্ক বিষয়ে এমন অনেক প্রশ্ন তিনি তুলেছেন যা ভবিষ্যতে গোয়েন্দা কাহিনির বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।