ছবি: শুভময় মিত্র
চন্দ্রদ্বীপ বা আজকের বরিশাল আভিধানিক অর্থে সম্পূর্ণত দ্বীপ চরিত্রের না হয়েও ভৌগোলিক ও মানসিক বিচ্ছিন্নতার কারণে নিম্ন-গাঙ্গেয় সমভূমির মধ্যেও একাকী, অনন্য এক জাদুবাস্তবতার ভুবন— অসংখ্য নদী, উপনদী, খাল ও সোঁতা অবিরাম ভূখণ্ডকে কাটাকুটি করে চারিদিক থেকে শিকড়ে বেঁধে ফেলেছে, কসমোপলিটান হয়ে উঠতে দেয়নি। ভূগোলের বাধ্যতা এবং জল এই নরম মাটির প্রাণপুতুলকে টিপে ছেনে এক অনন্য জীবনেতিহাসের আকার দিয়েছে। কেন যে এখানে ড্রাইভারকে ‘বাসের মাঝি’ বলা হয়, কেন এখানে একটি শিশু ডাংগুলি খেলতে শেখার আগে সুপুরি গাছের ডোঙা বাইতে শিখে যায়, কেন দরিদ্র মালোর ছেলে সত্যিই জাল মুড়ি দিয়ে ঘুমোয় আর ধনাঢ্য পরিবার এখানে গাড়ি না কিনে স্পিডবোট খরিদ করে— তার উত্তর কিতাবে নয়, বিচ্রইয়া খুঁজতে হয়! এ সেই আঠারো ভাটির দেশ— যাকে কেউ সহ্য করতে পারে না, সেও কারওকে নয়। কিন্তু কেউ তাকে ফেলতেও পারে না। সে তো শুধু ‘বরিশাল বাংলাদেশের গোলাঘর’ এই কারণেই নয়। চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাস-সংস্কৃতিকে পাশে সরিয়ে রেখে আদি, অনার্য বাংলার অবয়ব নির্মাণ কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। সে নিষ্ফলা চেষ্টা হবে সিন্ধ-কে বাদ দিয়ে পাকিস্তানের ধর্মীয় ইতিহাস বা টিমবুকটু-কে উহ্য রেখে আফ্রিকার জ্ঞানের ইতিহাস চর্চা করার মতোই মূঢ়তা। এই আলোচনায় আর একটি কথা মাথায় রাখা দরকার। বরিশাল চর্চা মানে আজকের প্রশাসনিক সীমায়িত বরিশাল জেলাটুকু নয়, আদিতে বাকলা চন্দ্রদ্বীপ, মধ্যে বাকেরগঞ্জ, পরবর্তীতে বরিশাল জনপদ অধুনা সাতটি জেলায় বিভাজিত, আজকের ‘বরিশাল’ তার একটি মাত্র। কিন্তু আজও প্রকৃত বরিশালকে বুঝতে গেলে তা পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুণা, পটুয়াখালি ইত্যাদি-সহ সমগ্র জনপদকে নিয়েই বুঝতে হবে। যে কোনও চন্দ্রদ্বীপজ মাত্রেই ‘বায়াস্ড’, মিহির সেনগুপ্তও তার বাইরে নন। কিন্তু পক্ষপাতের কাঁথায় লজিকের শক্ত সুতোর বুননটি তাঁর এতই টেঁকসই, তা অনেক রোদে জলেও থেকে যাবে।
ভাটিপুত্রের বরিশালি গদ্যসংগ্রহ-এর জন্রটি কী, বইটি শেষ করার পরে প্রথম প্রশ্ন জাগে। যখন ভাটিপুত্রের পত্র বাখোয়াজি (১৯৯৬), সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম (১৯৯৬) বা ধানসিদ্ধির পরনকথা (২০০৮) আলাদা বই হিসেবে প্রকাশিত হয়ে পাঠককে চমকিত করেছিল, তখন এগুলির গোত্র মোটামুটি নির্ধারিত ছিল। আলোচিত বইটিতে কিন্তু ভিন্ন গোত্রের গদ্যের সমাহার ঘটেছে, লেখক নিজেই দশটি ছোট মাপের রচনাকে একত্রে ‘চান্দ্রদ্বীপি কাহিনি আলেখ্য’ নাম দিয়েছেন। সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম-এ লেখক বেরিয়ে পড়েছেন— পর্যটকের মতো নয়, ভ্রামণিক হয়ে— এবং বহমান পথ তার আলেখ্য রচনা করেছে। হেমন্ত শেষের পাখিরা-র লেখক অনেকটা নিরাসক্ত ঔপন্যাসিকের মতো কাহিনির মৌল উপাদানগুলোকে গেঁথে গিয়েছেন। প্রতিটি লেখাতেই স্মৃতি খুব বড় একটা ভূমিকা নিয়েছে, সব ক্ষেত্রে তা লেখকের নিজস্ব স্মৃতি না হয়ে ক্বচিৎ একটা জনগোষ্ঠীর পক্ষপাতদুষ্ট স্মৃতিও হতে পারে, যাকে অতিকথা বলা যায় (রাজায় রাজায়)। কিন্তু স্মৃতিকথা বললে বইটির ওজন কমে যায়। সব দিক বিচার করে সব চেয়ে যৌক্তিক যে গোত্রে একে রাখা উচিত তা হল সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ়, তা সে লেখক যতই ‘‘ওই বর্গ-সমাজী তত্ত্ব ইতিহাসের কূটকচালে’’ নিয়ে চিমটি কাটুন না কেন।
এক জাতের বই আছে, পাঠক কতটা নিতে পারবেন ভেবে বুঝে তা লেখা হয়। অন্য জাতের বইয়ের ক্ষেত্রে পাঠককে নিজেকে তৈরি করে নিতে হয় বইটি পড়ার জন্য। আলোচিত বইটি এই দ্বিতীয় জাতের। এই বই লিখতে শুধু নয়, পড়তেও কলজের ধক লাগে! বরিশালি ভুবন অনাগরিক, বাজখাঁই ও সোজা। নাগরিক পরিশীলনের শোভন ও মৃদু মাপকাঠি দিয়ে তার তল পাওয়া কঠিন। পাওয়ার চেষ্টা করলে তা হবে, সরোজ দত্ত যেমন বলতেন, প্রজাপতি ধরার জাল দিয়ে সিংহ ধরতে যাওয়ার মতো বাতুলতা। মৃদু ব্যাপারটাই বরিশালে নেই যে! ধরুন, আপনি যখন প্রতিবেশীকে প্রশ্ন করবেন, ‘‘আপনার বাবা কেমন আছেন, শরীর খারাপ শুনেছিলাম’’, এক জন বরিহাইল্যা তখন সোজাসাপটা শুধোবেন, ‘‘বাপ আসে না গেসে?’’ এই প্রশ্নে পড়শির বাবার প্রতি দ্বিতীয় জনের উদ্বেগ কিছু মাত্র কম নয় কিন্তু, বরং খানিকটা বেশি হলেও হতে পারে। কিন্তু প্রশ্নের ধাক্কা না সামলাতে পারলে আপনি তার অন্তর্বস্তুতে পৌঁছতেই পারবেন না। মিহির সেনগুপ্তকে ধন্যবাদ, লেখাকে পাঠকরঞ্জন করে তোলার তাগিদে বরিশালের ভাষা-সংস্কৃতির খরখরে ধারগুলিকে পালিশ করে মসৃণ করতে যাননি। তিনি নিজে নির্ভুল বরিশালি ভাষা (বা উপভাষা?) লিখতে পারেন, যেটা অত্যন্ত জরুরি। এই আগ্নেয় ভাষায় পূর্ণ দখল না থাকলে এ নিয়ে খেলতে যাওয়া নিতান্ত অনুচিত। দেবেশ রায়ের বরিশালের যোগেন মণ্ডল-এর মতো সৃষ্টিও সে বিপর্যয় এড়াতে পারেনি। মিহির সেনগুপ্ত শুধু সে ভাষা নিয়ে হেলায় বাখোয়াজিই করেননি, বরং তাকে রীতিমতো ভাষাতত্ত্ব চর্চার পর্যায়ে তুলে নিয়ে গিয়েছেন। ভাষা এবং বাঙ্ময় চরিত্রগুচ্ছ— এই দুইয়ে লেখক এই পরনকথার আত্মা নির্মাণ করেছেন। বা বলা সঙ্গত, এই দুই মৌল উপাদানে নির্মিত আত্মার সার্থক অনুসন্ধান করেছেন। ভাষার মতোই চরিত্ররাও এখানে গল্পের প্রয়োজনে আসে না, বরং চরিত্রগুলিকে অনুসরণ করে এক একটি অণুগল্প কাহিনিতে ঢুকে পড়ে, চরিত্র এবং কাহিনি দু’টিকেই বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। এই ট্রিটমেন্টটা খুবই আকর্ষণীয়। গদ্যে সাধারণত চরিত্র কাঠামো এবং ভাষা অবয়ব নির্মাণ করে। এই গদ্য সংগ্রহে ভাষা যে খড় কাঠের কাঠামো তৈরি করে, চরিত্রগুলি তাতে মাটি ও রঙের প্রলেপ দেয়। ছোমেদ বয়াতি, মোকছেদ, ফকির সাহেব, ধোপাঝি, পাগলাদাদু, ছোটপিসিমা, এমনকি রায় রামচন্দ্র— কেউই আর তাই চরিত্র হয়ে থেকে যায় না, এক এক খণ্ড বরিশাল হয়ে জাগরূক থাকে।
মিহির সেনগুপ্ত তাঁর বইয়ে দু’টি প্রচলিত মিথকে ভেঙেছেন। দেশত্যাগী হিন্দু বাঙালির অতীতের মহিমা উদ্যাপনের বিপরীতে গিয়ে তিনি স্পষ্ট লিখেছেন, ‘‘আমার পূর্বজরাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। চরিত্রগতভাবেই এরা পরশ্রমাহারী।’’ পূর্ব বাংলায় হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের ভিত্তি হিসেবে ধর্মের আগে অর্থনৈতিক ও বর্গীয় সমীকরণকে সঠিক ভাবেই অগ্রাধিকারে রেখেছেন লেখক। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধ আর আওয়ামি লিগ নিয়েও অতিকথনকে খণ্ডন করেছেন।
একটি-দু’টি তথ্যে সংশয় থাকে যদিও, গৌণ হলেও। যেমন লেখক বলছেন, ‘‘তিনতলা এই লঞ্চগুলোকে রকেট বলে। যখন দেশ ছেড়েছিলাম তখন ছিল ইস্টিমারের যুগ।’’ রকেট কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। সঠিক তথ্য হল দেশ ছাড়ার সময়ের সেই প্যাডল স্টিমারকেই ‘রকেট’ বলা হত, এখনও হয়। ১৯২৭-এর ঐতিহাসিক মাসুদ স্টিমার, এবং আরও তিনটি, এখনও ঢাকা-বরিশাল-মরেলগঞ্জ রুটে চলমান। এই তথ্যবিভ্রাটে অবশ্য স্টিমার বা লেখা কোনওটির গতিই ব্যাহত হয় না, উল্লেখ করার কারণ এই মাত্র যে বইটি তো শুধু একটি সুখপাঠ্য বই-ই নয়, নিম্ন-গাঙ্গেয় সমভূমি চর্চার একটি আকরও বটে।
বইটির প্রযোজনা যথাযথ, ছিমছাম। সুদীপ্ত দত্ত কৃত প্রচ্ছদে মায়াময় সিলুয়েটের পশ্চাদ্পটে নামলিপিতে বলিষ্ঠ হরফের ব্যবহারও সুচিন্তিত। এই মায়া, এই দার্ঢ্যের সম্মিলনই তো বরিশাল।