—ফাইল চিত্র।
দ্রিঘাংচুর দিগ্দর্শন (খণ্ড ১-২)
সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
৪০০.০০ প্রতি খণ্ড
সপ্তর্ষি প্রকাশন
এও এক দক্ষিণের বারান্দা।
কিন্তু একেবারে ভিন্ন বারান্দা। বারান্দার ভেতরের কাজকর্মের কথা নেই এক অক্ষরও, বরং বারান্দার রেলিংয়ে বসা বায়সটি যেমন ঘাড় বাঁকিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে, দেখতে দেখতে উড়ে যায় কিন্তু দূরে যায় না— এই বইয়ের দেখাটি যেন তেমনই। বই বলব না বই দু’টি বলব? ডবল ক্রাউন সাইজের আড়াইশো পৃষ্ঠার দুটি গ্রন্থ, গ্রন্থিত অর্থে। মাথায় একই নামলাঞ্ছন— দ্রিঘাংচুর দিগ্দর্শন। লেখক ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু দ্রিঘাংচুর সঙ্গে মিল ওই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখাটুকুই। দ্রিঘাংচুর দেখায় কী আছে— কোনও ক্ষমতার দৃষ্টি? না ব্যঙ্গ না ভীতিপ্রদর্শন? রাজক্ষমতাধারীকে ভাবিত করেছিল সেই ভাবনা। কিন্তু এই বইয়ের লেখকের দেখায় যে অন্তত তেমন কিছু নেই, তা নিশ্চিত বলা যায়। বেশির ভাগ সময়েই এক প্রসন্ন সকৌতুক দেখা।
দেখা কি, দস্তুর মতো দর্শন। উত্তর-দক্ষিণ কলকাতার জনমনিষ্যি, অলিগলি, খাওয়া-থাকা, কায়দাকেতার হ্যান্ডবুকপ্রায়। বিখ্যাত মানুষদের কথা দিয়ে শুরু করলে ‘লেখকপসন্দ’ প্রথম নামটি অবশ্যই শিবরাম। আদি ও অকৃত্রিম শিবরাম চক্রবর্তী। তাঁকে বলছেন সাহিত্যরসের ‘ভিয়েনসম্রাট’। তা ছাড়াও আছে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা তৈরির রেসিপি, কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় বা স্যার আশুতোষের দাম্পত্যজীবন, নগেন্দ্র সান্যাল, যাঁকে জগৎবাসী চেনে পাহাড়ি সান্যাল নামে, শচীন কর্তা— ‘‘বেণু, আজ শ্যামলরে (মিত্র) রসগোল্লার বদলে শুক্তা দিবি। গলা এর থিক্যাও মিঠা হইলে, আর কারও ভাত থাকব না’’, মধ্য-ষাট থেকে নব্বই পর্যন্ত কলকাতার সংস্কৃতিজগতের মণিরত্নদের নিয়ে নানান বৈঠকি গল্প— কিছু শোনা, কিছু দুঃসাধ্য চেষ্টায় খুঁজে বার করা যেমন ‘লেডিকেনি, নীল আম আর বেদনার পেয়ালা’ দু’টুকরো, মধুসূদন ডাট-এর বংশধর কলকাতা-নিবাসী বিশ্বরূপ ডাট, আরও অনেক অমূল্য ধন। আর, একটা বড় অংশই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া।
সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিস্তারও বেশ অনেকখানি। মায়ের হাত ধরে স্কুল যাওয়ার বয়েস থেকে ঝাঁকিদর্শনে নিজের কেয়াতলা পাড়ার ‘কাজলাদিদি’র যতীন্দ্রমোহন, দূর থেকে দেখা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়— ‘‘এককাপ চা নিয়ে বসে থাকতে দেখত তাঁকে, কখনো চুমুক দিতে দেখা হয়নি’’, পরম শিল্পী সুনীলমাধব সেন ‘‘ফুকফুক চুরুট খেতেন আর রংচঙে জামা...আর তাকে একটা পেন্সিলে পাখির ছবি এঁকে দিয়ে বলতেন— এই নাও কৃষ্ণঠাকুর। আপত্তি করলে একগাল হেসে বলতেন... ‘যে কৃষ্ণ সেই বিহঙ্গ’’, যমুনা বড়ুয়া হয়ে একেবারে প্রথিতযশা চিকিৎসক ও সামাজিক মানুষ হিসাবে অভিজ্ঞতার বহু বৈচিত্রে কাছে এসে পড়া নানা মুখ। মহাগুণবান থেকে একেবারে ভাগ্যহীন— কত মানুষের মুখচ্ছবি যে উপচে উঠছে বইয়ের পৃষ্ঠা ভরে! ভাল ঔপন্যাসিকের মতো দেখা—একটু যেন দূর থেকে, একটু দূরত্ব থেকে, নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখা। বহু পরিশ্রমলব্ধ এত খবর ও ভাবনা কোথাও বোঝা হয়ে ওঠেনি, পরিবেশিত হয়েছে এক নির্ভার পরিশীলিত কৌতুকের ভঙ্গিতে।
ভীষ্ম সাহনিকে যেমন বলা হত ‘দিল্লির কথাকার’— ক্রনিকলার অব দিল্লি, সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে কি তেমনই এক অনুসন্ধানী ভক্ত খুঁজে পেল কলকাতা? ভীষ্মও দিল্লির নন, বাইরে থেকে এসে আর ছেড়ে যেতে পারেননি। সিদ্ধার্থ বারে বারে মেনে নিচ্ছেন সব দোষপঙ্ক, কুটিলতা, নিস্পৃহতা নিয়েই এই শহর কেমন ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছে তাঁকে। কলকাতার প্রেমিক কম নন, তাঁদের দ্যুতিও কম নয় কোনও অর্থেই। তবু কোথাও যেন এই গ্রন্থ দু’টির রচয়িতাকে একটু ভিন্ন মনে হয়। কেবল রোম্যান্টিক তীব্রতার আত্মসমর্পণ নয়, কোথাও একটু দূরত্ব, যতটুকু দূরত্ব থেকে শুধু মুখ নয়, দেখা যায় সর্ব অবয়ব— ততটুকু। ‘কাঠবাঙাল’-এর অভিমান আর আঁকড়ে ধরা, একই সঙ্গে। কলকাতার মানুষজন শুধু নয়, এ শহরের পাখপাখালি, গাছ, গলি, হরেক কোনাখাঞ্চির নিজস্ব খাবারের দোকান— উত্তরের ঘুপচি চায়ের দোকান থেকে লেক ক্লাবের দোতলার জলবারান্দা। খুঁড়ে দেখাচ্ছেন গড়িয়াহাট কেয়াতলার মণিপুরী বিবরণ থেকে কলকাতার গলির গলি। ‘‘একরকম ফ্যাকাশে কিংবা ধূসর রোদ এখানে এসে পড়ে রোজ। মাথার ওপর সারি সারি জানালা জানান দেয় অনেক অন্য পৃথিবীর...। গলিপথ যেন এই শহরের ‘কাকের পা’— বলিরেখা, জীবনযাত্রার এক মেটাফর।’’ (পৃ ১/১৩৬) কোনটা সবচেয়ে প্রাচীন, কোন গলির নামের কী ইতিহাস। কে ছিলেন ছকু খানসামা, কে-ই বা ছিদাম মুদি। আছে পাতিরাম থেকে সাঙ্গুভ্যালী-র আদি বৃত্তান্ত, ফুচকার সৃষ্টি ও বিস্তার, সোনাগাছির বিবরণ— একেবারে হরেকরকমবার ভূগোল ও ইতিহাস। এই পড়ার একটা মজা আছে। মুগ্ধতাও।
সেই নানা স্তরের ভূমিতে চলতে চলতে এক সময়ে খেয়াল হয়, এখানেও লেখা বিষয়ে এক প্রধান অংশ দখল করেছেন মেয়েরা। না, কোনও রোমান্টিক ললিত ছবি নয়, নয় কোনও দুঃখকাতর অস্তিত্ব। মেয়েদের বিষয়ে এ লেখকের পক্ষপাতিত্ব বেশ দৃশ্যমান। ভূগোলে আর ইতিহাসেও। আজকের বিশেষ গলির ‘অবিদ্যা’রা থেকে শুরু করে স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বস্ব লুটিয়ে দেওয়া ননীবালা-সিন্ধুবালা-দুকড়িবালা। কাল আর আজ যাদের কেউ মনে রাখে না, যারা এক্সপেন্ডেবল, তাদের একবার স্মরণের স্বীকৃতি দিয়ে যেন নাগরিক উদাসীনতার পাপের স্খালন। একটু বিপ্রতীপ চর্চাও আছে কলকাতার। উজ্জ্বল পুরুষদের ছায়ায় ঢাকা পড়া ভাস্বতীদের মধ্যে আছে সিমলের নরেন্দ্রনাথের বিশ্ববিজয়ের ঔজ্জ্বল্যে যে মেয়েটি ঢাকা পড়ে গিয়েছে, সে কালের বোম্বাই শহরের অপরাজিতা, সাত মেয়ের মা, সেই ফ্রান্সিস জিন সোরাবজি-র কথা। শিকাগো শহরের সর্বধর্ম মহাসম্মেলনে যাওয়ার রাহাখরচ জোটাতে স্বামীর জমি বিক্রি করার পাশাপাশি তার জন্য চাঁদা তুলেছিলেন বোম্বাই-পুণে-নাসিকের বস্তিবাসীরা— মাছ সব্জি ডাব বিক্রেতারা, গণিকা মুজরোওয়ালিরা, বিভিন্ন স্কুল হাসপাতালের কর্মচারীরা কারণ তিনি ছিলেন এদের সর্ববিপদের সাথী ‘জেনানা মাঈ’। আর সম্মেলন চলার সময়ে একমাত্র অন্যদেশি নারীবক্তা হিসাবে বিনামূল্যে ঠাঁই পেয়েছিলেন একটি উইমেনস হোস্টেলে, ময়লা কাপড় কাচা আর ঘর মোছার দামে। ভারতের ঐশ্বর্যে আয়েস করা ইংরেজ ‘নাথু তেলি’দের সরকারের কোনও সঙ্কোচ হয়নি।
আছে ঋষি অরবিন্দের স্ত্রী সাবিত্রী বসুর কথা। চোদ্দো বছরে বিবাহিত যে ছাত্রীটির পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় বিয়ের পর, তার বিলেতফেরত অধ্যাপক স্বামী রইলেন গ্বালিয়রেই। নিজের আদর্শের শিক্ষা দিতেন স্ত্রীকে চিঠিতে। সঙ্গে এও লিখে দিতেন যে হেতু তুমি এ সব কিছু বোঝ না, তাই উত্তর দেওয়ার দরকার নেই। মেয়েটিও ভয় পেত চিঠি লিখতে পাছে ইংরেজি ভুল হয়। তারপর স্বদেশি কর্মকাণ্ড, কারাবাস, আত্মগোপন, পন্ডিচেরিতে আশ্রম, মাতৃভাবী সাধিকা সঙ্গিনী, অধ্যাত্মচর্চা। সাবিত্রীকে লিখেছিলেন একবার ঘুরে যেতে, ‘শান্তি পাবে’। জবাবে তিনি বাংলায় জানান ‘এখানেই বেশ আছি’। আমাকে সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করেছে ‘কালাপানি’— প্রথম দ্বীপান্তরিত পাঁচ অনাম্নী নারীর বুক মুচড়ে ওঠা উপাখ্যান।
এমন অসংখ্য ইতিবৃত্ত। সংবেদী মন। ভাষাকুশল উপস্থাপনা। এ সব লেখা কী করে এত দিন অপ্রকাশিত ছিল, সেও আশ্চর্য। আর, তাই হয়ত একটা অস্বস্তি হয়। এটি চিকিৎসা সম্পর্কিত বই নয়, সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় কেমন চিকিৎসক জানি না কিন্তু নিজশক্তিতে সমর্থ লেখক। সে ক্ষেত্রে মলাটের ওপরে, ভেতরে নামের সঙ্গে ‘ডা.’ পরিচিতি কিঞ্চিৎ দৃষ্টিকটু লাগে। সম্পাদক এ বিষয়ে মনোযোগী হলে ভাল হত।
বৃহৎ কলেবর বই দু’টির অঙ্গসৌষ্ঠবও চমৎকার, কেবল সুখপাঠে মাঝে মাঝে বাদ সাধে মুদ্রণপ্রমাদ, বিশেষত দ্বিতীয় খণ্ডে।