মুক্তবুদ্ধি: কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০)
নির্বাচিত রচনা ১ / কাজী আবদুল ওদুদ
সম্পাদক: হাবিব আর রহমান
৫৫০.০০
করুণা প্রকাশনী
বাংলা ইংরেজি দুই ভাষা মিলিয়ে কাজী আবদুল ওদুদের মোট পঁচিশটি বই কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। পূর্ববঙ্গের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও ওদুদ ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে ওপার বাংলায় চলে যাননি, পাকিস্তান সরকারের তরফে লোভনীয় চাকরির প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও তা প্রত্যাখ্যান করে তিনি কলকাতাতেই থেকে যান। কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন রামমোহনপন্থী এবং গভীর রবীন্দ্রানুরাগী। শুধু তাই নয়, রামমোহন এবং রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ লেখালিখি রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কলকাতা তাঁকে মনে রাখেনি। তাঁর বইগুলি এ বঙ্গে দুর্লভ হয়ে পড়েছে। ২০০২ সালে প্রকাশিত ‘বাংলার মুসলমানের কথা’ নামে একটি প্রবন্ধ সংকলন ছাড়া কাজী আবদুল ওদুদের কোনও বই এ বঙ্গে ছিল অমিল।
কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাবিব আর রহমানের সম্পাদনায় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কাজী আবদুল ওদুদের ‘নির্বাচিত রচনা’ প্রথম খণ্ড। ঢাকার বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ৬ খণ্ডে ‘কাজী আবদুল ওদুদ রচনাবলী’ বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এ বাংলায় সে রকম কিছু ছিল না। একাধারে সাহিত্যবোদ্ধা এবং চিন্তানায়ক ওদুদের নির্বাচিত রচনার সুবৃহৎ এই সংকলন আশা করা যায় এ বঙ্গে সে অভাব কিছুটা দূর করবে। আমাদের এই বিস্মৃতি তো আগ্রহের অভাব থেকেই। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, এ বাংলায় মুসলমান সমাজেও ওদুদকে নিয়ে আগ্রহ প্রায় নেই। অথচ ওদুদের মুসলিম সমাজ সংস্কার প্রচেষ্টার ঘোর সমালোচক ‘মোস্তাফা চরিত’ রচয়িতা মোহম্মদ আকরাম খাঁকে নিয়ে আগ্রহের অভাব দেখি না।
মুসলমান সমাজের সংস্কার প্রচেষ্টা আর হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয় সাধনা করতে গিয়ে ওদুদকে সারাটা জীবন সইতে হয়েছে লাঞ্ছনা— তাঁর নিজের সমাজ থেকে তো বটেই বাইরে থেকেও। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু চিনেছিলেন তাঁকে। হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ-বিভীষিকার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ওদুদকে দু’কূলের সেতু হিসেবে দেখেছিলেন। ১৯৩৫ সালে কবির আমন্ত্রণে ওদুদ বিশ্বভারতীতে ‘হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ’ বিষয়ে তিনটি বক্তৃতা দেন। সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতামালা পরে বই হয়ে প্রকাশিত হয় বিশ্বভারতী থেকে, রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা সমেত। আজ সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাস আর অসম্প্রীতি গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, বাংলাও বাদ নেই। এই সংকটের সময়ে তাঁর লেখাগুলো অত্যম্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক জানাবোঝা বাড়লে অবস্থার আরও একটু উন্নতি হতে পারে, এমনই মনে করতেন ওদুদ। সেই জানাবোঝার অভাব এখনও অনেকটাই একই রকম রয়ে গিয়েছে। বাংলায় হিন্দু-মুসলমান চর্চার ক্ষেত্রে এখন কাজী আবদুল ওদুদ তাই আমাদের কাছে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। মুসলমান সমাজে একটা নবজাগরণের স্বপ্ন দেখতেন ওদুদ। ঈশ্বরের নামে প্রচারিত যে সব বিধি-বিধান জীবনে উন্নতির প্রতিবন্ধক, সেগুলো বর্জন করাই কাম্য মনে করতেন তিনি। অন্য দিকে ধর্মপ্রাণ ওদুদ কোরান অনুবাদ করেছেন, লিখেছেন হজরত মুহাম্মদের জীবনী।
১৯২৬ সালে ঢাকায় কয়েকজন তরুণ সাহিত্যিক এবং চিন্তাবিদ মিলে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। ওদুদ ছিলেন সেই সংগঠনে অগ্রগণ্য। তাঁদের মন্ত্র ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’। মুক্ত বুদ্ধিকে তাঁরা ধর্মের ওপরে স্থান দিয়েছিলেন। দেশভাগের পরে ঢাকাকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গে বাঙালি মুসলমানের যে নতুন একটা মুক্তমনের সমাজ গড়ে উঠতে শুরু করল তাকে ওদুদদের ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনেরও উত্তরাধিকার বলা যেতে পারে।
সেই ধারার এক যোগ্য উত্তরাধিকারী এ বইয়ের সম্পাদক ও সংকলক হাবিব আর রহমান। বাংলাদেশের মুক্তমনা প্রবীণ এই গবেষকের প্রধান কাজের ক্ষেত্র উনিশ ও বিশ শতকের মুসলমানের চিন্তা চর্চার জগৎ। মুসলিম সাহিত্য সমাজ, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন এবং তার সেনানীদের জীবন ও চিন্তাধারা নিয়ে তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ ইতিমধ্যেই করেছেন।
তাঁর সম্পাদনায় বর্তমান গ্রন্থটিতে ওদুদের রচনাগুলি যে ভাবে সংকলিত হয়েছে তাতে নিবিষ্ট পাঠক প্রথম খণ্ডেই ওদুদের চিন্তাধারা আর গদ্যশৈলী বুঝে নিতে পারবেন। বইটির গুরুত্ব বেড়েছে তাঁর ভাষণ, পত্রাবলি, ডায়েরি এবং বিভিন্ন বাদ-প্রতিবাদ যুক্ত করায়। এটুকু নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, যোগ্য হাতে সম্পাদিত হয়েছে ওদুদের রচনা। বর্তমান সময়ে ওদুদের রচনার এমন একটি সংকলন এই বঙ্গে প্রকাশিত হওয়া নিতান্তই জরুরি ছিল।
মিলন দত্ত