বিহঙ্গদৃষ্টি: নীল-গলা চুটকি (বাঁ দিকে উপরে), ছবি: সাগর গোসাভি। ফটিকজল (নিচে), ছবি: তন্ময় দাস। শ্যামা (ডান দিকে), ছবি: সৌরভ মণ্ডল
বাংলার পাখপাখালি (প্রথম খণ্ড)
লেখক: কনাদ বৈদ্য, সন্দীপ দাস, শান্তনু প্রসাদ ও ক্ষৌণীশশঙ্কর রায়
১৫০০.০০
ফরেস্ট ডুয়েলার্স (গাজল, মালদহ)
শিকার করার জন্য অন্য জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে পাখিদের খোঁজ রাখা বা তাদের আচার-আচরণের খবর রাখা— বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ এসব করে আসছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই। তবে, মানুষ তো আর কেবল শিকারি জন্তু নয়, বিবর্তনে তারা পেয়েছে প্রকৃতির শোভাকে ভালবাসার মতো এক মন। সেখানে মুক্ত বিহঙ্গের স্থান সবার উপরে। নইলে, আদি কবি থেকে জীবনানন্দ, হোমার থেকে হুইটম্যান সবার লেখায় পাখিরা কেন ফিরে ফিরে আসে বার বার নানান রকমের অনুভূতি প্রকাশের দায়িত্ব নিয়ে?
তবে, নতুন নতুন প্রজাতির পাখিদের সুনির্দিষ্ট ভাবে পর্যবেক্ষণ করে তাদের ছবি এঁকে রাখা, তাদের দেহ-সৌষ্ঠবের, আচার-আচরণের বিশিষ্টতার বর্ণনা লিখে রাখা, এই জ্ঞানচর্চার উদ্ভব ঘটেছে খুব সম্ভবত মধ্যযুগের ইসলামি মনীষীদের হাত ধরে, নবম শতকের আল-জাইজ, দ্বাদশ শতকের নাসির আল তুসি-র নাম যাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। আমাদের দেশেও সেই প্রকৃতিচর্চার প্রভাব খুব ফিকে ভাবে হলেও যে এসে পৌঁছেছিল, তার প্রমাণ মুঘল আমলে বিশিষ্ট চিত্রকরদের দিয়ে পশুপাখির চিত্রায়ণ। তাদের মধ্যে, জাহাঙ্গিরের পৃষ্ঠপোষকতায় চিত্রকর উস্তাদ মনসুরের আঁকা পাখির ছবিগুলি আজও সেরা শিল্পের মর্যাদা পায়। ওদিকে, এদের প্রভাব পৌঁছয় মধ্যযুগের শেষে জেগে ওঠা ইউরোপে, সেখানে এর পূর্ণতর প্রকাশ ঘটতে থাকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে। নতুন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে শোষণযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদের খোঁজ করতে গিয়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড ইত্যাদি দেশের অভিযাত্রী-বিজ্ঞানীরা উষ্ণমণ্ডলীয় দেশগুলির অসাধারণ সমৃদ্ধ জীববৈচিত্রের সন্ধান পেয়ে চমকে গেলেন। শুরু হল নতুন নতুন প্রজাতির নমুনা সংগ্রহ, তাদের পরিচিতি জানার প্রয়াস, গড়ে উঠল বড় বড় ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম। সেখানেও পাখিদের ছবি, সংরক্ষিত মৃতদেহ, পালক, ডিম, বাসা প্রধান স্থান পেল। একই সঙ্গে, তাদের স্বদেশভূমিতেও বাইনোকুলার দিয়ে বা খালি চোখেই নিয়মিত পাখি দেখা, সে সব দেখার কথা ডায়েরিতে নোট করে রাখা, নতুন কোনও চমকপ্রদ পর্যবেক্ষণ জার্নালে ছাপানো— এগুলি এক শ্রেণির শিক্ষিত উচ্চবিত্তের মধ্যে সিরিয়াস হবি হয়ে দাঁড়াল। সেই সঙ্গে অবশ্য বন্দুক বাগিয়ে পাখি শিকার এবং পাখিদের মৃতদেহ, পালক, ডিম, বাসা এসবের ব্যক্তিগত সংগ্রহের দেখনদারি ইত্যাদি বড়লোকিপনাও ছিল।
ভারতবর্ষের মতো জীববৈচিত্রে অতিসমৃদ্ধ দেশে পাখির বৈচিত্র্যও প্রায় অফুরান, ব্রিটিশ রাজপুরুষরা এদেশে এসে এই হবি যে বেশ চুটিয়ে পালন করবেন, তা বলাই বাহুল্য। সেই সঙ্গে সংস্পর্শ দোষে (!) ব্রিটিশ আনুকূল্যে ধন্য ভারতীয় রাজন্যবর্গ, জমিদার এবং উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত শ্রেণির অনেকের মধ্যেই পাখি দেখার অভ্যাসটি গড়ে উঠল। শেষমেশ যার শুভতম ফল দাঁড়াল সালিম মইজুদ্দিন আব্দুল আলি! সালিম আলিই এখনও পর্যন্ত একমাত্র ভারতীয় পক্ষিবিশারদ যিনি সারা বিশ্বের পক্ষিবিশারদদের কাছ থেকে উচ্চতম সম্মান আদায় করে নিয়েছেন। ১৯৪১-এ প্রকাশিত হল তাঁর সচিত্র দ্য বুক অব ইন্ডিয়ান বার্ডস! এই একটি বই, পাখি দেখবার, নতুন পাখি চিনবার আনন্দকে মধ্যবিত্তের আওতায় এনে দিল। আস্তে আস্তে সাধারণ শিক্ষিত মানুষের মধ্যে বাইনোকুলারে চোখ রেখে পাখি চিনবার মন তৈরি হতে থাকল সারা ভারত জুড়ে। সংরক্ষণ আইনে শিকার বন্ধ হওয়ায় উচ্চবিত্ত পাখিশিকারির দলও তখন বন্দুক নামিয়ে বাইনোকুলার আর ক্যামেরা তাক করতে শুরু করেছে পাখিকে লক্ষ্য করে। এ গল্পে অবশ্য অকথিত ভাবে তাঁরাও আছেন, যাঁরা আদি-অনাদি কাল থেকে পাখিদের চিনেছেন, দেখেছেন পেটের তাগিদে, কিংবা, নিছক তাঁদের প্রতিবেশী হিসাবে, যাঁরা সাহেবকে খালি চোখে চিনিয়ে দিয়েছেন কোন ছোট পাখিটা কোন উঁচু গাছের মগডালে বসে আছে, কেমন সে শিস দেয় সঙ্গিনীকে ডাকতে, কোথায় তারা বাসা বাঁধবে, কেমন করে বুলেটে ছিন্ন না করে তাকে ধরা যাবে ফাঁদ পেতে। সেই সব নগ্ন-পদ নেংটি পরা ব্যাধ আর আদিবাসী মানুষ, যাঁরা দুটো পয়সার বিনিময়ে তাঁদের জ্ঞানভাণ্ডার উপুড় করে দিয়েছেন ভারতীয় পক্ষীবিজ্ঞানের জন্ম থেকে তার পরিস্ফুরণে।
এদেশে সাহেবদের পত্তনভূমি বাংলার মাটিতে পাখি দেখার ইতিহাস ভিন্নতর কোনও চিত্র নয়। তার চমৎকার চরিত্রচিত্রণ করেছেন যুধাজিৎ দাশগুপ্ত তাঁর ‘বাংলার পাখিচর্চা— ঝাঁকিদর্শন’ নামের ছোট্ট কিন্তু তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধটিতে। বস্তুত, এই সচিত্র পক্ষীদর্শন সহায়িকাটির আলোচনা করতে গিয়ে এই প্রবন্ধটিই আমাকে অযাচিত ভাবে উপরের মুখড়াটি লিখতে প্রলুব্ধ করেছে। ঝাঁকিদর্শন ও পাখিদের স্থানীয় নাম নিয়ে লেখা যুধাজিতের আর-একটি ছোট প্রবন্ধ এই বইয়ের প্রধান বৌদ্ধিক সম্পদ! এ ছাড়া আছে, পরিযায়ী পাখিদের নিয়ে অর্ক সরকারের লেখা একটি প্রবন্ধ, তথ্যসমৃদ্ধ হলেও, পরিযায়ী পাখিরা ৬৫০০০ মিটার পর্যন্ত উপরে উঠে হিমালয় পার হয়, এরকম একটি অতিশয়োক্তি (৩১ পাতায়, সম্ভবত, ছাপার ভুলে) তার প্রবন্ধের মানহানি করেছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সর্বোচ্চ উচ্চতা হল বিষুবরেখা বরাবর ১৭০০০ মিটারের আশপাশে! পশ্চিমবঙ্গের ভূ-প্রকৃতি নিয়ে আর একটি প্রবন্ধ খুবই সাদামাটা, পাখি দেখতে বেরিয়ে কিংকর্তব্য সংক্রান্ত উপদেশনামাটি অবশ্য যথাযথ।
বইটির মূল উপজীব্য হল এই বঙ্গভূমিতে দ্রষ্টব্য শুধু প্যাসেরিফরমিস (Passeriformes) গোত্রের ৪৫০টিরও বেশি প্রজাতির পাখির সচিত্র পরিচিতি। প্যাসেরিফরমিস বা দণ্ডচারী বর্গের পাখিরাই সংখ্যায় বেশি, পৃথিবীর মোট পাখির অর্ধেকেরও বেশি এই বর্গের সদস্য। বুলবুলি, ছাতারে, টুনটুনি, মুনিয়া, চড়াই, মৌটুসি, কাক ইত্যাদি যেমন এই দলে আছে, তেমনই নেই হাঁস, কাদাখোঁচা, পেঁচা, কাঠঠোকরা, পায়রা, পাপিয়া ইত্যাদি। এই বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন, পশ্চিমবঙ্গে নতুন দেখা গিয়েছে এমন সব পাখির লিস্টি। প্রত্যেকটি ছবি আধুনিক ডিজিটাল ক্যামেরা, ফটোশপ, অফসেট প্রেস ও পক্ষীচিত্রগ্রাহকদের যৌথ কৃতিত্বে ঝকঝকে, প্রায়শই পাখিটিকে চিনতে অসুবিধা হয় না। চিত্রের সঙ্গে বর্ণনা যথেষ্ট। সব মিলিয়ে (দেড় হাজার টাকার দামটি বেশ) বাংলা ভাষায় সমীহ করবার মতো পক্ষীসংক্রান্ত বই! নিঃসন্দেহে পিক্সেলে বন্দি পাখিদের গায়ে কেতাবি পরিচিতি সেঁটে ফেসবুকের পাতায় লাইক কুড়োতে বঙ্গভাষী ক্যামেরা-শিকারিদের সাহায্য করবে।
একটাই আপশোস যে, বইটির এ পাতা ও পাতা ঘুরেও অনুভব হল না যে, বইটা আনকোরা কাউকে পাখি দেখতে উদ্বুদ্ধ করবে চোখ দিয়ে মনের ফ্রেমে বন্দি করার জন্য, শুধু ক্যামেরা-শিকারের জন্য না। সালিম আলির বইয়ের সেই অন্তর্দৃষ্টি নেই এদের বর্ণনায়। সে আকাঙ্ক্ষাটাও বোধহয় অন্যায়। তবুও!