সুদ যে কমতে পারে, সেই সম্ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু তা যে এখনই কমবে, তেমন প্রত্যাশা বড় একটা ছিল না। তাই সেই অর্থে সকলকে কিছুটা চমকে দিয়েই বৃহস্পতিবার ২৫ বেসিস পয়েন্ট সুদ (রেপো রেট) কমানোর কথা ঘোষণা করল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। দীর্ঘ ১৯ মাস বাদে। ২০১৩-র মে মাসের পরে ও রঘুরাম রাজনের জমানায় এই প্রথম।
শীর্ষ ব্যাঙ্কের এই ঘোষণার কিছুক্ষণ পরেই নিজেদের বেস রেট (যার ভিত্তিতে আমানত ও ঋণে সুদের হার ঠিক হয়) ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমানোর কথা ঘোষণা করেছে ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক। আমানত ও ঋণে ৫০ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত সুদ ছাঁটাইয়ের কথা ঘোষণা করেছে ইউনিয়ন ব্যাঙ্কও। একই পথে হাঁটার ইঙ্গিত দিয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক, আইসি আইসিআই ব্যাঙ্ক-সহ অন্য ব্যাঙ্কগুলি। শেষ পর্যন্ত তারা সত্যিই সুদ কমালে, বাড়ি-গাড়ি সমেত প্রায় সব ধরনের ঋণে মাসিক কিস্তির অঙ্ক কমবে। কিছুটা স্বস্তির শ্বাস ফেলবেন সাধারণ মানুষ। কমবে শিল্পের মূলধন জোগাড়ের খরচও।
এ দিন একেবারে সকালেই রেপো রেট (রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে-সুদে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে স্বল্পমেয়াদে ধার দেয়) ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৭.৭৫% করার কথা ঘোষণা করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। শিল্প আর শেয়ার বাজার যে এই সিদ্ধান্তের দিকে কেমন চাতক পাখির মতো তাকিয়েছিল, তা স্পষ্ট হয়ে যায় পরের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। কারণ, মূলত এই খবরের দৌলতেই এ দিন এক লাফে প্রায় ৭২৯ পয়েন্ট বেড়েছে সেনসেক্স। ফের টপকে গিয়েছে ২৮ হাজারের গণ্ডি।
তবে শুধু ২৫ বেসিস পয়েন্ট সুদ ছাঁটাই কিংবা তা ঘোষণার সময় বাছাইয়ে চমকে দেওয়ার জন্য নয়। শীর্ষ ব্যাঙ্কের এ দিনের সিদ্ধান্তকে আরও দু’টি কারণে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছেন অনেকে
(১) একে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঋণনীতির অভিমুখ পরিবর্তন হিসেবে দেখছেন তাঁরা। দেখছেন, আবার কম সুদের জমানায় ফিরে যাওয়ার সূচনা হিসেবে। ফলে চলতি বছরে শীর্ষ ব্যাঙ্ক দফায় দফায় সুদ আরও অনেকটা কমাবে বলে তাঁদের আশা। ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের প্রাক্তন সিএমডি ভাস্কর সেনের মতে, “আশা করি সুদ আরও কমবে। এই ঘোষণা সেই যাত্রার শুরু।”
(২) বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশ আবার মনে করছেন, এর মাধ্যমে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এবং তাঁর বাজেট তৈরির কারিগরদের কার্যত চ্যালেঞ্জ ছুড়লেন শীর্ষ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজন। পূর্বসূরি পি চিদম্বরমের মতো জেটলিও একাধিক বার দাবি করেছেন যে, দেশের বৃদ্ধির চাকা আটকে রয়েছে চড়া সুদের চোরাবালিতে। অনেকে তাই মনে করছেন, কম সুদের জমানায় ফিরতে শুরু করার ইঙ্গিত স্পষ্ট করে দিয়ে বাজেটের মুখে সেই জেটলির সামনেই চ্যালেঞ্জ সাজিয়ে দিলেন রাজন। যেন অঘোষিত বার্তা রইল, ‘সুদ কমেছে। দেখা যাক অর্থনীতিতে প্রাণ ফেরাতে এ বার কেন্দ্র কী করে।’
সরকারি ভাবে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, খুচরো এবং সার্বিক মূল্যবৃদ্ধি দুই-ই কমেছে। আগামী দিনেও তা লক্ষ্যমাত্রার ভিতরে থাকবে বলে তাদের অনুমান। তা ছাড়া, বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দর আশাতীত ভাবে নামায় তা আমদানির খরচ কমেছে। রাজকোষ ঘাটতিকে জাতীয় আয়ের ৪.১ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখার ক্ষেত্রে একবগ্গা দেখাচ্ছে কেন্দ্রকে। আর এই সমস্ত কথা মাথায় রেখেই তারা সুদ ছাঁটাইয়ের পথে পা বাড়িয়েছে বলে শীর্ষ ব্যাঙ্কের দাবি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিঃসন্দেহে দেশের অর্থনীতির (বিশেষত মূল্যস্ফীতি ও ঘাটতি) সার্বিক হাল দেখেই সুদ কমানোর পথে হেঁটেছেন রাজন। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে এলে, নতুন বছরের গোড়ায় সুদ কমানোর ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিলেন তিনি। এমনকী ৩ ফেব্রুয়ারির ঋণনীতির আগেই যে তা করা হতে পারে, সেই ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। কিন্তু এই সব কিছু সত্ত্বেও যে-ভাবে একেবারে আচমকা এ দিন সুদ ছাঁটাইয়ের কথা ঘোষণা করা হয়েছে, তা অবাক করে দিয়েছে অনেককে। বিশেষত যেখানে সর্বশেষ পরিসংখ্যানে সামান্য হলেও মাথা তুলেছে খুচরো ও সার্বিক মূল্যবৃদ্ধি। প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি বৃদ্ধির পথে কাঁটা হিসেবে চড়া সুদকে তুলে ধরার রাস্তাই তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিতে চাইলেন রাজন? যাতে অন্তত বোঝা যায়, বৃদ্ধির চাকায় গতি ফেরাতে কেন্দ্র বাজেটে কী করতে পারে। কতখানি সংস্কারের পথে হাঁটতে পারে? ঘাটতিতেই বা রাশ টানতে পারে কতখানি?
প্রত্যাশিত ভাবেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই পদক্ষপকে স্বাগত জানিয়েছেন জেটলি। তাঁর কথায়, “সুখবর। এতে ক্রেতাদের হাতে বাড়তি টাকা আসবে। বাড়বে কেনাকাটা। চাকা ঘুরবে অর্থনীতির।” মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যনের আশা, ঋণনীতির অভিমুখ বদলের সূচনা হল এর মাধ্যমেই।
সুদ কমায় খুশি শিল্পমহলও। একে স্বাগত জানিয়েছে সিআইআই, ফিকি-সহ বণিকসভাগুলি। তবে সুব্রহ্মণ্যনের মতো শিল্পেরও আশা, এ বারের সুদ ছাঁটাই আসলে কমার শুরু। আগামী দিনে সুদ আরও কমবে। ফলে চাহিদা বাড়বে বাজারে। সহজ হবে মূলধন জোগাড়ও। এ দিনের ঘোষণা বিশেষ ভাবে খুশি করেছে আবাসন শিল্পকে। দেশে আবাসন নির্মাতাদের সংগঠন ক্রেডাইয়ের দাবি, সুদ চড়া থাকায় গত ন’মাস ধরেই ফ্ল্যাট-বাড়ির ক্রেতা পেতে হয়রান হতে হচ্ছিল। সেই ছবি কিছুটা বদলাবে। তবে তাদের দাবি, সুদ আরও কমা জরুরি। এ দিনের ঘোষণা অবশ্য খুশি করতে পারেনি গাড়ি শিল্পকে। সুদ এত অল্প কমায় হতাশা প্রকাশ করেছে তারা।
অবশ্য শুধু সুদ কমলে শিল্প তথা অর্থনীতি কতটা চাঙ্গা হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকেরই। যেমন, ইউকো ব্যাঙ্কের প্রাক্তন ইডি বি কে দত্তের কথায়, “সুদ কমায় শিল্পমহল অবশ্যই উজ্জীবিত হবে। কিন্তু সার্বিক ভাবে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে দ্রুত সংস্কার সেরে ফেলা জরুরি।”