কাগজে বাঁধানো সোনা

কে বলে সোনার চমক শুধু গয়নায়? গোল্ড বন্ড থেকে গোল্ড ইটিএফ— এই ধনতেরসে লক্ষ্মী আরাধনায় ‘কাগজে বাঁধানো সোনা’ও পরখ করার পরামর্শ দিলেন আদিল শেঠিকে বলে সোনার চমক শুধু গয়নায়? গোল্ড বন্ড থেকে গোল্ড ইটিএফ— এই ধনতেরসে লক্ষ্মী আরাধনায় ‘কাগজে বাঁধানো সোনা’ও পরখ করার পরামর্শ দিলেন আদিল শেঠি

Advertisement

আদিল শেঠি

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৮ ০৪:০৯
Share:

সামনেই ধনতেরস। লগ্নির আগ্রহ যত বাড়ছে, সোনা কেনার এই উৎসব তত হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ছে বাঙালির জীবনে। তার পরেই দীপাবলি আর বিয়ের ভরা মরসুম। আর বিয়ের সঙ্গে সোনা এবং সোনার গয়নার যোগাযোগ তো ঐতিহাসিক।

Advertisement

সোনা কেনার কথা এলে প্রথমেই মাথায় আসে গয়নার কথা। কিংবা ব্যাঙ্ক থেকে কেনা সোনার কয়েন বা বার। ছেলে-মেয়ের বিয়ে কিংবা বিপদ-আপদের কথা ভেবে সোনা কিনে রাখার রেওয়াজ তো আছেই। এই কৌশল যে ভুল তা বলব না। কারণ, দীর্ঘ মেয়াদে সোনা চট করে লগ্নিকারীকে ডোবায় না। ২০০০ সালে ১০ গ্রাম পাকা সোনার দাম যেখানে ৪ থেকে ৫ হাজারের ঘরে ঘোরাঘুরি করত, সেখানে তা এখন ৩২,০০০ টাকার আশেপাশে। কিন্তু তেমনই গয়নায় বা বারে সোনা কেনার অনেক অসুবিধাও আছে। তাই তার সঙ্গে সমান তালে টক্কর দিচ্ছে ‘কাগুজে সোনা’। তাদের সম্পর্কেও দু’চার কথা জেনে রাখলে মন্দ কি?

Advertisement

সোনার গুরুত্ব

সোনা সঞ্চয়ের প্রাচীন পদ্ধতি। বাজারের দোলাচল, মন্দা, মূল্যবৃদ্ধির ঝাপ্টা সামাল দেয় এই উজ্জ্বল ধাতু। সোনার চাহিদা তাই সাধারণত থাকেই। কিন্তু এই বছরের পরিস্থিতি একটু আলাদা। সম্প্রতি ডলারের নিরিখে টাকার দাম অনেকটা কমার প্রভাব পড়েছে সোনার দামের উপরে। তাই সোনার গয়নার চাহিদা এ বারের উৎসবের মরসুমে কিছুটা থমকাতে পারে। মুদ্রার বিনিময় হারের পাশাপাশি আরও বেশ কিছু কারণ দেশের বাজারে সোনার দামকে প্রভাবিত করে। এর মধ্যে রয়েছে অশোধিত তেলের দাম, মূল্যবৃদ্ধি, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রেপো রেট ইত্যাদি।

আমার অভিজ্ঞতা বলে, সোনার দাম ওঠা-নামা করতে পারে। বাজারে তার চাহিদাতেও জোয়ার-ভাটা থাকতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে সোনায় লগ্নি সাধারণত ডোবায় না। গত কয়েক বছরে সোনার দাম কী ভাবে বেড়েছে, তার সম্পর্কে একটা ধারণা সঙ্গের সারণিতে (দাঁড়িপাল্লায়) চোখ রাখলেই পাওয়া যাবে।

কিন্তু কালে কালে ধাতব সোনা কেনার ঝক্কি বাড়ছে। আমার পরামর্শ, সেই সমস্যা দূর করতে কাগজ বা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে সোনা কেনার কথা ভাবতে পারেন আপনি। ইতিমধ্যেই সোনা কেনার এই পদ্ধতি সাধারণ মানুষের কাছে কিছুটা জনপ্রিয়ও হয়েছে। আগামী দিনে এই জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে। কারণ, ধাতব সোনায় যে সুবিধা পাওয়া যায়, তার সবই মেলে কাগুজে সোনায়। পাশাপাশি মেলে সুরক্ষা-সহ বাড়তি কিছুও। কী রকম? তা নিয়েই এ বার খানিক আলোচনা করব।

কেন সোনা

সাধারণত দু’টি কারণে সোনা কেনেন সাধারণ মানুষ। প্রথমত, বিয়ের জন্য বা উপহার দেওয়ার প্রয়োজনে। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘ মেয়াদি সঞ্চয়ের লক্ষ্যে।

প্রথমেই ভেবে নিতে হবে, এই দু’টির মধ্যে কোন উদ্দেশ্যে আপনি সোনা কিনতে চান। উপহার হিসেবে গয়না কিনতে চাইলে আলাদা কথা (যদিও তারও বিকল্প আছে)। কিন্তু যদি লগ্নির মাধ্যম হিসেবে সোনায় টাকা ঢালার কথা ভাবেন, তা হলে কয়েকটি বিষয় ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। গত কয়েক বছরে সোনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রকল্প চালু হয়েছে। যেখানে ধাতব সোনা না কিনেও তা পকেটে আসে। কাগজের মাধ্যমে। প্রয়োজনের সময়ে সেই কাগজ ভাঙিয়ে আবার সত্যিকারের সোনা কেনা যেতে পারে।

সমস্যা কোথায়

ধরুন আপনি বাজারে সোনা কিনতে গেলেন। সে উপহার দেওয়ার জন্যই হোক বা জমানোর জন্য। সে ক্ষেত্রে তো ন্যূনতম একটা মাপের নীচে সোনা কেনাও যায় না! ধরা যাক তারই দাম পড়ে গেল হাজার পাঁচেক টাকা। তার উপরে গুনতে হবে মজুরি এবং জিএসটি। পাকা সোনার উপরেও জিএসটি বসবে। এর পরেই আপনার ঝক্কি শুরু।

ভাবতে শুরু করুন, কোথায় সেই সোনা রাখবেন। বাড়ির আলমারির লকারে, নাকি ব্যাঙ্কের লকারে? বাড়িতে রাখা যে মোটেই নিরাপদ নয়, তা নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। আর ব্যাঙ্কের লকারে রাখতে গেলে গুনতে হবে ভাড়া। যত বড় লকার তত বেশি ভাড়া। আর তার উপরে ফের ১৮% জিএসটি। এখানেই শেষ নয়। সেই সোনা ভাঙাতে গেলে আসবে দ্বিতীয় ধাক্কা। গয়না হোক বা সোনার বার, ভাঙাতে হবে আপনাকে সোনার দোকানেই। গয়নার ক্ষেত্রে প্রথমেই বাদ যাবে ১০-১২% মজুরি। খাত থাকলে দাম থেকে বাদ যাবে তা-ও। সুতরাং, বিক্রি করার সময়ে হয়তো দেখবেন, যে টাকা খরচ করে আপনাকে সোনা কিনতে হয়েছিল সেই হিসেবে রিটার্ন যথেষ্ট আসেনি। সোনা যদি বহু বছর আগে কিনে থাকেন তা হলে অবশ্য আলাদা কথা। না হলে ছ’সাত বছরের হিসেব দেখলে বোঝা যাবে, ধাতুটির দামে হেরফের কমই হয়েছে। বরং দাম মাঝে যতটা বেড়েছিল, কখনও সখনও সেখান থেকে তা নেমেছে। তাই এই সময়ের মধ্যে সোনা কিনে থাকলে এখন বিক্রি করে বড় লাভের সম্ভাবনা কম।

বিকল্প কী

সাধারণ লগ্নিকারীরা যাতে কম খরচে এবং নিরাপদে সোনায় লগ্নি করতে পারেন তার জন্য গত কয়েক বছরে বাজারে এসেছে নানা প্রকল্প। এর মধ্যে রয়েছে গোল্ড বন্ড, গোল্ড ফান্ড, গোল্ড ইটিএফ।

গোল্ড বন্ড: এই প্রকল্পে কেনা যাবে কাগুজে সোনা। ঋণপত্রের মাধ্যমে। যে পরিমাণ সোনা আপনি কিনতে চান, তা ধাতব সোনায় না কিনে একই অঙ্কের টাকা গুনে ঋণপত্র কেনা যাবে। এতে সুবিধা অনেক। ১) সোনা কিনে বাড়িতে রাখার ঝুঁকি বা লকারে রাখার খরচ নেই। ২) এই ধরনের ঋণপত্রে মোটামুটি ২.৫% সুদ মেলে। সোনার দাম বাড়লে বাড়তি মুনাফার পাশাপাশি এ তো লগ্নিকারীর কাছে উপরি পাওনা। ৩) নথিভুক্তির পরে এই বন্ড লেনদেন করা যায় শেয়ার বাজারেও।

গোল্ড বন্ডের সুদ অবশ্য করযোগ্য। যদি কোনও ব্যক্তির অন্য সূত্র থেকে আয় না থাকে, অথচ গোল্ড বন্ড থেকে মুনাফা কেন্দ্রের আয়কর ছাড়ের সীমার চেয়ে বেশি হয়, তা হলে তাঁকে নিয়ম মেনে কর জমা দিতে হবে। তবে ব্যক্তি লগ্নিকারীর ক্ষেত্রে বন্ডের মেয়াদ শেষে পাওয়া মুনাফায় কোনও মূলধনী লাভকর (ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স) নেই। মেয়াদের আগে বন্ড বেচার সময়ে সোনার দাম বাড়লে অবশ্য দিতে হবে মূলধনী লাভকর।

গোল্ড ফান্ড: যে সমস্ত মিউচুয়াল ফান্ড মূলত সোনায় লগ্নি করে, তারাই গোল্ড ফান্ড নামে পরিচিত। এর সুবিধা হল, ১) মিউচুয়াল ফান্ডের মতোই খুব কম টাকা দিয়ে লগ্নি শুরু করা যায়। এমনকি, সেই অঙ্ক মাসে ৫০০ টাকাও হতে পারে। অর্থাৎ, পাকা বা গয়না সোনার মতো এক সঙ্গে বড় টাকা ঢালার সমস্যা নেই। ২) সহজেই কেনা-বেচা করা যায়। ৩) নির্দিষ্ট সময়ের আগে বিক্রি করলে কিছু ক্ষেত্রে বাড়তি চার্জ লাগলেও, পরে বিক্রি করলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাড়তি চার্জ গুনতে হয় না।

গোল্ড ইটিএফ: কাগুজে সোনায় লগ্নির অন্যতম ভাল উপায়। বিনিয়োগ করা টাকা সরাসরি খাটানো হয় সোনায়। একটি গোল্ড ইটিএফে যে তহবিল সংগৃহীত হয়, তা দিয়ে সংশ্লিষ্ট ফান্ড সোনা কেনে। সোনার দামের ওঠাপড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফান্ডের ইউনিটের দর বাড়ে-কমে। গোল্ড ইটিএফ কিনতে ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট লাগে।

মনে রাখতে হবে, গোল্ড ইটিএফ এবং গোল্ড ফান্ড এক নয়। বিভিন্ন ফান্ড সংস্থা বাজারে গোল্ড ফান্ড ছাড়ে, যারা সোনা ও তার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে লগ্নি করে। এরই মধ্যে যারা সরাসরি সোনায় টাকা খাটায় এবং যার ইউনিট স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন হয়, তারাই হল গোল্ড ইটিএফ।

দোকান থেকে সোনা কেনার সময় তার খাত, দোকানের বিশ্বাসযোগ্যতা, বাজারদর থেকে কতটা বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে তা বুঝে নিন। কাগুজে সোনায় সেই চাপ নেই। বরং দরের পাশাপাশি বাড়তি হিসেবে মিলবে সুদ, সুরক্ষা। সোনায় সোহাগা।

লেখক ব্যাঙ্কবাজার ডট কমের সিইও (মতামত ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement