বাজার বিরাট। সম্ভাবনা বিপুল। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় বাণিজ্য বন্দি অবিশ্বাসের কাঁটাতারে।
মান্ধাতা আমলের পরিবহণ পরিকাঠামো, পণ্য স্থানান্তরের বিপুল খরচ, একের পর এক বহু পাক্ষিক চুক্তি মুখ থুবড়ে পড়া— দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির পারস্পরিক বাণিজ্য ডানা মেলতে না পারার পিছনে এই সমস্ত কারণ তো আছেই। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, সব থেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস আর তাকে কেন্দ্র করে রাজনীতির দড়ি টানাটানি।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাণিজ্য সম্ভাবনা নিয়ে দুবাইয়ে এক আলোচনাচক্রের আয়োজন করেছিল অ্যারিজ়োনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ডোনাল্ড ডব্লু রেনল্ডস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বিজনেস জার্নালিজ়ম এবং মার্কিন বিদেশ দফতর। সেখানে বিশ্ব ব্যাঙ্কের সমীক্ষা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপুঞ্জের সামাজিক উন্নয়ন দফতরের ডিরেক্টর (এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল) নাগেশ কুমার বলেন, ‘‘দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির মধ্যে বছরে মোট ৬,৭০০ কোটি ডলারের (৪.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা) বাণিজ্য হওয়ার মশলা মজুত। অথচ হয় মোটে ২,৩০০ কোটি ডলার (১.৬৩ লক্ষ কোটি টাকা)।’’ মার যায় অন্তত ৪,৪০০ কোটি ডলারের (৩.১২ লক্ষ কোটি টাকা) বাণিজ্য। যার কিছুটা হলেও এই অঞ্চলের বহু মানুষকে অনেক দ্রুত দারিদ্র সীমার নীচ থেকে তুলে আনা যেত বলে তাঁর দাবি।
দক্ষিণ এশীয় বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ পশ রাজ পান্ডেরও দাবি, ‘‘বিভিন্ন পরিংসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে, এই অঞ্চলের দেশগুলির নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ তাদের মোট বাণিজ্যের অঙ্কের তুলনায় নগণ্য।’’
মাথাব্যথা
• দক্ষিণ এশিয়ায় বছরে বাণিজ্য সম্ভাবনা ৬,৭০০ কোটি ডলারের। সেখানে হয় ২,৩০০ কোটির। ৪,৪০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য সম্ভাবনা জলে।
• বিশ্বের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ দরিদ্রের বাস। অথচ বাণিজ্যে গতি এনে আরও দ্রুত দারিদ্র দূরীকরণ আটকে রাজনীতির জাঁতাকলেই।
• দক্ষিণ এশীয় দেশগুলি মোট যত বাণিজ্য করে, তাদের নিজেদের মধ্যে পণ্য আদান-প্রদানও তার তুলনায় একেবারেই কম।
• যেটুকু হয়, তাতেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে রফতানিতে এক তরফা ভাবে পাল্লা ভারি ভারতের। ফলে দরজা খুলতে আরও দ্বিধা অন্য দেশগুলির।
ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের মধ্যে বাণিজ্য সম্ভাবনা পুরোদস্তুর ডানা না মেলার পিছনে অর্থনীতির যুক্তি বিস্তর। পণ্য পরিবহণের চড়া খরচ থেকে শুরু করে দুর্বল পরিকাঠামো— দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যে দেওয়াল যথেষ্ট। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনীতির তেতো লড়াই আর দীর্ঘ দিন বাসা বেঁধে থাকা পারস্পরিক অবিশ্বাস না থাকলে, ওই সব সমস্যার সমাধান খোঁজা সহজ হত।
কারণ
• ২০০৮ সালের বিশ্ব জোড়া মন্দার পরে বাণিজ্যে দেওয়াল উঠছে দুনিয়ার প্রায় সব প্রান্তেই। ব্যতিক্রম নয় দক্ষিণ এশিয়াও।
• পরিবহণ পরিকাঠামো দুর্বল।
• পণ্য আদান-প্রদানের খরচ অসম্ভব চড়া। যেমন, এই অঞ্চল থেকে ইউরোপে পণ্য রফতানির খরচ অনেক ক্ষেত্রে পড়শি মুলুকে পণ্য পাঠানোর প্রায় সমান। আমেরিকায় কম!
• দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (সাফটা) পুরোদস্তুর কার্যকর হয়নি কখনও। ফলে শুল্কের দেওয়ালের পাশাপাশি বাধা তার উপরে চাপা বাড়তি কর (প্যারা ট্যারিফ) এবং অন্যান্য বিধিনিষেধও।
• তবে সব থেকে বড় কারণ দেশগুলির মধ্যে রাজনৈতিক তিক্ততা এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস।
যেমন, ভারত-পাকিস্তানের তিক্ততা, পাকিস্তান-আফগানিস্তানের শীতল সম্পর্ক, এই তল্লাটে বাণিজ্যে ভারতের একচেটিয়া আধিপত্য নিয়ে নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার আপত্তির মতো নানা কারণ তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুমার, পান্ডেরা বলছিলেন, সাফটা কার্যকর হয়নি। সার্ক নখদন্তহীন। বিমস্টেক, অ্যাপটার মতো একের পর এক বহু পাক্ষিক চুক্তিও রয়ে গিয়েছে খাতায়-কলমে। ফলে সেই আতান্তরেই পড়ে বাণিজ্য।
সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ স্কুল অব পাবলিক পলিসির অধ্যাপক জেমস ক্র্যাবট্রির মতে, ভারত-সহ এই দেশগুলির মূল সমস্যা আর্থিক অসাম্য, দুর্নীতি এবং সেই দু’য়ের সূত্রে বহু মানুষের চরম দারিদ্র। বিশেষজ্ঞদের মতে, সেই অসুখের অন্যতম দাওয়াই হতে পারত নিজেদের মধ্যে আরও বেশি মুক্ত বাণিজ্য। মিলেমিশে পণ্য উৎপাদনের বড় অঞ্চল হয়ে ওঠার চেষ্টা করলেও বাড়ত শান্তি বজায় থাকার সম্ভাবনা। কারণ, সে ক্ষেত্রে একের উপরে আক্রমণ এলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে অন্যদেরও। এমনকি শুধু একে-অন্যের বিদ্যুতের গ্রিড ব্যবহার করলেই বছরে ৯০০ থেকে ২,০০০ কোটি ডলার বাঁচাতে পারে এই দেশগুলি। তাই এই সমস্ত সুযোগ নেওয়ার জন্য বাণিজ্যে বাধা কাটাতে সবার আগে রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপরেই জোর দিচ্ছেন তাঁরা।