শিল্পের দেখা নেই। চাকরির বাজারে ঘোর মন্দা। ফলে চাহিদা তলানিতে। এ সব জেনেও যাঁরা এক পা এগিয়ে আসছেন, সিন্ডিকেটের চোখরাঙানি দেখে পিছু হটছেন চার পা!
সব মিলিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহু সাধের ‘থিম সিটি’ প্রকল্প মাঠে মারা যাওয়ার জোগাড়। নির্মাণসংস্থারা ভেবে পাচ্ছে না, কোন ভরসায় সেখানে লগ্নি করা যায়। অবস্থা এমনই যে, কাঙ্খিত সাড়া না-পেয়ে রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে টেন্ডার জমার সময়সীমা বাড়াতে বাধ্য হয়েছে।
ডাবগ্রাম, বোলপুর, আসানসোল, কল্যাণী, ডুমুরজলা ও বারুইপুর— ছ’টি জায়গায় ‘থিম’ শহর তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। কলকাতা থেকে দূরত্ব বা মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মতো নানা আর্থ-সামাজিক মাপকাঠির ভিত্তিতে শিল্পমহলের একাংশ অবশ্য গোড়াতেই প্রকল্পগুলির সাফল্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। তবে সে সব আশঙ্কা ছাপিয়ে এই মুহূর্তে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ইমারতি সিন্ডিকেটের হুজ্জতি। ‘‘খাস কলকাতার বুকেই সিন্ডিকেটের রোয়াব দেখার মতো। পুলিশ, প্রশাসন, কারও তোয়াক্কা করে না! বোঝাই যাচ্ছে, জেলায় কী হাল।’’— পর্যবেক্ষণ এক নির্মাণসংস্থা কর্ণধারের।
অতএব, ওঁরাও কার্যত হাল ছেড়েছেন। আগ বাড়িয়ে সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়তে চাইছেন না। কিন্তু থিম-শহরে ওঁদের ঘাড়ে সিন্ডিকেটের থাবা পড়বে কী ভাবে?
শিল্পমহলের ব্যাখ্যা: খেলা বা শিল্পের মতো ‘থিম’কেন্দ্রিক পরিকাঠামোর সঙ্গে ওখানে বিস্তর আবাসন তৈরিরও কথা। রাজ্যের শর্ত অনুযায়ী, মোট আবাসনের ২৫% হতে হবে নিম্নবিত্তের জন্য, যে সব ফ্ল্যাটের দাম তিন লক্ষ পেরোবে না। এখানেই নির্মাতারা ভয় পাচ্ছেন। তাঁদের যুক্তি, কম দামি আবাসনে লাভের অঙ্ক কম। সেটুকুতেও সিন্ডিকেট ভাগ বসালে ব্যবসা লাটে উঠবে। এক ডেভেলপারের কথায়, ‘‘মধ্যবিত্তের হাউজিং বানিয়েই স্কোয়্যার ফুটে বড়জোর দু’শো টাকা লাভ থাকে। যা পরিস্থিতি, লাভের প্রায় ৭০% সিন্ডিকেটের পকেটে গুঁজতে হবে। তার চেয়ে না বানানোই ভাল।’’
এ হেন আতঙ্কের ছায়ায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে ‘থিম সিটির ভবিষ্যৎ। অথচ আপাতদৃষ্টিতে সেখানে পুঁজি টানার রসদ অনেক। যেমন প্রকল্পের দায়িত্বে রাজ্য সরকারি সংস্থা হিডকো, যার ঝাঁ চকচকে ওয়েবসাইটে প্রতি প্রকল্পের বিস্তারিত বিবরণ ও তথ্যাদি মজুত। আরও বড় কথা, বাংলায় লগ্নি আকর্ষণে অন্যতম প্রধান বাধা যে জমি, সেই সমস্যাও থিম সিটি’তে নেই। এখানে বিনিয়োগকারী সরাসরি রাজ্যের থেকে জমি নেবে, লিজ মারফত। প্রতি শহরের জন্য বরাদ্দ এক লপ্তে অন্তত ৫০ একর। ডাবগ্রাম ও বারুইপুরে ৮০ একরের উপর। সর্বাধিক বোলপুরে— ১৩৫ একর। উপরন্তু জমির দাম মেটানোয় সুবিধা। নির্মাণসংস্থা সংগঠন ‘ক্রেডাই’-এর পরামর্শ মেনে সরকার ধাপে ধাপে দাম নিতে রাজি হয়েছে। সেই সঙ্গে ‘ফ্লোর এরিয়া রেশিও’তেও ছাড়। অর্থাৎ, কম জমিতে বেশি বর্গফুট নির্মাণ করে মুনাফা বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ বিলক্ষণ।
‘‘কিন্তু মুনাফার গুড় যদি সিন্ডিকেটেই খেয়ে যায়?’’— প্রশ্ন তুলছেন নির্মাতাদের বড় অংশ। ওঁদের বক্তব্য, সরকারি হোক বা বেসরকারি— রাজ্য জুড়ে নির্মীয়মাণ বহু প্রকল্প এখন সিন্ডিকেটের গ্র্রাসে। এমনকী পোস্তায় উড়ালপুল ভেঙে পড়ার পিছনেও সিন্ডিকেটের জোগানো নিচুমানের কাঁচামালের ভূমিকা ছিল কিনা, সেই সন্দেহ পুলিশের মনে দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় থিম সিটি ব্যতিক্রম হবে, এমন ভরসা তাঁরা পাচ্ছেন না।
অন্য দিকে সরকারের তরফেও এমন কোনও বাতাবরণ সৃষ্টির তাগিদ নজরে পড়ছে না, যাতে ওঁরা আশ্বস্ত হতে পারেন। টেন্ডারের বাক্সে তারই প্রতিফলন পড়ছে বলে শিল্পমহলের ধারণা। গত বছরের জুনে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে থিম সিটি প্রকল্প অনুমোদিত হওয়ার পরে পুরো বিষয়টির ভার দেওয়া হয়েছে নগরোন্নয়ন দফতরকে। দফতরের ‘নোডাল এজেন্সি’ হিসেবে এসেছে হিডকো। টেন্ডার থেকে শুরু করে নির্মাণে নজরদারি— সব হিডকো’র দায়িত্ব। টেন্ডারের ভিত্তিতে প্রাথমিক বাছাই সংস্থাদের কাছে অনলাইনে জমি নিলাম হবে। অর্থাৎ, ই-অকশন। ই-অকশন পরিচালনার জন্য রাজ্য বেছে নিয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্থা এমএসটিসি-কে।
ঘটনা হল, থিম সিটি ঘিরে সরকারের যা প্রত্যাশা, এ পর্যন্ত তার সঙ্গে প্রাপ্তিতে বেশ ফারাক। অন্তত টেন্ডার-পর্ব তা-ই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ২০১৫-র সেপ্টেম্বরের মধ্যে হিডকো টেন্ডার-প্রক্রিয়ায় নেমে পড়েছিল। নভেম্বর থেকে ধাপে ধাপে হিডকো-র ওয়েবসাইটে দরপত্র ‘আপলোড’ হয়েছে। এবং টেন্ডার জমার সময়সীমা বেঁধে দিয়েও পরে বাড়াতে হয়েছে। বারুইপুর ও কল্যাণীতে সময়সীমা ছিল যথাক্রমে ২০১৫-র নভেম্বর ও ডিসেম্বর। দু’টিই বেড়ে হয়েছে ২০১৬-র জুন। আসানসোল, ডুমুরজলা, বোলপুর ও ডাবগ্রামে তা ২০১৬-র ফেব্রুয়ারি থেকে পিছিয়ে এসেছে এপ্রিলে। নির্মাণশিল্পের বড় অংশের পর্যবেক্ষণ, এত সুযোগ-সুবিধা দিয়েও সরকার যে লগ্নি টানতে তেমন সফল নয়, টেন্ডার জমার তারিখ বাড়ানো তারই প্রমাণ। হিডকো-র চেয়ারম্যান দেবাশিস সেন অবশ্য এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
সিন্ডিকেট-রাজ তো আছেই। পাশাপাশি বিনিয়োগের বাধা হিসেবে উঠে আসছে কলকাতা থেকে দূরত্বের প্রশ্ন। নির্মাণ শিল্পমহলের আক্ষেপ, পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের সিংহভাগ কলকাতাকেন্দ্রিক। আর সেই সূত্রেই সংশ্লিষ্ট ছ’টি শহরে ক্রেতা-চাহিদার বহর সম্পর্কে সম্ভাব্য লগ্নিকারীরা সন্দিহান।
এত সংশয় কাটিয়ে থিম সিটি কি বাস্তবের মটিতে পা রাখতে পারবে?
আঁচ পাওয়ার জন্য চলতি মাসের ই-নিলামের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সকলে।