জল্পনা শোনা যাচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। প্রথমে তাতে সিলমোহর দিলেন খোদ বিমান পরিবহণ প্রতিমন্ত্রী জয়ন্ত সিন্হা। জানালেন, ওই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হাতে নিতে আগ্রহ দেখিয়েছে টাটারা। সংস্থাটির ‘জন্ম’ই যাদের আঁতুড়ে। দৌড়ে সামিল সস্তার বিমান পরিষেবা সংস্থা ইন্ডিগো-ও। তবে পরে গভীর রাতে আসা সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের খবর অনুযায়ী, মন্ত্রী কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে বলেন, এ নিয়ে এখনও লিখিত ভাবে আগ্রহপত্র পাঠায়নি টাটারা। তিনি তাদের আগ্রহের ইঙ্গিত পেয়েছেন কর্ণধার এন চন্দ্রশেখরনের কথা থেকে।
সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সিন্হা প্রথমে বলেছিলেন, ‘‘এয়ার ইন্ডিয়ার জন্য ইন্ডিগো এবং টাটা গোষ্ঠী— উভয়েই আগ্রহ দেখিয়েছে।’’ সংস্থার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবা একসঙ্গে বিক্রি করা হবে বলেও জানান। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহলের অনেকের মতে, প্রথমে টাটাদের আগ্রহের কথা বলেও পরে মন্ত্রীর কিছুটা রক্ষণাত্মক হয়ে যাওয়া এয়ার ইন্ডিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা বাড়াল আরও।
কারণ, ২৮ জুন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার আর্থিক বিষয়ক কমিটি এয়ার ইন্ডিয়া বিলগ্নিকরণে নীতিগত ভাবে সায় দেওয়ার পর থেকেই আগ্রহী ক্রেতা হিসেবে ভেসে উঠেছে বিভিন্ন সংস্থার নাম। এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ান পরিষেবা কিনতে আগ্রহ দেখিয়ে বিমান পরিবহণ মন্ত্রককে আগেই চিঠি দিয়েছে ইন্ডিগো। বিমানবন্দরের মাটিতে দেওয়া পরিষেবা হাতে নিতে আগ্রহীদের মধ্যে শোনা গিয়েছে বার্ড গোষ্ঠী, সেলেবি-র মতো সংস্থার নাম। টাটাদের নামও গত কয়েক মাসে বারবার জল্পনায় ঘুরপাক খেয়েছে এয়ার ইন্ডিয়া নিতে আগ্রহী হিসেবেই।
সংশ্লিষ্ট মহলের অনেকে বলছেন, ঘাড়ে ৫০ হাজার কোটি টাকার দেনা চেপে থাকলেও, এয়ার ইন্ডিয়ার মতো পরিচিত ব্র্যান্ড হাতে নিতে বিভিন্ন সংস্থা যে আগ্রহ দেখাবে, তা নতুন কথা নয়। অন্য দিকে, এয়ার এশিয়া এবং বিস্তারা-র দৌলতে টাটারাও গত কয়েক বছরে ফিরে এসেছে এ দেশের বিমান পরিবহণের আকাশে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এয়ার ইন্ডিয়া কিনতে টাটারা সত্যিই আগ্রহ প্রকাশ করলে, তা হবে বিশেষ ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
টাটারাই ভারতে বিমান পরিষেবা চালুর ভগীরথ। এয়ার ইন্ডিয়া তৈরিও তাদের হাতে। ১৯৩২ সালে এ দেশের প্রথম বিমান পরিবহণ সংস্থা টাটা এয়ারলাইন্স চালু করেন টাটা গোষ্ঠীর তৎকালীন চেয়ারম্যান জে আর ডি টাটা। ১৯৩৮ সালে নাম বদলে যার নতুন পরিচয় হয় টাটা এয়ার সার্ভিসেস। ১৯৪৬ সালে শেয়ার বাজারে নথিভুক্তির সময়ে নাম ফের বদলে হয় এয়ার ইন্ডিয়া। ১৯৪৮ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার ৪৯% শেয়ার কিনে নেয় কেন্দ্র। ১৯৫৩ সালে জাতীয়করণ হয় এয়ার ইন্ডিয়ার।
জে আর ডি-র মতোই ‘বিমান-প্রীতি’ প্রায় কিংবদন্তি তাঁর উত্তরসূরি তথা টাটা গোষ্ঠীর এমেরিটাস চেয়ারম্যান রতন টাটার। এ দেশের প্রথম পাইলটের লাইসেন্স যেমন জেআরডি-র পকেটে, তেমনই নিজস্ব ফ্যালকন জেট মাঝে মধ্যে নিজেই উড়িয়েছেন রতন টাটা। এক সময় জে আর ডি-কে নিয়ে রীতিমতো রসিকতা ছিল যে, এয়ার ইন্ডিয়াকে তিনি দেখেন প্রায় অপত্য স্নেহে।
শোনা যায়, এয়ার ইন্ডিয়ার নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হওয়ায় যথেষ্ট দুঃখ পেয়েছিলেন জে আর ডি টাটা। একই রকম আক্ষেপ ঝরে পড়েছিল রতন টাটার গলাতেও। তিনি আক্ষেপ করেছিলেন, নব্বইয়ের দশকে এ দেশে একটি ঘরোয়া বিমান পরিবহণ সংস্থা চালু করতে আগ্রহী ছিলেন তাঁরা। কিন্তু রাজনৈতিক বাধায় সেই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি। ফলে সব মিলিয়ে, প্রায় ছ’দশক এ দেশে বিমানের লেজে কার্যত নাম ছিল না টাটাদের।
কিন্তু ২০১৩ সালে মালয়েশীয় সংস্থা এয়ার এশিয়ার হাত ধরে ফের বিমান পরিবহণের ব্যবসায় ফেরে টাটা গোষ্ঠী। চালু করে সস্তার বিমান পরিষেবা। তবে সেখানে বেশি অংশীদারি এয়ার এশিয়ার পকেটে। এর পরে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পূর্ণাঙ্গ পরিষেবার সংস্থা বিস্তারা চালু করেছে টাটারা। সেখানে সিংহভাগ অংশীদারি তাদের পকেটে।
কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহলের অনেকেই বলছেন, এয়ার ইন্ডিয়ার প্রতি ‘আলাদা টান’ রয়ে গিয়েছে টাটাদের। তাই এয়ার ইন্ডিয়া কিনতে তারা শেষমেশ লিখিত ভাবে আগ্রহ দেখালে, তা হবে যথেষ্ট তাৎপর্যের। প্রথমে টাটাদের তরফে আগ্রহের ইঙ্গিতের কথা বলেও, পরে মন্ত্রী যে ভাবে এখনও তা লিখিত ভাবে না-আসার কথা বলেছেন, তাতে সেই ধোঁয়াশা আরও গাঢ় হওয়ার সম্ভাবনা।