প্যাচপেচে গরম একই রকম আছে। উবে যায়নি ঠেলাঠেলি করে কেনাও। কিন্তু চৈত্র সেলে দোকান আর ফুটপাতে সেই ঠাসা ভিড় যেন প্রতি বছর একটু করে পাতলা হচ্ছে ক্রমশ। এই সময়ে ছোট-মাঝারি দোকানের যে বিক্রেতা বছর কয়েক আগেও মুখে খাবার তোলার সময় পেতেন না, তিনিও বলছেন, ‘‘লক্ষণ ভাল নয়। সেই পুরনো দিন যেন পিছনে চলে যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি।’’ নেট-বাজার হয়তো সবে থাবা বসাতে শুরু করেছে। এখনও প্রবল প্রতিপক্ষ নয়। কিন্তু চোখের সামনে ক্রেতা ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে শপিং মল। যাদের পুঁজি, বিজ্ঞাপন ও বিপণন কৌশলের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার রাস্তা এখনও সে ভাবে খুঁজে পাননি ছোট দোকানিরা।
গড়িয়াহাট বা হাতিবাগান মোড়ে এ বারও চৈত্র সেলের ভিড় যথেষ্ট। কিন্তু যাঁরা বহু বছর এ তল্লাটে দোকান চালাচ্ছেন, তাঁদের দাবি, ভিড় আগের থেকে অনেক পাতলা। যার ছায়া নগদের বাক্সে। অনেকের আশঙ্কা, এ ভাবে আর কত দিন? ভবিষ্যতে দোকান আদৌ টিকে থাকবে তো?
গড়িয়াহাটে ৪২ বছরের পুরনো এক দোকানের কর্মী এস চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘ক’বছর ধরেই বিক্রি কমছে। কিন্তু এ বার উদ্বেগ বেড়েছে অনেকখানি।’’ এ জন্য নেট বাজার, জিএসটি, শপিং মলের প্রভাবকে দায়ী করছেন তিনি। ই-কমার্স সংস্থা অ্যামাজনের অবশ্য দাবি, কলকাতা তাদের গুরুত্বপূর্ণ বাজার। আর উৎসব -পার্বণে ছাড় তারা দিয়েই থাকে।
তবে এখন অধিকাংশ ছোট দোকানির মাথাব্যথা বেশি শপিং মল নিয়ে। হাতিবাগানে প্রায় ৫৩ বছর ব্যবসা করা প্রদীপ কুমার সাহা যেমন বলছেন, ‘‘নেট-বাজার বিক্রি কিছুটা কেড়েছে। কিন্তু মলগুলি ব্যবসা খেয়ে নিচ্ছে আরও বেশি। তাদের মজুত বেশি। ছাড়েও চমক। সেখানে প্রতি মাসে জিএসটি দিতে গিয়ে আমাদের ঘরে নগদের আকাল। জিনিস তুলতেই তো পারছি না। সব কর্মীকে ছাড়িয়ে দিয়েছি।’’ তিনি বলেন, এ সময়ে দিনে অন্তত ১৬ হাজার টাকার ব্যবসা হত। এখন বিক্রি তার ধারেকাছেও যায় না। এই মতের শরিক বেশির ভাগ বিক্রেতাই। এক দোকানির আক্ষেপ, ‘‘ঠান্ডায় ঘুরে একসঙ্গে এত রকম জিনিস পেলে, কে আর তেতেপুড়ে ফুটপাতে ভিড় ঠেলবেন? ওদের মতো অত পুঁজি কোথায় পাব?’’
অসম যুদ্ধ
• শপিং মলের পুঁজি বেশি। বিপুল মজুতও। তা-ও আবার এক ছাদের তলায়। হাঁসফাঁস ছোট দোকান
• মল আলো ঝলমলে। সঙ্গে এসির আরাম। তার টানে ফুটপাত এড়াচ্ছেন অনেকেই ক্রেতা টানতে নাগাড়ে বিজ্ঞাপন। টিভি, কাগজ, নেট সর্বত্র। পোক্ত বিপণন কৌশলে বার্তা ক্রেতার মোবাইলেও। জুঝতে নাভিশ্বাস ছোট দোকানির
• বছরভর হরেক ছাড় মল আর নেট-বাজারে। আলাদা করে চৈত্রের টান তাই কমছে ক্রমশ
উপরি বোঝা
• জিএসটি ধাক্কায় ব্যবসা চালাতে নগদের অভাব
• নোটবন্দির পরে খরচে ঝোঁকও কমেছে অনেক ক্রেতার
• অনেক ছোট বিক্রেতাই দুষ্টচক্রের খপ্পরে। বিক্রি কম, চড়া কর। তাই হাতে কম নগদও। সুযোগ কম মাল তোলার। আক্ষেপ, কে আর পা দেবেন কম জিনিসের দোকানে?
মন্দা বাজারের জন্য জিএসটির সঙ্গে নোটবন্দিকেও কাঠগ়়ড়ায় তুলছেন একাংশ। শাড়ির দোকানি পরিতোষ দে যেমন বলছেন, ‘‘নোটবন্দির পর থেকে খরচের ইচ্ছেটাই যেন উধাও হয়ে গিয়েছে অনেকের মধ্যে।’’
গড়িয়াহাটের বহু পুরনো এক দোকানের কর্ণধার অনুপ কুমার সাহার আবার চিন্তা, ‘‘শাড়ির বাজার সবচেয়ে বেশি মার খেয়েছে। কারণ তা পরার ঝোঁক কমছে। অথচ বাড়ছে দোকান।’’ তাঁর আক্ষেপ, ‘‘বিক্রি পড়ছে। কিন্তু খরচ বাড়ছে।’’ তাঁর দাবি, যে সব দোকান ব্যবসা অক্ষত থাকার দাবি করছে, তারা ব্যতিক্রমী।
অনুপবাবুর দাবি, বিক্রি ফিকে হতে শুরু করেছে ২০১০ থেকেই। এ বার অবস্থা শোচনীয়। এমন চললে ১০-১৫ বছরে মধ্যে ব্যবসার ঝাঁপ বন্ধের আশঙ্কা করছেন তিনি।