—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
কোভিডকালের গভীর ক্ষত এখনও পুরোপুরি সারেনি বহু বিক্রেতার। দীর্ঘ দিন ধরে মানুষ ঘরবন্দি থাকায় তখন ব্যবসা যে লোকসানের খাদে পড়েছিল, সেখান থেকে তাকে টেনে তুলতে গত বছরের পরে এ বারও পুজোর বিক্রি ভরসা ছিল তাঁদের। এমনকি সেই কারণেই চড়া মূল্যবৃদ্ধিতে কেনাকাটার ক্ষমতা কমে যাওয়া বা হারানো সাধারণ রোজগেরেদের জন্য অনেকে কম দামি জিনিস রাখার কৌশল নেন। তবু সঙ্কট এড়ানো যায়নি, দাবি ব্যবসায়ী মহলের। একাংশ বলছেন, বহু মানুষ আর উৎসবে ফিরতে চাইছেন না। তাঁরা এ ভাবেই আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদ করছেন। কেউ কেউ অবশ্য আসতে পারছেন না মিটিং-মিছিলের জন্য বিভিন্ন রাস্তা আটকে থাকায়। এর পাশাপাশি আঙুল উঠছে, খাদ্য, জ্বালানি-সহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্যের চড়া দামে আমজনতার বেড়ে যাওয়া খরচের দিকেও। ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীই একমত, পুজোর অর্থনীতি এ বছর বড়সড় চোট খাওয়ার মুখে। গত দু’সপ্তাহ বিক্রিবাটা কিছুটা বাড়লেও, তা সার্বিক ক্ষতি পূরণ করার মতো যথেষ্ট নয়।
“কোভিডের ক্ষতি ভরার আগেই এই ধাক্কা আমাদের বেসামাল করেছে। গত বছরের থেকে বিক্রি কমেছে ২৫%”, মন্তব্য নিউ মার্কেট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দেবু ভট্টাচার্যের। তিনি জানান, ভিড় যেটুকু হচ্ছে, সেটা ফুটপাতে ২০০ টাকার গেঞ্জি-চুড়িদার, ৫০-১০০ টাকার কানের দুল আর জুতো কেনার জন্য। সেখানকার স্থায়ী দোকানগুলির ক্রেতাদের বড় অংশ মুখ ফিরিয়েছেন। এর বড় কারণ আর জি কর। হাতিবাগান বাজার মার্চেন্টস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সচিব অমল কুমার দাসের দাবি, ‘‘অগস্ট-সেপ্টেম্বরে মানুষ এই চত্বরে আসতে পারেননি মূলত আর জি কর নিয়ে জমায়েতের জন্য। তার উপর আছে অনলাইনের বিক্রির চাপ। নেট-এ কম দামে জিনিস কিনছেন অনেকে। শনিবার পর্যন্ত আমাদের বিক্রি কম হয়েছে ৪০%। গত এক সপ্তাহ কিছুটা বেড়েছে কম দামি জামাকাপড়ের বিক্রি। তবে তাতে গত বছরের ধারেকাছেও পৌঁছনো যাবে না।’’ বারাসতের একটি শপিং মলের বিক্রেতাদের একাংশের দাবি, আগের বছরের থেকে পোশাক আর জুতোর দাম কমিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু লাভ হয়নি তেমন।
মার খাচ্ছে বৈদ্যুতিন পণ্যও। পূর্ব ভারতে এগুলির অন্যতম বড় বিক্রেতা সংস্থার কর্ণধার মনীশ বৈদ জানান, বিক্রি এখনও গত বারের থেকে প্রায় ২০% কম। ঝিমিয়ে মূলত টিভি, ফ্রিজ়, মাইক্রোওয়েভ, এসি-র বাজার। মোবাইল এই দলে নেই। অন্য দিকে, জুতো তৈরির বাঙালি সংস্থার এমডি সৌমি বণিক নাগেরও বার্তা, “মূলত কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বিক্রি কমেছে প্রায় ৫%। এ জন্য দায়ী দেরিতে আসা বৃষ্টিও।’’ তবে সূত্রের খবর, জুতো সংস্থাটি পুজোয় এখনও পর্যন্ত কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় ২০ শতাংশের বেশি এবং সামগ্রিক ভাবে ১৫% কম ব্যবসা করেছে।
ওয়েস্ট বেঙ্গল গারমেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি বিজয় কারিওয়ালাকের মন্তব্য, “সার্বিক পোশাক বিক্রি ১০-১২ শতাংশ কমেছে। এখন অনেকে জুন-জুলাইয়ে ‘সেল’-এ জামাকাপড় কেনে। সেটাও সমস্যা।’’ ব্যবসায়ীদের সংগঠন কনফেডারেশন অব ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুশীল পোদ্দার অবশ্য বলছেন, “সব ক্ষেত্র মিলিয়ে পুজোর কেনাকাটা ২০-২৫ শতাংশ কম। কিছু ক্ষেত্রে
তা ৩০%।”
২০১৯-এ ব্রিটিশ কাউন্সিলের দুর্গাপুজোর অর্থনীতি সংক্রান্ত সমীক্ষা জানিয়েছিল এর বহর প্রায় ৩২,৭০০ কোটি টাকার। যা রাজ্যের মোট জিডিপির ২.৫৮%। সবচেয়ে বেশি বিকিয়েছে জামাকাপড়-জুতোর মতো পণ্য। তার পরে আছে রেস্তোরাঁয় খাওয়াদাওয়া। অর্থনীতিবিদ অজিতাভ রায়চৌধুরীর মতে, ২০১৯-এর অঙ্কের উপর ৬% মূল্যবৃদ্ধি আর ২০% কম বিক্রি ধরে হিসাব কষলে এ বারের অঙ্ক ৫০,০০০ কোটি টাকার আশেপাশে থাকবে। চাহিদায় ভাটা না দেখা গেলে হতে পারত ৬৫,০০০ কোটির বেশি। তিনি বলেন, “আর জি কর কাণ্ড তো রয়েইছে, তার উপর বিলম্বিত বর্ষা, গ্রামীণ বাজারের চাহিদা হ্রাস, বন্যার মতো একাধিক কারণে বাজারের এই হাল।’’ অনেকেরই প্রশ্ন, কোভিড থেকে ওঠার দু’বছরের মধ্যে এই ধাক্কা সইতে পারবেন তো ছোট ব্যবসায়ীরা? উত্তর দেবে সময়।