রাজস্থানে ভিলওয়াড়া সুটিংসের ইটিপি।
বানতলার চর্মশিল্প আর বালোত্রার বস্ত্র।
দূষণের ভূতকে বোতলবন্দি করা অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল দু’জায়গাতেই। ফারাক হল, রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর থেকে প্রায় ৪৩০ কিলোমিটার দূরের বালোত্রা সেই সমস্যার সমাধান খুঁজে পেয়েছে প্রথম দিন থেকে। অথচ সেখানে কলকাতা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বের বানতলা আজও সমস্যায় জেরবার। চর্মনগরী তৈরির পরে এক দশক পেরিয়েও দূষণের ভূত তাড়া করে চলেছে তাকে। হালফিলে সেই সমস্যা মেটাতে বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা গড়ার সিংহভাগ খরচ বওয়ার কথা রাজ্য বলেছে ঠিকই। কিন্তু সে কাজ শেষ হতেও অনেক দেরি।
রাজস্থান শিল্পোন্নয়ন নিগমের আঞ্চলিক অধিকর্তা (রিজিওনাল ম্যানেজার-ভিলওয়াড়া) জে পি শর্মা বলছিলেন, বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে জল দূষণের সমস্যা। বিশেষত রং করা কিংবা কাপড় তৈরিতে রাসায়নিক ব্যবহারের কাজ যে-সমস্ত কারখানায় হয়, সেখানে তা থাকবেই। তাই তার সমাধান হিসেবে প্রকল্প চালুর আগেই বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা (এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বা ইটিপি) তৈরি করা জরুরি। কিন্তু সমস্যা হল, অনেক ছোট সংস্থার পক্ষেই তার খরচ বওয়া সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে তার বন্দোবস্ত করার দায় সরকারেরই।
উদাহরণ হিসেবে শর্মা তুলে ধরছেন বালোত্রার কথা। বস্ত্রশিল্পের প্রায় ৬০০টি ছোট কারখানা রয়েছে সেখানে। কিন্তু নিজেদের পকেটের জোরে ইটিপি তৈরি তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই আজ থেকে বছর পনেরো আগে প্রায় ১৫ কোটি টাকা ঢেলে একসঙ্গে তাদের সকলের ব্যবহারের জন্য পরিশোধন ব্যবস্থা (কমন এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বা সিইটিপি) তৈরি করে তবেই সেই পরিকাঠামো-সহ জমি বিক্রি করেছিল নিগম। ওই খরচ ধরা হয়েছিল জমির দামের মধ্যেই। তাঁর কথায়, ‘‘সরকার লগ্নির টাকা ফেরত পেয়েছে। দূষণের সমস্যায় পড়তে হয়নি সংস্থাগুলিকে। শুধু তা-ই নয়, প্রকল্পে জমি দেওয়াই হয়েছে এই শর্তে যে, সিইটিপি চালানোর মাসিক খরচ বইবে তারা।’’
জেলা শিল্প কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার শিবরাজ শর্মাও জানাচ্ছেন, ‘‘সংস্থার উৎপাদনের সঙ্গে জল দূষণের সমস্যা থাকলেই ইটিপি গড়া বাধ্যতামূলক। বড় সংস্থাগুলি তা নিজেরাই তৈরি করে।’’ জয়পুর থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরের ভিলওয়াড়ায় যেমন তা তৈরি করেছে ভিলওয়াড়া সুটিংস, মডার্ন উলেন্স, কাঞ্চন টেক্সাটাইলসের মতো সংস্থা। শিবরাজের দাবি, নতুন শিল্পনীতিতে ইটিপি গড়ার যন্ত্রপাতিতে লগ্নির অঙ্কে ২০ শতাংশ (এক কোটি টাকা পর্যন্ত) ভর্তুকি দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছে রাজস্থান। শর্ত হল, বর্জ্য শোধন ব্যবস্থা এমন হতে হবে, যাতে কোনও দূষিত তরল বাইরে না-যায় (জিরো লিকুইড ডিসচার্জ বেসড ইটিপি)।
চামড়া আর কাপড়ের ব্যবসার সমীকরণ আলাদা। এক নয় দূষণ সমস্যাও। তবু বালোত্রা
আর ভিলওয়াড়ার এই গল্প বানতলার কথা মনে পড়ায় বারেবারে।
বানতলা চর্মনগরী তৈরি করে বেসরকারি নির্মাণ সংস্থা এম এল ডালমিয়া। বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা গড়ার কথা ছিল তাদেরই। কিন্তু শুরু থেকেই তা বিতর্কের কেন্দ্রে থেকেছে। চর্ম ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ছ’টি সিইটিপি তৈরির বদলে করা হয়েছে মাত্র চারটি। গত জুনেও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র জানিয়েছিলেন, ‘‘পর্যাপ্ত বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থার অভাবেই নতুন প্রকল্পকে সবুজ সঙ্কেত দেওয়া যাচ্ছে না।’’ আটকে রয়েছে লগ্নি। দূষণের জেরে দমবন্ধ দশা পাশের তথ্যপ্রযুক্তি পার্কেরও।
কল্যাণবাবুর যুক্তি ছিল, ‘‘চারটি সিইটিপি-তে ২ কোটি লিটার বর্জ্য পরিশোধন হয়। অথচ বর্জ্যের পরিমাণ ৩ কোটি লিটার।’’ অর্থাৎ, চর্মনগরী তৈরির দশ বছর পরেও ঘাটতি থেকে গিয়েছে।’’ তা-ও আবার এমন প্রকল্পে, যেখানে ব্যবসায়ীরাই দাবি করছেন, এখানে ৩৫০টি কারখানা থেকে অন্তত ৫,০০০ কোটি টাকার পণ্য রফতানি করেন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, ১৯৯৫ সালে এই চর্মনগরী গড়াই হয়েছিল কলকাতাকে দূষণমুক্ত করতে। ট্যাংরা, তপসিয়া এলাকার ৫৩৮টি চামড়া কারখানা বা ট্যানারিকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে।
শিল্পমহলের অভিযোগ, বহু বার বলা সত্ত্বেও বানতলায় এই দূষণ-জট ছাড়ানো নিয়ে উদাসীন থেকেছে প্রশাসন। বিশেষত সংশ্লিষ্ট নির্মাণ সংস্থার গলদ জেনেও তাদের বিরুদ্ধে রাজ্য ব্যবস্থা না-নেওয়ায় ক্ষুব্ধ অনেকে। হালফিলে সিইটিপি গড়ার সিংহভাগ খরচ দেওয়ার কথা রাজ্য বলেছে। কিন্তু তাতে গত এক দশকের ভোগান্তি যাওয়ার নয়।
হয়তো কিছুটা কাকতালীয়। কিন্তু আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় রাজস্থানের শিল্পমন্ত্রী গজেন্দ্র সিংহ খিমসার বলছিলেন, বিনিয়োগ টানার তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে রাজ্যগুলির মধ্যে। তাই সরকারি নীতিতে ক্ষুণ্ণ হয়ে যাতে কোনও লগ্নিকারী মুখ ফিরিয়ে না-নেন, তা নিশ্চিত করতে চান তাঁরা। মন্ত্রীর কথায়, ‘‘শুধু দ্রুত জমি দিলে হবে না। তা দিতে হবে পরিকাঠামো সমেত এবং ন্যায্য দামে। যেমন, এবড়ো-খেবড়ো জমি দিলে হবে না। তা দিতে হবে সমান করে (লেভেলিং)। তৈরি করে দিতে হবে নিকাশি। থাকতে হবে রাস্তা, বিদ্যুৎও। পরিবেশ-সহ সমস্ত ছাড়পত্র তাড়াতাড়ি এবং এক লপ্তে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’’ খিমসারের ‘ভয়’, কথা না-রেখে শুধু শুক্নো প্রতিশ্রুতি দিলে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন বিনিয়োগকারীরা।
শুনেই বানতলা আর রাজ্যের কথা ফের মনে পড়ল। প্রশ্ন জাগল, ওই একই ভয় নবান্ন পায় কি?