নির্মলা সীতারামন। ফাইল চিত্র।
কোথায় দাম বেড়েছে? অবাক হয়ে প্রশ্ন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের। তাঁর পাল্টা যুক্তি, ‘‘তেলের দাম তো বাড়েনি। বরং সারা দেশেই কমেছে। তা সে যে পরিমাণেই হোক।’’
বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দাম হু হু করে কমছে। দেশের বাজারে পেট্রল-ডিজেলের দাম তাতে অনেকটা কমবে বলে আশা তৈরি হয়েছিল। বিরোধীরাও দাবি তুলেছিলেন, অর্থনীতির ঝিমুনি, তার উপরে করোনাভাইরাসের জেরে ব্যবসা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পেট্রল-ডিজেলের দাম কমিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শিল্প-ব্যবসায়ী মহলকে সুরাহা দিক কেন্দ্র। কিন্তু সেই আশায় জল ঢেলে দিয়ে নরেন্দ্র মোদী সরকার। পেট্রল-ডিজেলে লিটারে ৩ টাকা শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে শনিবার থেকে। এর মধ্যে বিশেষ উৎপাদন শুল্কের বৃদ্ধি ২ টাকা, সড়ক পরিকাঠামো সেসে ১ টাকা। বাড়তি কর না-বসালে শনিবারই দুই জ্বালানির দাম লিটারে প্রায় তিন টাকা কমে যেত। বাড়তি কর চাপানোয় সেই সুবিধা মিলল না।
এতে চলতি অর্থ বছরের শেষ দু’সপ্তাহে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা এবং আগামী অর্থ বছরে বাড়তি ৩৯ হাজার কোটি টাকা আয় হবে সরকারের। অর্থনীতির ঝিমুনি, করোনাভাইরাসের ধাক্কায় রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। জ্বালিনি শুল্ক বাবদ বাড়তি আয় কিছুটা স্বস্তি জোগাবে। আম জনতা পেল কী?
কলকাতায় শুক্রবার আইওসি-র পাম্পে পেট্রলের দাম ছিল লিটার প্রতি ৭২.৭০ টাকা। ডিজেলের ৬৫.০৭ টাকা। শনিবার ৩ টাকা বাড়তি শুল্ক চাপিয়ে পেট্রলের দাম হয়েছে ৭২.৫৭ টাকা। ডিজেলের ৬৪.৯১ টাকা। অর্থাৎ, দাম যেখানে ৩ টাকা হারে কমতে পারত, সেখানে পেট্রলে কমেছে ১৩ পয়সা ও ডিজেলে ১৬ পয়সা। আর এই হিসেব দেখিয়েই অর্থমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রকের কর্তারা আজ বলছেন, বাড়তি কর চাপলেও তেলের দাম বাড়েনি। বরং কমেছে! রবিবারও শনিবারের তুলনায় পেট্রল ১২ পয়সা, ডিজেল ১৪ পয়সা কমছে।
কংগ্রেসের অজয় মাকেন বলেন, ‘‘এটা জনবিরোধী নীতি। বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দাম যে ভাবে কমেছে, তাতে পেট্রল-ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের দাম ৩৫-৪০% কমা উচিত।’’ কংগ্রেসের দাবি, পেট্রল-ডিজেলকেও জিএসটি-র আওতায় আনা হোক। সেই সিদ্ধান্ত হওয়া পর্যন্ত এ-যাবৎ চাপানো সমস্ত শুল্ক প্রত্যাহার করা হোক। সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরির অভিযোগ, ‘‘সরকার বড়লোক শিল্পপতিদের ঋণ মকুব করে দিচ্ছে। দেশের বাকি মানুষের জন্য শুল্ক
চাপাচ্ছে।’’ অবিলম্বে পেট্রল ডিজেলের
দাম কমানোর দাবি জানিয়ে আপ নেতা রাঘব চড্ঢার মন্তব্য, ‘‘দেশে এখন গাড়ি চালানোর চেয়ে বিমান ওড়ানোয় খরচ কম।’’ সেস থেকে এই
আয় রাজ্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হবে না। এনসিপি নেত্রী সুপ্রিয়া সুলের মন্তব্য, ‘‘এটা পুরোপুরি আর্থিক নীতি পরিচালনায় সরকারের ব্যর্থতা।’’
সরকারের সিদ্ধান্তে হতাশ শিল্প মহলও। পিএইচডি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ডি কে আগরওয়াল বলেন, ‘‘৬ জানুয়ারি থেকে ৯ মার্চের মধ্যে অশোধিত তেলের দাম ৫০% কমলেও পেট্রলের দাম ৭% কমেছে। আমাদের সুপারিশ, পেট্রোপণ্যের দাম অন্তত ২৫% কমুক। তাতে শিল্প জগতের বিরাট সুবিধা হবে। মূল্যবৃদ্ধির হার কমবে, কেনাকাটা বাড়বে, শিল্পের খরচ কমবে।’’
এ বারই অবশ্য প্রথম নয়। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম তলানিতে নেমেছিল। সে বারও উৎপাদন শুল্ক বাড়িয়ে সরকারের আয় ধরে রাখতে আম জনতাকে সুরাহা দেয়নি সরকার। ২০১৪-র মে মাসে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসে। তখন পেট্রলে কর ছিল লিটারে ৯.৪৮ টাকা। শনিবার তা বেড়ে হয়েছে ২২.৯৮ টাকা। ডিজেলে তখন লিটার পিছু ৩.৫৬ টাকা কর নেওয়া হত। এখন তা ১৮.৮৩ টাকা। অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের যুক্তি, অশোধিত তেলের দাম কমেছিল ২০১৯-এ এপ্রিলের পরেও। তার অনেকটা সুবিধা সাধারণ মানুষের ঝুলিতে গিয়েছে। এখন রাজকোষের যা টানাটানি অবস্থা তাতে মানুষকে অশোধিত তেলের দাম কমার সুরাহা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ঘাটতি সামাল দিতে রাজকোষে টাকা তোলা জরুরি। বিশেষ উৎপাদন শুল্ক ও সেসের হারও বাড়াতে হয়েছে
একই কারণে।
মোদী জমানায় ২০১৪-র নভেম্বর থেকে ২০১৬-র জানুয়ারির মধ্যে পেট্রল-ডিজেলে শুল্ক বেড়েছে ন’বার। এই ন’দফায় পেট্রলে মোট ১১.৭৭ টাকা, ডিজেলে ১৩.৪৭ টাকা কর বেড়েছে। তার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম কমলেও পেট্রল-ডিজেলের দামে তার ফায়দা মেলেনি। ২০১৭-র অক্টোবরে ২ টাকা, তার পরের বছরে দেড় টাকা কমানো হয়। কিন্তু ২০১৯-র জুলাইয়ে ফের ২ টাকা বাড়ানো হয়। এ বার ৩ টাকা বাড়ানো হল।