নোট-কাণ্ডে এ বার শুরু কাজ খোয়ানোর পালা

নোটের চোট এ বার লাগতে শুরু করেছে ছোট শিল্পের খেটে খাওয়া মানুষের পেটে। ব্যাঙ্কে টাকা আছে। রয়েছে জিনিস-পত্তরের চাহিদাও। অথচ নোটের আকালে সেই টাকা যথেষ্ট পরিমাণে তুলতে না-পারায় বাজারে চাহিদা এখন বাড়ন্ত।

Advertisement

দেবপ্রিয় সেনগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৬ ০২:১৭
Share:

প্রতীকী ছবি।

নোটের চোট এ বার লাগতে শুরু করেছে ছোট শিল্পের খেটে খাওয়া মানুষের পেটে।

Advertisement

ব্যাঙ্কে টাকা আছে। রয়েছে জিনিস-পত্তরের চাহিদাও। অথচ নোটের আকালে সেই টাকা যথেষ্ট পরিমাণে তুলতে না-পারায় বাজারে চাহিদা এখন বাড়ন্ত। আবার অন্য দিকে, টাকার অভাবে মাল তুলতে সমস্যায় পড়ছেন ছোট ব্যবসায়ীরা। কঠিন হচ্ছে নগদে বেতন দেওয়া। সব মিলিয়ে, ব্যবসা চালানোই সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ছোট শিল্পের পক্ষে। ফলে এই জাঁতাকলে পিষে ইতিমধ্যেই কাজ হারাতে শুরু করেছেন সেখানকার অনেক কর্মী। প্রথম কোপ অবশ্যই পড়ছে অস্থায়ী কর্মীদের উপর। নোটের জোগান খুব তাড়াতাড়ি অন্তত বেশ খানিকটা না-বাড়লে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা।

ছোট দোকান থেকে শুরু করে অনলাইন বাজার— কেনাকাটা আটকে যাচ্ছে প্রায় সর্বত্র। কার্ড বা ই-ওয়ালেট চললে কিংবা তা ব্যবহারে দড় হলে, এক কথা। নইলে অনেক সময়ে রোজকার প্রয়োজনের জিনিসেও কাটছাঁট করতে হচ্ছে নোটে তা কেনার কথা ভাবলে।

Advertisement

যে-কোনও জিনিস ছোঁয়ার আগেই ক্রেতাদের মনে ভিড় করছে হিসেব— দিনে এটিএম থেকে আড়াই হাজার। আর সপ্তাহে ২৪ হাজার টাকা পর্যন্ত। টাকা তোলার এই তো সীমা। হয়তো তাতেও অসুবিধা হত না ঠিকঠাক ওইটুকু পাওয়া গেলে। কিন্তু ব্যাঙ্কে গেলে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে নগদ অমিল। ফলে হাতের নোট কিছুটা বাড়িতেও তুলে রাখতে চাইছেন অনেকে। ছোট কারখানার মালিক আর দোকানদারদের প্রশ্ন, ‘‘তা হলে আর বিক্রিবাটা হবে কোথা থেকে?’’

মোদী সরকার কালো টাকার বিরুদ্ধে যে-যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তা নিয়ে প্রায় কারওর আপত্তি নেই। কিন্তু সেই লড়াইয়ে শেষমেশ ছোট শিল্পই উলুখাগড়া হবে কি না, সেই দুশ্চিন্তা ছেয়ে ফেলেছে বাজারকে।

মধ্য কলকাতার জানবাজারে জুতো তৈরি করেন ১২০ জন চর্ম ব্যবসায়ী। সেখানে কাজ করেন প্রায় হাজারখানেক কর্মী। বেশির ভাগই অস্থায়ী। এঁদের অনেকেরই এখন কাজ নেই। এমনিতে টেরিটি বাজার, কলেজ স্ট্রিট, ঠনঠনিয়া, লোয়ার চিৎপুর রোড সমেত শহরের বিভিন্ন স্থানীয় বাজার ও হাওড়ায় এই জুতো বিক্রি হয় রমরমিয়ে। সেখানে এ বার কঠিন হচ্ছে ক্রেতার দেখা পাওয়া।

ওই শিল্প তালুকের চেয়ারম্যান মুঞ্জল প্রসাদ বলেন, ‘‘শীতের মরসুমে আমাদের পা ঢাকা জুতো চুটিয়ে বিক্রি হয়। কিন্তু এ বার তাতে ভাটা। ফলে তৈরি কমাতে হয়েছে ৩০%-৪০%।’’ আর এক ব্যবসায়ী অশোক দাসও বলেন, ‘‘সাধারণত দিনে গড়ে ৭৫ জোড়া জুতো তৈরি করি। এখন ২০-৩০ জোড়ার বেশি হচ্ছে না। আমার কাছে ৬-৭ জন কর্মী ছিলেন। এখন দু’জন। বাকিরা বলে গিয়েছেন ফের কাজ বাড়লে জানাতে।’’

শিলিগুড়ি শিল্প তালুকের বিভিন্ন কারখানা ও পরিষেবা সংস্থায়ও চাহিদা কমার কারণে সাময়িক ভাবে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে অস্থায়ী কর্মীদের একাংশকে। নগদের টান কোন পর্যায়ে, তা স্পষ্ট ই-কমার্স সংস্থা স্ন্যাপডিলের পদক্ষেপেও। সংস্থা জানাচ্ছে, যাঁরা নগদে পণ্য কিনতে ‘বুক’ করেছিলেন (ক্যাশ অন ডেলিভারি), এখন বাড়িতে পৌঁছলে সে জিনিস ফিরিয়ে দিচ্ছেন তাঁদের অনেকে। ওই সব পোর্টাল মারফত যে-সব ছোট সংস্থা পণ্য বিক্রি করে, সমস্যায় তারাও। চাকরি যাচ্ছে ‘ডেলিভারি বয়’-দেরও। এমসিসি চেম্বারের ছোট-মাঝারি শিল্প কমিটির চেয়ারম্যান ঋষভ কোঠারির কথায়, ‘‘নগদ না-থাকায় অনেকে কেনাকাটা স্থগিত রাখছেন। নোটের চাকা বসে যাওয়ায় থমকে যাচ্ছে বিক্রির রথ।’’

শুধু চাহিদার ঘাটতি নয়, বহু ক্ষেত্রে ছোট ব্যবসার রথের চাকা বসে যাচ্ছে নগদ মূলধনের অভাবে। অনেক ছোট ব্যবসাই কর্মীদের নগদে বেতন মেটায়। বিশেষত অস্থায়ী কর্মীদের। তা ছাড়া, কাঁচামাল কেনার জন্যও নগদের উপরেই নির্ভর করতে হয়। এক শিল্পকর্তা বলছিলেন, ‘‘কারেন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে সপ্তাহে টাকা তোলার সীমা বেড়ে ৫০ হাজার হয়েছে। কিছুটা ওভারড্রাফ্‌টের সুবিধাও ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা কতটুকু?’’ বাড়ি-বাড়ি বোতলবন্দি পানীয় জল সরবরাহ করা এক ব্যবসায়ী জানান, নগদের অভাবে কর্মীদের বেতন দিতে ও জল কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে।

আলমারি থেকে ধূপকাঠি, সুগন্ধি— চাহিদা আর নগদের অভাবে ব্যবসা মার খাচ্ছে সর্বত্র। কোনও সংস্থা এমনিতে ৫০টি আলমারি তৈরি করলে, এখন করছে ১৫-২০টি। তেমনই ধূপকাঠি উৎপাদন কমায় চাহিদায় কোপ পড়েছে সুগন্ধিরও।

কর্মসংস্থানের সংখ্যার নিরিখে বড় সংস্থাকে প্রায় সব সময়ই টেক্কা দেয় এ ধরনের ছোট-মাঝারি শিল্প। ফলে সেখানে কর্মী ছাঁটাইয় মানে বহু বাড়িতেই হাঁড়ি চড়ার সমস্যা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement