ভারত, চিনের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথে বড় জায়গা পেতে পারে কলকাতাও

দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে পণ্যচলাচল ব্যবস্থার উপযুক্ত পরিকাঠামোর প্রয়োজন ও সম্ভাবনাগুলি নিয়ে ভারত, চিন-সহ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের একাধিক দেশ এখন আগ্রহী।চিন ইতিমধ্যেই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নীতি ঘোষণা করেছে, যার মাধ্যমে চিন দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ১৪:৫৬
Share:

সেই ঐতিহাসিক সিল্ক রুট।

দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে পণ্যচলাচল ব্যবস্থার উপযুক্ত পরিকাঠামোর প্রয়োজন ও সম্ভাবনাগুলি নিয়ে ভারত, চিন-সহ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের একাধিক দেশ এখন আগ্রহী।চিন ইতিমধ্যেই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নীতি ঘোষণা করেছে, যার মাধ্যমে চিন দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী। এ জন্য চিন ৪৬০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে পাকিস্তান, আফগানিস্থান-সহ মধ্য এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে দিয়ে রেলপথ, সড়কপথ তৈরি করছে। অন্য দিকে, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিভিন্ন দেশে নৌবন্দর তৈরি করছে। এভাবে ওই দেশগুলির সঙ্গে সুসংহত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ার চেষ্টা করছে চিন।

Advertisement

অন্য দিকে, ভারতও ইরানের চাহবাহার বন্দর তৈরি করে দেওয়ার জন্য সম্প্রতি সে দেশের সঙ্গে চুক্তি করেছে। সেখান থেকে সড়ক ও রেলপথে আফগানিস্থান ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ হয়ে রাশিয়া পর্যন্ত বাণিজ্যের নতুন পথ তৈরি করার ভাবনা রয়েছে। এর সঙ্গে পূর্ব ভারতের দিক থেকে কলকাতাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ, চিন, মায়ানমারের মধ্যে সুসংহত পণ্যচলাচল ব্যবস্থা গড়ে উঠলে এশিয়ার বেশির ভাগ দেশই এক যৌথ বাজারে পরিণত হতে পারে।একই সঙ্গে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একগুচ্ছ আধুনিক বন্দর গড়ে ওঠায় সড়ক ও রেলপথের সঙ্গে নৌবাণিজ্য সহজেই যুক্ত হতে পারবে। আর সেক্ষেত্রেও ভারত গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগের কেন্দ্র হয়ে থাকবে।

যোগাযোগ ও বাণিজ্যিক লেনদেনের এই বিপুল সম্ভাবনার মানচিত্রে কলকাতার অবস্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতার এই গুরুত্ব শুধু ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দেশের বাকি অংশের যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য নয়, বরং দক্ষিণ পূর্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রেও কলকাতা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হওয়ার দাবিদার। যার ইঙ্গিত মেলে কলকাতা ও চিনের কুংমিং শহরের মধ্যে সরাসরি পণ্যচলাচলের জন্য কয়েক হাজার কিলোমিটার সড়কপথ তৈরির চিনা প্রস্তাব থেকে।

Advertisement

ভারত ও চিন সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রাথমিক শর্তই হল সড়ক, রেল ও সমুদ্রপথে পণ্য চলাচলের উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা। আশা করা হচ্ছে, এই সব যোগাযোগের পথ যে সব মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে যাবে, সেই সব এলাকার মানুষজনও এই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সুফল ভোগ করবেন।

এখানেই প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী এবং ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ (সিআরজি)-এর ইনস্টিটিউট প্রফেসর রণবীর সমাদ্দার। এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে বাণিজ্যসম্পর্ক দূঢ় করতে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়টি (Mapping Infrastructure and Logistics) নিয়ে সম্প্রতি রোজা লুক্সেমবুর্গ শিফটুং (Roza Luxemburg Shiftung)-এর সহযোগিতায় সিআরজি একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। এই আলোচনায় প্রধান বক্তা হিসাবে অংশ নিয়ে সিআরজি-র অধ্যাপক রণবীর সমাদ্দার মনে করিয়ে দেন, এই বিপুল পরিকাঠামো নির্মাণ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সরকারি মহলে এবং বেসরকারি মহলে নানা স্তরে আলোচনা চলছে। কিন্তু যে শ্রমিকবাহিনীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই বিপুল পরিকাঠামো নির্মাণ হয়ে থাকে, সরকারের কোনও নীতি সংক্রান্ত নথিতেই সেই শ্রমিকদের সম্পর্কে কোনও চিন্তাভাবনার প্রতিফলন নেই। অধ্যাপক সমাদ্দারের মন্তব্য, এ ভাবে বিশ্বায়নের যুগে নগরায়ন ও পরিকাঠামো নির্মাণে শ্রমিকদের ব্যবহার করা হলেও তাদের সম্পর্কে সরকারি নীতি অস্পষ্টই থেকে যাচ্ছে।শুধু তাই নয়, এই বিপুল কর্মযজ্ঞে শ্রমিকরা যে এক গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যিক অংশ, সেই তথ্যটাই সচেতনভাবে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।

১২৭১ থেকে ১২৯৫ সাল- সিল্ক রুটে যে পথ ধরে গিয়েছিলেন মার্কো পোলো।

পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় চতুর্বেদী মনে করেন, গোটা বিষয়টিকে আরও সতর্কভাবে পরীক্ষা করা দরকার। টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস (টিআইএসএস), গুয়াহাটির অধ্যাপক সঞ্জয় বরবরা অসমে তাঁর দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে বলেন, শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরিকাঠামোর কথা ভাবলেই হবে না। সেই সঙ্গে ওই সব এলাকায় বসবাসকারী বিভিন্ন জনজাতি ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষজন যাতে নিজেদের মধ্যেই সংঘাতে জড়িয়ে না পড়েন, সে কথাও রাষ্ট্র ও বৃহত্তর সমাজকে মাথায় রাখতে হবে। এই তিনজন ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলোচনাসভায় অংশ নিয়ে গোটা বিষয়টির বিভিন্ন দিকের উপর আলোকপাত করেন।

বিশ্বায়নের যুগে এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলির মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি করে বাণিজ্যিক লেনদেন হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে পণ্য চলাচলের রাস্তা সহজ করতে মাশুলের বেড়া কিছুটা নমনীয় করার ফলে আন্তর্জাতিক পুঁজি এখন এশিয়ার দেশগুলিতে সহজে যাতায়াত করতে পারবে। চিন ইতিমধ্যেই এশিয়ার দেশগুলির বাজারের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে।

এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে দ্রুত পণ্য চলাচলের জন্য উন্নত পরিকাঠামো তৈরি করা ও বাণিজ্যিক লেনদেনের ক্ষেত্রে মাশুল ইত্যাদির বাধা কমিয়ে যোগাযোগ বাড়ানোর ব্যবস্থা করার সঙ্গে সঙ্গেই পুরনো স্পাইস রুট, কটন রুট ইত্যাদির ইতিহাস খতিয়ে দেখে নতুন ভাবনায় সেগুলি নতুন করে গড়ে তোলার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। সিল্ক রুটের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তবে এর সবটাই যে খুব মসূণভাবে হচ্ছে, তা নয়। এ নিয়ে ভারত ও চিনের মধ্যে এখনও বেশ কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। তা সত্ত্বেও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে আর্থিক ও বাণিজ্যিক লেনদেনের জন্য আরও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার গুরুত্ব কোনও দেশই অস্বীকার করতে পারছে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement