স্মৃতি। সম্ভবত আর দেখা যাবে না এই ছবি। সুসম্পর্কের সেই সময়ে (বাঁ দিকে) বিশাল সিক্কা ও এন আর নারায়ণমূর্তি। ফাইল চিত্র
গত ১৩ ফেব্রুয়ারিও বিশাল সিক্কা দাবি করেছিলেন এন আর নারায়ণমূর্তির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক উষ্ণ। সে দিনও না কি তাঁদের মধ্যে খোশগল্প হয়েছিল অ্যাপল ওয়াচ নিয়ে। অথচ শুক্রবার ‘বিদায় বেলা’য় নাম না-করে সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাক্তন কর্ণধার মূর্তিকেই তীব্র আক্রমণ করলেন তিনি। ইঙ্গিত, এমডি-সিইওর পদ থেকে সরে যাচ্ছেন মূলত মূর্তির ভিত্তিহীন কিন্তু নাছোড় আক্রমণের কারণেই।
২০১৪ সালের জুনে যখন ইনফোসিসের কর্ণধার হিসেবে সিক্কা প্রথম বেঙ্গালুরুতে পা রাখলেন, তখন প্রশংসায় পঞ্চমুখ মূর্তি। মজা করে বলেছিলেন, ‘‘সিক্কা মানে টাকা। তাই বিশাল সিক্কা মানে অনেক টাকা। ইনফোসিসের যা দরকার।’’ অথচ তিন বছরের মাথায় সংবাদমাধ্যমের হাতে যাওয়া মূর্তির যে চিঠিকে ঘিরে এ দিন ক্ষোভ উগরে দিয়েছে ইনফোসিসের বোর্ড, তার মূল প্রতিপাদ্য সিইও হিসেবে সিক্কা অচল!
তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাটির পরিচালন পর্ষদ স্পষ্ট বলেছে, কর্ণধার হিসেবে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন সিক্কা। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের হাতে পড়া মূর্তির চিঠিতে দেখা যাচ্ছে, বোর্ড, ম্যানেজমেন্টের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বারবার সংস্থার তরফ থেকে সব কিছু খোলসা করার চেষ্টা সত্ত্বেও ফের সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে সংস্থা পরিচালনায় স্বচ্ছতা নিয়ে। বিভিন্ন তদন্তে যে সমস্ত অভিযোগ ভিত্তিহীন প্রমাণ হয়েছে, সেগুলিও ফের খুঁচিয়েছেন মূর্তি।
সংশ্লিষ্ট মহলের খবর, সেই চিঠিতে না কি বলা হয়েছিল, চিফ টেকনোলজি অফিসার (সিটিও) হিসেবে সিক্কা ভাল হলেও, সিইও হিসেবে অচল। এবং সে কথা না কি বোর্ডের একাংশই বলেছে নারায়ণমূর্তিকে। দু’তরফে সম্পর্ক তেতো হচ্ছিল অনেক দিন থেকেই। অনেকে মনে করছেন, তাতে শেষ পেরেক পুঁতে দিল সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতার ওই ই-মেল।
তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়ার বড় অংশ মনে করে, ব্যবসার মুখ ঘুরিয়ে বরাতের সংখ্যা বাড়ানো, বেশি সংখ্যায় অধিক মুনাফার প্রকল্প ঝুলিতে টানা, কর্মীদের সংস্থা ছাড়ার হিড়িকে রাশ— ব্যবসার বিভিন্ন মাপকাঠিতে কর্ণধার হিসেবে সিক্কার পারফরম্যান্স মন্দ নয়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, বেশি দক্ষতা লাগে, এমন কাজের মোটা অঙ্কের বরাত পাওয়াকে পাখির চোখ করেছেন সিক্কা। বেশি করে ঝুঁকছেন স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি (অটোমেশন), বৈদ্যুতিন বুদ্ধি (আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স) এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির বাজার ধরতে। এই কৌশল বদল ইনফোসিসের তুরুপের তাস হয়ে উঠতে পারে বলে গত তিন বছরে বারবার বলেছেন তাঁরা। কিন্তু সমস্ত কিছু সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে সিক্কার তাল ঠোকাঠুকির কারণ হয়ে রইল সংস্থা পরিচালনায় স্বচ্ছতাই।
জানুয়ারিতে নিজেদের হাতে গড়া সংস্থার পর্ষদকে চিঠি পাঠিয়ে কিছু সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন নারায়ণমূর্তি, ক্রিস গোপালকৃষ্ণন, নন্দন নিলেকানিরা। সেখানে সিক্কার বিপুল বেতন বৃদ্ধি, সংস্থা ছাড়ার সময়ে প্রাক্তন সিএফও রাজীব বনসলকে আকাশছোঁয়া অঙ্ক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি সমেত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাঁরা। একে প্রতিষ্ঠাতা, তার উপর ইনফোসিসের ১২.৭৫% অংশীদারি এঁদের পকেটে। ফলে এ চিঠি গুরুত্ব পেয়েছিল।
চেয়ারম্যান আর শেষাশয়ীর দাবি ছিল, সিক্কার বেতন প্রায় ৪০ লক্ষ ডলার বেড়ে ১.১ কোটি ডলার হয়েছে ঠিকই। কিন্তু ধরাবাঁধা মূল বেতন ৫০ লক্ষ থেকে কমে হয়েছে ৪০ লক্ষ ডলার। বাড়ানো হয়েছে বাকি অংশ, যা সংস্থায় তাঁর দীর্ঘ দিন থাকা এবং ভাল ফলাফলের সঙ্গে যুক্ত। এ জন্য শোয়ারহোল্ডারদের অনুমতিও নেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
সিএফও পদ ছাড়ার সময়ে বনসলকে ১৭ কোটি টাকারও বেশি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ইনফোসিস। এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বারবার। শেষাশয়ী বহু বার বলেছেন, ‘‘ভবিষ্যতে আর এমন হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’’ তবে বনসলের মুখ বন্ধ রাখার জন্য ওই টাকা দেওয়া হয়েছিল, এ কথা শোনা বিরক্তিকর বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
কথা উঠেছিল, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়ন্ত সিন্হার স্ত্রীকে পর্ষদে আনা নিয়েও। শোনা যায়, পর্ষদে রাজনীতির ছোঁয়াচ প্রতিষ্ঠাতারা চাননি। কিন্তু শেষাশয়ীর যুক্তি, স্বামীর পেশাগত পরিচয় এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য হওয়া উচিত নয়।
প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে যে বিরোধ নেই, গত কয়েক মাসে অজস্রবার তা বলতে হয়েছে শেষাশয়ীকে। একই কথা বলেছেন সিক্কা। খরচ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় বোঝাতে হয়েছে, কেন সিলিকন ভ্যালিতে অফিস খুলতে হয়েছে। এমনকী দিতে হয়েছে সিক্কার চার্টার্ড ফ্লাইট ব্যবহারের হিসাবও!
সিক্কা যে আপাতত এক ডলার বেতনে ভাইস চেয়ারম্যান থাকছেন কিংবা অন্তর্বর্তী সিইও হচ্ছেন প্রবীণ রাও— দিনের শেষে এ সবই তাই শুক্নো তথ্য হয়ে থাকল। অনেকের মতে, সংস্থা তৈরির ৩৩ বছর পরে সিক্কার দৌলতেই প্রতিষ্ঠাতা ছাড়া প্রথম অন্য কারও হাতে রাশ গিয়েছিল ইনফোসিসের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মূর্তির নাগাড়ে ছোঁড়া তিরেই তাঁকে সরতে হল বলে মনে করছেন তাঁরা।