বিক্ষোভ: আগুনে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে চিনা পণ্য। সম্প্রতি মুম্বইয়ে। ছবি: এপি
কী কাণ্ড! বারুদের গন্ধে বাতাস ভারী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতেই দেশ জুড়ে গর্জন চিনা
পণ্য বর্জনের।
কেউ বহুতলের ব্যালকনি থেকে আছড়ে ফেলছেন টিভি। সেই দৃশ্য ‘ভাইরাল’ সোশ্যাল মিডিয়ায়। কেউ ডাক দিচ্ছেন মোবাইল থেকে চিনা অ্যাপ দূর করার। কারও প্রতিজ্ঞা, এ বার থেকে দীপাবলিতে চিনা আলো আর নয়, বাচ্চার হাতে নয় ওই খেলনা। খোঁজ পড়ছে মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটারে অ-চিনা ব্র্যান্ডেরও।
চিনের সঙ্গে সংঘাতের খবর ছড়ানোর পরে এই ‘জোশ’ আরও উস্কে দিয়েছে কিছু সরকারি সিদ্ধান্ত। ‘চিনবিরোধী জাতীয়তাবাদের সুর’ চড়েছে স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের প্রচারে। সঙ্গে ‘আত্মনির্ভর ভারতের মন্ত্র’। কখনও সরকারি টেন্ডার থেকে সরানোর কথা বলা হচ্ছে চিনা সংস্থাকে। বিএসএনএলকে চিনা প্রযুক্তি বা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করতে বারণ করছে কেন্দ্র। দেশে তৈরি যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ ব্যবহারে জোর দিচ্ছে রেল। জল্পনা জোরালো হচ্ছে কিছু চিনা পণ্যের উপরে চড়া শুল্ক বসানোর বিষয়ে। শোনা যাচ্ছে চিনা পণ্যে বাঁধ দিতে গুণমানে কড়াকড়ি বাড়ানোর কথাও। অনেকে বলছেন, বুধবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে দীর্ঘ মেয়াদি চিনা লগ্নি ও বাজারে চিনা আর্থিক সংস্থার বিনিয়োগ রুখতে নিয়ম বদলানো নিয়ে কথা হতে পারে। শুক্রবারই ভারতের পড়শি দেশগুলি থেকে এ দেশের পেনশন ফান্ডে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির ক্ষেত্রে কড়াকড়ির প্রস্তাব দিয়েছে অর্থ মন্ত্রক। সংশ্লিষ্ট মহল বলছে, এর লক্ষ্য আসলে চিনই। অনেকের আবার মতে, অনলাইনে ওই দেশের পণ্যের বিক্রি রুখতে নাকি আঙুল বাঁকানো হতে পারে ই-কমার্স নীতিতেও। চিন অবশ্য দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের উপরেই জোর দিয়েছে এ দিন।
চিনা পণ্য বয়কটের ডাক আগেই দিয়েছে সর্ব ভারতীয় খুচরো ব্যবসায়ীদের সংগঠন সিএআইটি। শুক্রবার রাজ্যে ব্যবসায়ীদের আর এক সংগঠন সিডব্লিউবিটিএ-র সুশীল পোদ্দারের দাবি, সদস্যদের যতটা সম্ভব চিনা পণ্য কম বিক্রি করতে বলছেন তাঁরা। একই ডাক অল ইন্ডিয়া ব্যাপার মন্ডলের সাধারণ সম্পাদক ভি কে বনসলের। বাড়ি, ফ্ল্যাট তৈরিতে চিনা সামগ্রী কমানোর ডাক দিয়েছে নির্মাণ সংস্থাগুলির সংগঠন ক্রেডাই-ও।
কিন্তু কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমারস্বামীর প্রশ্ন, “তাহলে এত দিন ধরে ঢাক পিটিয়ে চিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কী হল?”
বিশেষজ্ঞ থেকে পাড়ার দোকানি- সকলকে হোঁচট খেতে হচ্ছে ওই প্রতিযোগিতার প্রশ্নেই। যে মোবাইলে ‘টাইপ করে’ চিনা পণ্য ছুড়ে ফেলার ডাক, দেশে সেই স্মার্টফোনের প্রায় ৭০% বিভিন্ন চিনা সংস্থার কব্জায়। ভিভো, ওপো, রিয়েলমে, ইকু, শাওমি, ওয়ান প্লাসের মতো ব্র্যান্ডগুলির মালিকানা কিংবা নিদেন পক্ষে মোটা অংশীদারি চিনা সংস্থার হাতে। এ দিনই ভারতে আসামাত্র মুহূর্তের মধ্যে বিকিয়েছে ওয়ান প্লাসের ফোন। মার্কিন সংস্থা অ্যাপলের আই-ফোন তৈরির অন্যতম কারখানা চিনে। দক্ষিণ কোরীয় বহুজাতিক স্যামসাংয়ের পেটে সেঁধিয়ে হাজারো চিনা যন্ত্রাংশ। এমনকি বিক্রেতারা মানছেন, মাইক্রোম্যাক্স, লাভা, ইনটেক্সের মতো দেশি ব্র্যান্ডও চিনা যন্ত্রাংশে ঠাসা। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে তৈরি ও ডিজাইনও ওই দেশে। একই ছবি কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সেট-টপ বক্সের মতো আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে। যে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে ভর করে আত্মনির্ভরতার স্বপ্ন, চিনের সব থেকে বেশি রমরমা সম্ভবত সেখানেই।
স্টার্ট-আপে লগ্নির হাত ধরেও এ দেশে জীবনযাত্রার প্রায় সর্বত্র সেঁধিয়ে গিয়েছে চিন। অ্যাপে গাড়ি বুক করার ওলা, নেটে টাকা মেটানোর পেটিএম, বাড়িতে বসে খাবারের বরাত দেওয়ার জোম্যাটো কিংবা সুইগি, মাসকাবারির ফর্দ ধরানো বিগ বাস্কেট কিংবা ফ্লিপকার্ট, বাচ্চাদের পড়ার অ্যাপ বাইজ়ু’স থেকে শুরু করে হোটেল বুকিংয়ের মেক মাই ট্রিপ— এমন অজস্র সংস্থায় চিনা সংস্থার মোটা লগ্নি। সেখানে দাপট আলিবাবা, টেনসেন্ট, দিদি, চুক্সিং, ফোসান ক্যাপিটাল, চায়না-ইউরেশিয়া ইকনমিক কোঅপারেশন ফান্ডের মতো চিনা দৈত্যের।
বিভিন্ন সমীক্ষা অনুযায়ী, চিন থেকে আসা পণ্যের অর্ধেকই রিয়্যাক্টর, বয়লারের মতো জরুরি যন্ত্র, বিভিন্ন বৈদ্যুতিন পণ্য এবং তার যন্ত্রাংশ। এ দেশের ওষুধ শিল্পও তার কাঁচামালের জন্য প্রবল ভাবে নির্ভরশীল চিনের উপরে। জীবনদায়ী ওষুধ থেকে শুরু করে কাপড় কাচার সাবান তৈরির উপকরণ, সৌর বিদ্যুতের প্যানেল থেকে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি- জরুরি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় অসংখ্য পণ্য বা তার কাঁচামালের জন্য ভারতকে তাকিয়ে থাকতে হয় চিনের দিকে। কারণ, ওই দামে এ দেশে তো দূর, সারা বিশ্বে অনেক পণ্য আর কোথাও মেলে না। ২০% গাড়ি-যন্ত্রাংশ, টিভি-ফ্রিজের মতো ভোগ্যপণ্যেরও অন্তত ৪০% চিনের মাটিতে তৈরি। চিনের বিনিয়োগ যথেষ্ট পরিকাঠামো ক্ষেত্রেও।
তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, চিনা পণ্যের ব্যবহার রাতারাতি বন্ধ করা কতটা সম্ভব, সে বিষয়ে সন্দেহ যথেষ্ট। বরং দরকার চিনকে টেক্কা দিতে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা। তেমন শিল্পনীতি তৈরি। জমি-জট, লাল ফিতের ফাঁস আলগা করা। নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রকে পাখির চোখ করে সেই সমস্ত পণ্য তৈরিতে দক্ষতা অর্জন। সস্তার ‘মেড ইন চায়না’ কাঁচামালকেও ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’য় কাজে লাগানো।
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন ঘুরছে, “কাল যদি করোনার প্রতিষেধক চিনই বার করে? আমরা নেব না?” উত্তর সম্ভবত টিভি ছোড়ার মতো সহজ নয়।