এই গল্প দুই বন্ধুর। বরুণ ও অমলবাবুর। বছর কয়েক আগে প্রথম জন লগ্নি করেছিলেন ‘ক’ সংস্থার বন্ডে। আর অমলবাবুর মনে ধরেছিল ‘খ’ সংস্থার ঋণপত্র। দু’টি প্রকল্পেই রিটার্নের প্রতিশ্রুতি ছিল বেশ ভাল। দু’জনেই ভেবেছিলেন, মেয়াদ শেষে হাতে আসবে মোটা টাকা। মেয়াদ ফুরোতে দেখা গেল বরুণবাবুর হাতে অর্থ এল। পেলেন ভাল রিটার্নও। অথচ কপাল চাপড়াতে হল অমলবাবুকে। ভাল রিটার্ন তো দূর অস্ত্, আসলের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়েই সংশয় তৈরি হল তাঁর ক্ষেত্রে! শুনলেন, গণেশ উল্টেছে সংস্থার।
ভুল কোথায়?
দুই বন্ধুই তো রিটার্ন ভাল দেবে দেখে টাকা রেখেছিলেন। তবে পরিণতি এমন আলাদা কেন?
আসলে বরুণবাবু টাকা রাখার আগে ভাল করে দেখে নিয়েছিলেন সংস্থাটির আর্থিক অবস্থা কেমন। দেখেছিলেন, যে বন্ডে টাকা রাখছেন, তাকে কী রেটিং দিয়েছে মূল্যায়ন সংস্থাগুলি। কিন্তু ঠিক এখানেই ভুল করেছিলেন অমলবাবু। তিনি এ সব কিছুই দেখেননি। টাকা ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি রয়েছে কি না, জানতে পারেননি তা-ও। কারণ, তা মাপার যে ফিতে, সেই রেটিংয়ের দিকে চোখই দেননি তিনি।
ঝুঁকির মাপ
টাকা ঢালার যে জায়গাগুলি (যেমন, কোনও ব্যাঙ্কের আমানত, ঋণপত্র ইত্যাদি) ভীষণ সুরক্ষিত মনে হয়, তার মধ্যেও কিন্তু ঝুঁকি থাকে। হয়তো সেই ঝুঁকি শেয়ারের মতো নয়। কিন্তু তা বলে তাকে শূন্য বলা যায় না।
ঋণপত্রের মতো জিনিসে টাকা ঢালার আগে তাই তার উপরে ঝুঁকি মাপার ফিতে ফেলা একান্ত জরুরি। একেই রেটিং বলে চিনি আমরা।
তাই আজ দেখে নেব কেন এই রেটিং দেখা জরুরি, কী কী বিষয় মাথায় রাখতে হবে ইত্যাদি খুঁটিনাটি।
রেটিং কী?
কোনও প্রকল্পে বা সংস্থায় টাকা রাখা কতটা ঝুঁকির, কোথায় টাকা ফেরতের সম্ভাবনা কতটা, তার মূল্যায়নই হল রেটিং। যে প্রকল্পের রেটিং যত ভাল, তাতে টাকা রাখার ঝুঁকিও তত কম।
শুধু সংস্থাই নয়, কোনও ব্যক্তি বা বা দেশকে ঋণ দেওয়া কতটা ঝুঁকির, তার জন্যও ওই রেটিং দেওয়া হয়। সাধারণত রেটিং বাড়লে, তুলনায় কম সুদে সেই ব্যক্তি বা দেশের ধার পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। কমে সুদের বোঝা। তবে এখানে যেহেতু লগ্নি নিয়ে কথা বলতে বসেছি আমরা, তাই নজর দেব শুধু আমাদের লগ্নি সংক্রান্ত রেটিংয়ের উপরেই।
দেয় কারা?
সারা বিশ্বে বিভিন্ন রেটিং সংস্থা রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান তিন সংস্থা হল— এসঅ্যান্ডপি, মুডি’জ ও ফিচ। এই তিন বহুজাতিকেরই সদর মার্কিন মুলুকে। ভারতে এদের বিভিন্ন শাখা রয়েছে। যেমন, ফিচের ভারতীয় শাখা হল ইন্ডিয়া রেটিংস অ্যান্ড রিসার্চ (ইন্ড-রা), মুডি’জের শাখা ইক্রা আর এসঅ্যান্ডপি-র ক্রিসিল। এ ছাড়াও, ভারতে কেয়ার-সহ আরও সংস্থা এই রেটিং দেয়।
কেন জরুরি?
রেটিং কী, সংক্ষেপে তা বোঝা গেল। এ বার দেখব তা কেন জরুরি। দেখে নেব, কী ভাবে লগ্নির সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে এই রেটিং।
সংস্থা বাছাই
সাধারণত টাকা রাখার ক্ষেত্রে যেমন প্রকল্প বাছাই গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই বেছে নিতে হয় সংস্থাও। তেমন সংস্থা, যার উপর আমাদের আস্থা রয়েছে। যেগুলি ভবিষ্যতে ডোবাবে না বলে মনে হয়।
কিন্তু আমাদের এই ধারণা কতটা ঠিক, তারই আয়না সংস্থার রেটিং। আগামী দিনে সংস্থার আর্থিক স্বাস্থ্য কেমন থাকবে, তার আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকবে কি না, মুনাফা নাকি লোকসান, কোন পথে তার হাঁটার সম্ভাবনা— এই সমস্ত খতিয়ে দেখে কোনও সংস্থার মূল্যায়ন করা হয়। দেওয়া হয় রেটিং।
সাধারণত যে সংস্থার রেটিং বেশি, তারা নিজেদের আর্থিক স্বাস্থ্যের দিকে বেশি নজর দেয়। তবে মনে রাখবেন, এটা সব সময়েই যে সত্যি, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে কয়েক বছর পরে গিয়েও নানা কারণে সংস্থার হাল খারাপ হতে পারে।
প্রকল্প বাছাই
ব্যবসা চালাতে মূলধন লাগে। আর তা জোগাড়ের জন্য নিয়ন্ত্রকের অনুমতি নিয়ে বাজারে ঋণপত্র (বন্ড), ডিবেঞ্চার বা আমানত প্রকল্প ছাড়ে বিভিন্ন সংস্থা। সোজা কথায় বলতে, আমার-আপনার থেকে ধার নেয় তারা। আবার মিউচুয়াল ফান্ড সংস্থাগুলি নানা ধরনের ফান্ড ছাড়ে। এ ছাড়াও রয়েছে নানা রকম বিমা প্রকল্প, সিকিউরিটি, ঋণও। এগুলির মধ্যে কোনটি কতটা ঝুঁকির, টাকা ফেরতের সম্ভাবনা কতটা, তা বোঝা যায় রেটিং দেখলে।
অর্থাৎ, ধরা যাক ‘ক’ সংস্থা ‘খ’ নামে ফান্ড বাজারে আনল বা হয়তো বাজার থেকে টাকা তুলতে ঋণপত্র ছাড়ল ‘গ’ সংস্থা। এই রেটিং থেকে বোঝা যাবে ‘ক’-এর ফান্ড বা ‘গ’-এর
বন্ড কতটা কম ঝুঁকির। তাই প্রকল্প বাছার আগে রেটিং খুঁটিয়ে দেখুন।
কম সময়ে
যে কোনও খাতে টাকা রাখার সময়েই তার যাবতীয় খুঁটিনাটি দেখে লগ্নির কথা বার বার বলা হয়। কিন্তু সারা দিনের ব্যস্ততার মধ্যে অনেক সময়েই একার পক্ষে সব দিক বিচার করা সম্ভব হয় না। আবার এক বার টাকা ঢালার পরে, সেই সংস্থা কেমন করছে, তা-ও নজরে রাখতে হয় নিয়মিত। ‘আপনার হয়ে’ ঠিক এই কাজটাই করে রেটিং সংস্থাগুলি।
বিভিন্ন সংস্থা এবং প্রকল্পের খোঁজখবর রেখে, তাদের ঝুঁকির ক্রমাগত মাপ করে গিয়ে প্রয়োজনে রেটিং বদলাতে থাকে তারা। ফলে লগ্নিকারী হিসেবে ঝামেলা অনেকটা কমে যায়। বাঁচে সময়ও। তবে এখানে বলব, টাকা আপনার। তাই মূল্যায়ন সংস্থাগুলি যে রেটিংই দিক না কেন, শেষ পর্যন্ত আপনাকে খোঁজখবর রাখতেই হবে। তবে সে ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হতে পারে।
কে জাগে?
কোনও পাড়ায় পাহারাদার যদি প্রথম রাতে হাঁক পেড়েই ঘুমিয়ে পড়েন, তবে চোরকে আটকানো যাবে কি? লগ্নির বেলাতেও তাই।
অনেক সময়ে দেখা যায়, প্রকল্প বাজারে আনার সময়ে হয়তো সংস্থার অবস্থা ভাল ছিল। কিন্তু পরে তা খারাপ হয়েছে। অথবা উল্টোটা।
ধরুন, কোনও আমানত প্রকল্পের প্রথমে রেটিং ছিল AAA। অর্থাৎ, তার সুরক্ষা সবচেয়ে ভাল। কিন্তু পরে দেখা গেল, তা কমে হয়েছে BB (অর্থাৎ, ওই প্রকল্পের অবস্থা খারাপ হয়েছে)। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি সেখান থেকে টাকা সরিয়ে নেওয়ার। তাই লগ্নি করলে, নিয়মিত তার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকুন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রেটিংও কিন্তু বদলে যায়।
কোন রেটিংয়ে কী?
এত ক্ষণ তো রেটিং কেন জরুরি, তা নিয়ে কথা বললাম। চলুন এ বার চোখ রাখি কী দেখব, তার উপর। এখানে এক ঝলকে বোঝা যাবে যে, কোন রেটিংয়ের কী মানে। কোন মূল্যায়ন থাকলে নিশ্চিন্তে টাকা খাটানো যায়? কখন সাবধান হওয়া বা টাকা তুলে নিতে হবে। যেখানে রেটিংয়ের হাল একেবারে খারাপ, সেখানে তো লগ্নি করাই উচিত নয় বলে আমার মত।
মনে রাখুন
• রেটিং মানে কিন্তু কোনও প্রকল্পে টাকা ঢালা বা সেখান থেকে তুলে নেওয়ার পরামর্শ নয়। সেই সিদ্ধান্ত লগ্নিকারীর। কিন্তু কোথাও টাকা লগ্নি করা কতটা ঝুঁকির, তার একটা স্পষ্ট ধারণা রেটিং থেকে পাওয়া সম্ভব।
• অনেক সময় লগ্নিকারী টানতে খারাপ প্রকল্পে বেশি রিটার্নের প্রতিশ্রুতি দেয় নানা সংস্থা। তাই একই সঙ্গে সংস্থা ও প্রকল্পের রেটিং নীচের দিকে রয়েছে দেখলে, সেই ‘ফাঁকি’ চট করে ধরে ফেলা সম্ভব।
দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্প
সাধারণত যে সমস্ত ঋণপত্র নির্ভর প্রকল্পের মেয়াদ এক বছরের বেশি, তারা এর আওতায়। এদের রেটিং—
• IND AAA: সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত। টাকা ফেরতের সম্ভাবনাও খুব বেশি।
• IND AA: প্রকল্পের সুরক্ষা বেশি। টাকা ফেরতের সম্ভাবনাও বেশি।
• IND A: সুরক্ষা যথেষ্ট। ঝুঁকি কম।
• IND BBB: টাকা ফেরতের সম্ভাবনা মাঝারি। ঝুঁকি তুলনায় কম।
• IND BB: টাকা ফেরত না দেওয়ার সম্ভাবনা মাঝারি। সুতরাং ঝুঁকি তুলনায় বেশি।
• IND B: টাকা ফেরত না দেওয়ার সম্ভাবনা বেশ খানিকটা বেশি হওয়ায় ঝুঁকিও যথেষ্ট।
• IND C: টাকা ফেরতের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।
• IND D: টাকা ফেরতই মিলবে না।
স্বল্প মেয়াদি প্রকল্প
যে সব ঋণপত্র নির্ভর প্রকল্পের মেয়াদ এক বছরের কম, সেগুলি থাকে এর আওতায়। এদের রেটিং হল—
• IND A1: সব চেয়ে বেশি সুরক্ষিত। টাকা ফেরতের সম্ভাবনাও খুব বেশি। ঝুঁকি তাই সব থেকে কম।
• IND A2: প্রকল্পের সুরক্ষা বেশি। ঝুঁকিও তুলনায় কম।
• IND A3: সুরক্ষা ও ঝুঁকি মাঝারি।
• IND A4: টাকা ফেরত না দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ঝুঁকিও তাই বেশি।
• IND D: টাকা ফেরতই মিলবে না।
দীর্ঘ মেয়াদি ডেট ফান্ড
যে সব ঋণপত্র নির্ভর ফান্ডের মেয়াদ এক বছরের বেশি, সেগুলি আসে এর আওতায়। এগুলির রেটিং হল—
• IND AAAmfs: সব চেয়ে সুরক্ষিত। টাকা ফেরতের সম্ভাবনাও খুব বেশি। ঝুঁকি সব চেয়ে কম।
• IND AAmfs: প্রকল্পের সুরক্ষা বেশি। ঝুঁকি তুলনায় কম।
• IND Amfs: সুরক্ষা যথেষ্ট। ঝুঁকিও তাই কম।
• IND BBBmfs: প্রকল্পের সুরক্ষা এবং ঝুঁকি মাঝারি।
• IND BBmfs: টাকা ফেরত না দেওয়ার সম্ভাবনা মাঝারি। ঝুঁকি বেশি।
• IND Bmfs: টাকা ফেরত না দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
• IND Cmfs: টাকা ফেরতের সম্ভাবনা প্রায় নেই। ঝুঁকি খুব বেশি।
স্বল্প মেয়াদি ডেট ফান্ড
যে সমস্ত ঋণপত্র নির্ভর ফান্ডের মেয়াদ এক বছরের কম, তারা থাকে এর আওতায়। এদের রেটিং হল—
• IND A1mfs: সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত। টাকা ফেরতের সম্ভাবনাও খুব বেশি। ঝুঁকি সবচেয়ে কম।
• IND A2mfs: প্রকল্পের সুরক্ষা বেশি। ঝুঁকিও তুলনায় কম।
• IND A3mfs: সুরক্ষা মাঝারি। ঝুঁকিও তাই মাঝারি মাপের।
• IND A4mfs: টাকা ফেরত না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
চিহ্ন যোগ
উপরের চারটি ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট রেটিংয়ের পরে ‘+’ বা ‘–’ লেখা থাকতে পারে। একটি নির্দিষ্ট মাপকাঠির মধ্যে প্রকল্পগুলির ঝুঁকির সামান্য তারতম্য করতে ওই চিহ্ন ব্যবহার করা হয়।
লেখক: কর ও বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)
পাঠকের প্রশ্ন ?
প্রঃ বাবার আগেই বিবাহিত মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কি তাঁর স্বামী এবং সন্তান বাবার সম্পত্তি পাবেন?
মঞ্জুল হালদার
প্রশ্ন পড়ে মনে হচ্ছে, আপনি হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের আওতায় পড়েন। এই আইনে বাবা, মায়ের সম্পত্তিতে ছেলে ও মেয়েদের সমান অধিকার। অর্থাৎ বাবা, মায়ের অবর্তমানে সন্তানেরা সমান ভাগে সম্পত্তি পাবেন। যদি বাবা, মা ইচ্ছাপত্র অথবা দানপত্রের মাধ্যমে নিজেদের সম্পত্তি বণ্টনের অন্য ব্যবস্থা না করে থাকেন, তা হলে এই আইন অনুযায়ী সেই সম্পত্তির উত্তরাধিকার ঠিক হবে। সে ক্ষেত্রে বাবার অবর্তমানে তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন—
• মা
• বিধবা স্ত্রী
• মেয়ে
• ছেলে
• ছেলে আগেই মারা গেলে, তাঁর বিধবা স্ত্রী
• মৃত ছেলের ছেলে
• মৃত ছেলের মেয়ে
• নাতি মারা গেলে, তাঁর বিধবা স্ত্রী
• মৃত নাতির ছেলে
• মৃত নাতির মেয়ে
• মেয়ে আগে মারা গেলে, তাঁর ছেলে
• মৃত মেয়ের মেয়ে
কিন্তু আগে মৃত মেয়ের স্বামীর কথা ওই তালিকায় নেই। তাই বলা যায়— হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, বাবার অবর্তমানে আগে মারা যাওয়া মেয়ের সন্তানেরা তাঁদের মায়ের অংশের উত্তরাধিকারী হবেন। কিন্তু মৃত মেয়ের স্বামী সম্পত্তি পাবেন না।
পরামর্শদাতা: জয়ন্ত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
পরামর্শের জন্য লিখুন:
‘বিষয়’, ব্যবসা বিভাগ,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা, পিন-৭০০০০১।
ই-মেল: bishoy@abp.in
ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানাতে ভুলবেন না