বামপন্থী হোক বা সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ। সদ্য লোকসভায় পেশ হওয়া ‘শিল্পে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক বিধি’র জেরে সহজে ছাঁটাইয়ের দরজা খুলবে বলে আশঙ্কা প্রায় সব কর্মী সংগঠনেরই। তাদের মতে, এতে স্থায়ী চাকরির সংখ্যা কমে বাড়বে ঠিকায় নিয়োগের প্রবণতা। তলানিতে ঠেকবে কর্মীদের দর কষাকষির ক্ষমতা। এই
অভিযোগের সঙ্গে একমত তো বটেই, সেই সঙ্গে বিল আনার ‘সময়’ ঘিরেও অশনি সঙ্কেত দেখছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তাঁদের মতে, এই বিল পাশ হলে কাজের বাজারে অনিশ্চয়তা বাড়বে। আরও ক্ষীণ হবে অর্থনীতির দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা।
দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সের অর্থনীতির অধ্যাপক দিব্যেন্দু মাইতি বলেন, ‘‘বিশ্বায়নের যুগে প্রতিযোগিতায় এগোতে সংস্থাগুলি এমনিতেই খরচ কমাতে মরিয়া। তার অঙ্গ হিসেবে কোপ পড়ছে বেতনে। তার উপরে কোণঠাসা অর্থনীতিতে বহু জন কাজ
খোয়ানোয় মজুরি নিয়ে দর কষাকষির পরিসর আরও কমেছে। এই অবস্থায় আইন মালিকের দিকে এক তরফা হলে, সমস্যা আরও বাড়তে পারে।’’
মূল্যবৃদ্ধির কামড় যাতে আয়ের বড় অংশকে খেয়ে না-ফেলে, তা নিশ্চিত করতে গত কয়েক বছর ধরে তার হার বেঁধে রাখায় জোর দিচ্ছে কেন্দ্র। দিব্যেন্দুর প্রশ্ন, রোজগারের জায়গায়ই নড়বড়ে হয়ে গেলে আর প্রকৃত আয় ঠিক থাকবে কী ভাবে?
অর্থনীতিবিদদের অনেকের মতে, তলানিতে ঠেকা বৃদ্ধি ও বেকারত্বের
সাঁড়াশি আক্রমণে কাবু অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সব চেয়ে আগে চাহিদা বাড়ানোর চেষ্টা জরুরি। যুক্তি, মানুষের হাতে টাকা গেলে, তবে কেনাকাটা বাড়বে। তার হাত ধরে কারখানায় নতুন লগ্নি আসবে। বাড়বে বেতন, কাজের সুযোগ। এই কর্মীরা আবার বাজারমুখী হলে তবে চাঙ্গা হবে চাহিদা। গতি ফিরবে অর্থনীতির চাকায়।
জেএনইউয়ের সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চের ডিরেক্টর রঞ্জনা কুমারী বলছেন, ‘‘আমজনতা কাজের সুযোগ পেলে তবেই তাঁদের হাতে টাকা আসবে। একে দেশে এখন চাকরি বাড়ন্ত। তার উপরে ছাঁটাইয়ের সুযোগ বাড়লে কাদের কেনাকাটায় ভর করে চাঙ্গা হবে চাহিদা?’’ শুধু তা-ই নয়। কাজের নিশ্চয়তা যত বেশি, সাধারণত তত নিশ্চিন্তে কেনাকাটা করেন মানুষ। প্রশ্ন উঠছে, ঠিকায় নিয়োগ বাড়লে চাকরি বজায় থাকার কোন ভরসায় বাজারমুখী হবেন তাঁরা? প্রয়োজনের বাইরের কেনাকাটায় কোপ পড়বে না কি? বিশেষত বিভিন্ন উন্নত দেশের মতো নিখরচায় চিকিৎসা বা বেকারত্ব ভাতার মতো সুরক্ষা-কবচ যেখানে নেই।
রঞ্জনার অভিযোগ, এমনিতেই আন্তর্জাতিক শ্রম প্রতিষ্ঠানের অনেক বিধি দেশে রূপায়িত হয় না। গত এক দশকে ধর্মঘট, কর্মী বিক্ষোভও চোখে পড়ার মতো কমেছে। তার উপরে এই বিল পাশ হলে, শ্রমিকদের আরও কোণঠাসা হওয়ার সম্ভাবনা।
মুনাফা বাড়াতে প্রযুক্তিতে লগ্নি বা উদ্ভাবনে জোর দেওয়ার বদলে অনেক সংস্থা যে ভাবে শুধু বেতন ও নিয়োগে রাশ টেনে খরচ কমায়, তাতে তীব্র আপত্তি বহু বিশেষজ্ঞেরই। সমাজবিজ্ঞানী যোগেন্দ্র যাদবের কথায়, ‘‘সময়োপযোগী হতে শ্রম আইনে সংস্কার যে জরুরি, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু অর্থনীতির এই দুঃসময়ে যে ভাবে তড়িঘড়ি তা করার চেষ্টা হচ্ছে, তাতে বিপদ বাড়তে পারে।’’ তাঁর কথায়, এই শ্রম আইনকে সঙ্গী করেই ইউপিএ আমলে ৮%-৯% বৃদ্ধির মুখ দেখা গিয়েছে। অর্থনীতির বর্তমান সঙ্কটের জন্যও এই আইনকে দায়ী করছেন না কেউ। তবে তা বদলাতে তাড়া কীসের, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি।