সে এক সময় ছিল যখন বাজেটের খুঁটিনাটির দিকে তীক্ষ্ণ নজর থাকত শেয়ার লগ্নীকারী, সাধারণ মানুষের। কোন পণ্যের দাম বাড়ল, কোন ব্যবসার তাতে লাভ বা ক্ষতি হল, রাজস্ব ঘাটতি বাড়ল না কমল, তার চুলচেরা বিচার হত টেলিভিশনে, খবরের কাগজে। সেই আলোচনা এ বছরও নিশ্চই হবে। কিন্তু জিএসটি-র দৌলতে বাজেট সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহ এখন যেন কিছুটা কম। এই অনাগ্রহের কারণ— তেল, মশলা, সাবানের মতো বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামের আর তেমন হেরফের হওয়ার নেই। বাজেটের আাগেই ২৯টি পণ্য আর ৫৪টি পরিষেবার দাম কমিয়েছে জিএসটি কমিটি।
তার ওপর ভোটের আগে এটাই শেষ বাজেট। ফলে ধরেই নেওয়া যায়, মানুষকে খুশি করার চেষ্টা হবে বাজেটে। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হয়ত বাড়বে, আয়করে হয়ত কিছু রদবদল হবে, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ সরবরাহে বরাদ্দ আশা করা যায় বাড়বে।
আর এ সবের কারণে বাজেটের পর সূচক বাড়ার সম্ভাবনাও কম। এমনিতেই বাজার এখন অনেক চড়ায়। বম্বে শেয়ার বাজারের সূচক গত ডিসেম্বরে ৩৪ হাজার ছাড়ানোর মাত্র সতেরো দিনের মাথায় ৩৫ হাজারের গণ্ডি টপকেছে। তার মানে এই নয় যে অর্থনীতি সম্পর্কে বাজারের খুব বেশি উচ্চাশা প্রকাশ পাচ্ছে। বরং বলা যায় গত দেড় বছর টালমাটালের পর অর্থনীতি এখন কিছুটা থিতু হয়েছে । যদিও এ বছরের জিডিপি বৃদ্ধির হার মাত্র ৬.৭%, পরের বছরও ৭.১-৭.৪% হবে বলে আশা করা হচ্ছে। নভেম্বরেও আটটি সবচেয়ে প্রয়োজনীয় শিল্প উৎপাদন ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৮%, তাও কেবল স্টিল আর সিমেন্টের দৌলতে। বিদ্যুৎ উৎপাদন তো বরং কমেছে। তৃতীয় ত্রৈমাসিকে কম্পানি ফলও তেমন ভাল হয়নি। টাকার মূল্যবৃদ্ধিতে রফতানি শিল্পের নাভিশ্বাস, যদিও ডলার সস্তা হওয়ায় আমদানি খানিক সুবিধায়। টাকার মুল্যবৃদ্ধির কারণ বিদেশি লগ্নির স্রোত, তা যতটা ভারতের অর্থনীতির আকর্ষণে তার চেয়ে বেশি আমেরিকার অর্থনৈতিক বৃদ্ধির কারণে। যা অনেকাংশে ও দেশের সুদের হার কম থাকার জন্য। অনেক মহলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই দ্রুত বৃদ্ধি যেন ২০০৭-০৮ এর মতো বিপদ না ডেকে আনে। ফেডেরাল রিজার্ভ যদি সুদের হার বাড়ায়, তা হলেও ক্ষতি ভারতের মতো দেশেরই।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে ভারতের শেয়ার বাজারের এখনকার রমরমা বাজেটপূর্ব আশার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। বাজেটে অর্থমন্ত্রী খরচের বরাদ্দ বাড়ান বা আয়করের হেরফর করুন, সে সব মাথায় রেখেই এখন বাজারকে দেখছেন লগ্নীকারীরা। বরং, সরকারি রাজস্ব ঘাটতি সম্পর্কে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। এ বছর ঘাটতি ৩.২%। সরকারি ধারের বোঝা ৫০ হাজার কোটি টাকা থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা কমানোয় শেয়ার বাজার স্বভাবতই উৎফুল্ল। এ বছরের মতো রাজস্ব বাড়ানো গিয়েছে শেষ কয়েক মাসে। ২০১৮-১৯ এর বাজেটেও যদি ঘাটতির হার একই রাখা হয়, ধার না বাড়িয়ে, তাহলে খরচের বরাদ্দ বজায় রাখা যাবে তো? উত্পাদন বৃদ্ধি, চাকরির যোগান দেওয়া যাবে তো?
তার ওপর যদি শেয়ার বাজারে দীর্ঘকালীন লগ্নীর ওপর ক্যাপিটাল গেন ট্যাক্স বসানো হয়, বা সরকারি সংস্থায় শেয়ার বিক্রয়ের বরাদ্দ বাড়ানো হয়, যার ফলে বাজারলগ্নী অর্থের ওপর চাপ পড়বে, তাহলে তা বাজারের পক্ষে খুব সুখবর হবে না।
তবে একথা ঠিক যে ভারতীয় মধ্যবিত্ত এখন শেয়ার বাজার বা মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নীতে অভ্যস্ত হয়ে এসেছে। ফলে বাজারকে কেবল বিদেশি লগ্নীর ওপর নির্ভর করতে নাও হতে পারে। ২০১৮-১৯ সালে কম্পানি ফল কেমন হয়, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য আর কী সরকারি পন্থা নেওয়া হয়, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অর্থের যোগান যথেষ্ট রাখে কিনা বা মূদ্রাস্ফীতির হাল কী হয়, সে সবের দিকেই তাকাবে শেয়ার বাজার, সমগ্র বাজেটের দিকে তেমন নয়।