পেট চালাতে জরিশিল্পী এখন মুটে

অজিত জেটি পেটের জ্বালায় এখন লরির মাল খালাসের কাজ করেন। আদতে জরিশিল্পী অজিতবাবু সামান্য আয়ের আশায় শারীরিক পরিশ্রম করছেন উদয়াস্ত।

Advertisement

দেবপ্রিয় সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:৫১
Share:

অজিত জেটি পেটের জ্বালায় এখন লরির মাল খালাসের কাজ করেন। আদতে জরিশিল্পী অজিতবাবু সামান্য আয়ের আশায় শারীরিক পরিশ্রম করছেন উদয়াস্ত।

Advertisement

শুধু অজিতবাবু নন, জন্ম থেকে গ্রামে জরির কাজ দেখে বড় হওয়া সাঁকরাইলের বহু মানুষ একে পেশা করেছেন। কিন্তু পুরনো পাঁচশো, হাজারের নোট বাতিলের ধাক্কায় এখন জরি শিল্পের কাজ প্রায় বন্ধ। ফলে সংসার চালাতে সূক্ষ্ম নকশার কাজে দক্ষ শিল্পী-কারিগররা বিভিন্ন কারখানা ও ট্রাক-লরির মাল খালাসের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন নামমাত্র আয়ে।

হাওড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকায় জরির কাজের উপর নির্ভরশীল লক্ষাধিক পরিবার। বাড়িতেই চলে কাজ। ওস্তাগররা (জরির বড় কারিগর বা শিল্পী) বড়বাজার বা পার্ক স্ট্রিটের পাশাপাশি ভিন্‌ রাজ্য থেকেও বরাত এনে গ্রামের ছোট শিল্পীদের দেন। সেই চাপ এতটাই থাকে যে, বেশির ভাগ পরিবারে একাধিক সদস্য জরি কারিগরের কাজ করেন। কিন্তু হালে ছবিটা বেমালুম বদলে গিয়েছে।

Advertisement

নোট বাতিলের জেরে বাজারে নগদের আকাল। বরাত নেই জরির কাজের। কখনও বরাত নেওয়া যাচ্ছে না মাল কেনার টাকা না-থাকায়। আবার কষ্টেসৃষ্টে মাল কিনলেও শিল্পী মজুরি পাচ্ছেন না। ফলে ব্যবসার চাকা আটকে গিয়েছে। শিল্পীদের দাবি, বাজার সবচেয়ে ভাল থাকে শীতে। কারণ একে তো উৎসব, তার উপরে বিয়ের পোশাকের চাহিদাও থাকে তুঙ্গে।

সাঁকরাইলের বাসিন্দা অজিতবাবু ও বিপ্লব রায় জানাচ্ছেন, আগে জরির কাজ করে এই সময় সপ্তাহে আয় হত গড়ে ২,৫০০-৩,০০০ টাকা। এখন কপাল ভাল থাকলে কেউ কেউ হাজার খানেক পাচ্ছেন। তবে গত ১৫ দিনে তাঁরা কাজ পাননি বললেই চলে। অজিতবাবুর কথায়, ‘‘টাকার অভাবে ওস্তাগররা কাঁচামাল কিনতে পারছেন না। ফলে বরাত দেওয়া যাচ্ছে না। আবার আমরা কাজ করে দিলেও, নগদের অভাবে মজুরি মিলছে না।’’ উপায়ন্তর না থাকায় ধূলাগড়ের মতো এলাকায় সামান্য রোজগারে মাল খালাসের কাজ খুঁজে নিয়েছেন তাঁরা। অনেকে আবার কারখানায় অন্য টুকটাক কাজও করছেন।

বিপ্লববাবু বলেন, ‘‘১২ ঘণ্টা খাটলে হয়তো ১৫০ টাকা বা তার কিছু বেশি মেলে। কিন্তু রোজ কাজ থাকে কই?’’ আর অজিতবাবুর কথায়, ‘‘জরির কাজ বাড়িতে একটানা অনেকক্ষণ করা যায়। কিন্তু খালাসের কাজে বড় পরিশ্রম। খুব খিদে পায়। কিন্তু তা মেটানোর টাকা নেই। ফলে ক্লান্তি আসছে। শরীর ভাঙছে।’’

কারিগরদের কাজ না দিতে পারার কথা মানছেন সাঁকরাইলেরই অন্যতম ওস্তাগর শেখ লালবাবু। তিনি বলেন, ‘‘নগদের অভাবে বরাত আসা প্রায় বন্ধ। কাজ করিয়ে টাকাই বা কোথা থেকে দেব?’’ বরাতের টাকা চেক-এ পাওয়া গেলেও জরির কাজের জন্য মালপত্র কিনতে লক্ষাধিক টাকা লাগে। লালবাবুর প্রশ্ন, ‘‘সেটা কোথা থেকে আসবে? তার উপর বড়বাজার থেকে মালপত্র নগদে কিনতে হয়। তার অভাবে মজুরিও দিতে পারছি না।’’ আবার বরাতের মাল পাঠালে অনেক সময় বাতিল নোটে দাম দিতে চাইছেন ক্রেতারা।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার আমতলায় ছোট জরির পোশাকের কারখানা বিথীকা কুন্তির। মুম্বইয়ের পাশাপাশি কলকাতায় বড়বাজার, পার্ক স্ট্রিটের বিভিন্ন বিপণির থেকে কাজ পান। বললেন, ‘‘কাজ কমেছে প্রায় ৩০%। চারটি বিয়ের পোশাকের বরাতের জন্য কাপড় এসেছিল মুম্বইয়ের শোরুম থেকে। কিন্তু চারটিই পিছিয়ে গিয়েছে। ফলে আপাতত কাজটা বন্ধ। কাজ হচ্ছে না কলকাতাতেও। কারিগর ধরে রাখতে নিজস্ব কাজই করছি। মেলায় বিক্রি করব।’’ যদিও তা মোট কাজের মাত্র ২৫%, জানাচ্ছেন বিথীকা।

এই অবস্থায় এখন আশার আলো তেমন চোখে পড়ছে না। অগত্যা শুধুই হা-পিত্যেশ অপেক্ষা। প্রার্থনা কখন বাজারে টাকার জোগান বাড়ে। আশা, হয়তো সুদিন ফিরবে তখনই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement