জিএসটি এখন স্নায়ুর লড়াই

কেন্দ্র বলছে, ‘আমরা তৈরি।’ রাজ্য বলছে, ‘নই’। অরুণ জেটলির পণ, ‘১ জুলাই’। অমিত মিত্রের প্রশ্ন, ‘এক মাস পিছোতে আপত্তি কোথায়?’’ মোদী আর মমতা সরকারের এই টানাপড়েনে কোথায় দাঁড়িয়ে জিএসটি? উত্তর খুঁজল আনন্দবাজারকেন্দ্র বলছে, ‘আমরা তৈরি।’ রাজ্য বলছে, ‘নই’। অরুণ জেটলির পণ, ‘১ জুলাই’। অমিত মিত্রের প্রশ্ন, ‘এক মাস পিছোতে আপত্তি কোথায়?’’

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৭ ০২:৩৫
Share:

হাড্ডাহাড্ডি: পরিষদের বৈঠকে অমিত মিত্র ও অরুণ জেটলি। ফাইল চিত্র

প্রশ্ন: জিএসটি কি সত্যিই ১ জুলাই চালু হবে?

Advertisement

আপাতত ওই দিনটিকেই পাখির চোখ করেছে মোদী সরকার। গত কয়েক মাস ধরে লাগাতার এই একই মন্ত্র জপছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। এমনকী মঙ্গলবারও ১ জুলাই জিএসটি চালুর কথা বলেছেন তিনি। ফলে সে দিক থেকে দেখলে, কেন্দ্র একবগ্গা। তাদের দাবি, এ বিষয়ে অধিকাংশ রাজ্যও তাদের পাশে।

প্র: রাজ্য কি বেঁকে বসেছে?

Advertisement

নীতিগত ভাবে জিএসটি নিয়ে আপত্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারেরও নেই। শুধু তা চালু করতে বাড়তি সময় চাইছে তারা। যুক্তি, নতুন কর ব্যবস্থা চালুর পরিকাঠামো এখনও পুরোদস্তুর তৈরি নয়। এর জন্য তৈরি নয় শিল্পমহলও। বিশেষত সাধারণ ব্যবসায়ী ও ছোট-মাঝারি সংস্থাগুলি।

প্র: যদি রাজ্য ১ জুলাইয়ের ফরমান না মানে?

খাতায়-কলমে সে হক রাজ্যের আছে। কারণ, ২০১৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংসদে জিএসটির জন্য সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ হয়েছিল। সেখানে বলা ছিল— এক বছরের মধ্যে (অর্থাৎ, আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর) দেশে জিএসটি চালু হবে।

অর্থাৎ, ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কিন্তু রাজ্য খাতায়-কলমে যুক্তমূল্য কর (ভ্যাট)-সহ পুরনো শুল্ক আদায় করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা করা কতটা সম্ভব, সেটি বেশ বড় প্রশ্ন।

প্র: কেন? রাজ্য নিজের মতো কর আদায় করলে, কেন্দ্র আপত্তি করবে?

না। তা করার এক্তিয়ারও কেন্দ্রের নেই। গোল বাঁধবে অন্যখানে। সত্যিই যদি ১ জুলাই জিএসটি চালু হয় আর রাজ্য তা না-মানে, সে ক্ষেত্রে এখানে পণ্য-পরিষেবা কেনা-বেচা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা।

প্র: সে কী! এমন কেন?

ধরুন, অন্য রাজ্যে পণ্য তৈরি করে এমন কোনও সংস্থা পশ্চিমবঙ্গে তা বিক্রি করতে এল। সে তো সেখানে জিএসটি দিয়ে এসেছে। তা হলে এখানকার ডিলার সেই পণ্য কিনবে কী ভাবে? এখানে কেন্দ্রীয় বিক্রয় কর (সিএসটি) বা ভ্যাট দেওয়ার জো তো ওই সংস্থার নেই।

আবার এখানকার কোনও সংস্থা হয়তো ভিন্‌ রাজ্যে গেল তা বিক্রি করতে। সে ক্ষেত্রে তারা পশ্চিমবঙ্গে পুরনো কর গুনেছে। ফলে পরে সেই লেনদেনে জিএসটির ‘ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট’ (আগের স্তর পর্যন্ত আগেই মেটানো করের দৌলতে যে-টাকা ফেরত পাওয়ার কথা) তারা পাবে না। সমস্যা সেখানেও।

মনে রাখতে হবে, কৃষিপণ্য ছাড়া যত জিনিসপত্র পশ্চিমবঙ্গে কেনা-বেচা হয়, তার ৮০-৯০ শতাংশই আসে ভিন্‌ রাজ্য থেকে। ফলে বাকি দেশে চালু হয়েছে, কিন্তু এ রাজ্য মানেনি, এমন হলে এখানে বিক্রিবাটায় প্রায় তালা পড়ে যাওয়ার কথা। তার দৌলতে ক্ষতি হবে রাজস্বেরও।

প্র: জিএসটির সব বিল কি পাশ হয়ে গিয়েছে?

জিএসটি-র তিনটি বিল সংসদে পাশ হয়েছে। সেগুলি হল— কেন্দ্রীয় জিএসটি (সিজিএসটি), আন্তঃরাজ্য লেনদেনে বসা সম্মিলিত জিএসটি (আইজিএসটি) এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জিএসটি (ইউটিজিএসটি)।

কিন্তু শুধু তা যথেষ্ট নয়। এ ছাড়াও আছে রাজ্য জিএসটি (এসজিএসটি)। গোড়াতেই ঠিক হয়েছিল, তা দেশের অন্তত অর্ধেকের বেশি রাজ্যের বিধানসভায় পাশ হলে, তবেই জিএসটি চালুর প্রশ্ন। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ-সহ গুটিকয় রাজ্য ছাড়া সেই কাজ সারা। ফলে অন্তত আইনত জিএসটি চালুতে কোনও বাধা নেই।

প্র: তা হলে রাজ্য লড়ছে কোন জোরে? জিএসটি চালু করা ছাড়া আর কোন রাস্তা সামনে খোলা?

ব্যাপারটা এখন অনেকটা স্নায়ুর লড়াই। কেন্দ্র জানে, ১ জুলাই থেকে জিএসটি চালু করতে আইনত আর কোনও বাধা নেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বা যে-কোনও রাজ্যকে বাদ দিয়ে নতুন কর ব্যবস্থা শুরু করলে দু’টি অসুবিধা। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে তা ভাল দেখায় না। বিশেষত সংবিধান সংশোধন থেকে শুরু করে করের হার ঠিক করা— সবই যেখানে ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, কোনও একটি রাজ্য জিএসটির বাইরে থাকলে, সেখানে পুরো বিক্রিবাটাই তালগোল পাকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।

উল্টো দিকে, একা জিএসটি চালু না-করার ঝক্কি যে কতখানি হতে পারে, তা বিলক্ষণ জানে রাজ্য। সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর, শেষ মূহূর্তে বিধানসভায় জিএসটি বিল পাশ করার বন্দোবস্তও সেরে রেখেছে তারা। কিন্তু তার আগে কেন্দ্রের কাছে কিছু দাবি-দাওয়া আদায় তাদের লক্ষ্য হতেই পারে।

রাজ্যের দাবি, ইতিমধ্যেই তাদের দাবি মেনে সোনা, জুতো, জামা-কাপড় ইত্যাদিতে করের হার কম রেখেছে জিএসটি পরিষদ। তার পরের বৈঠক ১১ জুন। কে বলতে পারে, হয়তো সিনেমা-সহ আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে রাজ্যের দাবি মানলে, তারা দ্রুত জিএসটি আইন পাশ করানোর কথা ভাবতেও পারে। যদিও শেষমেশ কী হবে, তা পুরোটাই নির্ভর করছে প্রশাসনের একেবারে শীর্ষ স্তরে ভাবনাচিন্তার উপর।

প্র: যে-সমস্ত রাজ্য বাকি, তারা যদি সেপ্টেম্বরেও জিএসটি চালু না-করে? সে ক্ষেত্রে কি নতুন কর বাতিলই হয়ে যাবে?

জিএসটির জন্য সংসদে পাশ করা ১০১তম সংবিধান সংশোধনী আইনের ২০ নম্বর ধারায় তার দাওয়াই রয়েছে। তাতে বলা আছে, কোনও কারণে জিএসটি কার্যকর করতে ১৬ সেপ্টেম্বরের থেকে বেশি দেরি হলে, রাষ্ট্রপতি তার মেয়াদ বাড়াতে পারেন।

তবে এত আলোচনার পরে, সমস্ত করের হার থেকে শুরু করে প্রায় সব ঠিক হয়ে যাওয়ার পরে তেমনটা হওয়ার সম্ভাবনা সত্যিই অল্প।

তথ্য সহায়তা:

তিমিরবরণ চট্টোপাধ্যায়

(বেঙ্গল চেম্বারের পরোক্ষ কর কমিটির চেয়ারম্যান)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement